সূচনা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময় ভারতের যেসব অঞ্চলে কৃষকদের উপরে রাজস্বের হার অত্যাধিক পরিমাণে বৃদ্ধি করে সরকার রোষের মুখে পড়েছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল গুজরাট এখানকার সুরাট জেলার বারদৌলি কামলুকে অন্তত ষাট শতাংশ মানুষ ছিল অনুন্নত কালিপরাজ (কালো মানুষ) সাম্প্রদায়ের হরিজন। অত্যন্ত অনকর্ষণ এই হরিজনদের বেশিরভাগ ছিল ভূমিহীন ক্ষেতমজুর বা ভাগচাষী। তারা উজালীপারাজ (সাদা মানুষ) নামের স্থানীয় উচ্চ বর্ণের মানুষদের জমি বংশ পরম্পরায় চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করত। আর্থিক দিক থেকে খুবই দুর্বল এই শ্রেণীর মানুষদের দুর্দশার আর কোন সীমা ছিল না।
১৯২০-র দশকের কৃষক আন্দোলন
অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে ১৯২০-২২ খ্রিস্টাব্দ পরবর্তীকালে গুজরাটে বারদৌলি তমলুকে দরিদ্র অনগ্রসর কৃষকদের দুরবস্থা খুবই বৃদ্ধি পায়।
১. অসহযোগ আন্দোলনের প্রভাব
গান্ধীজি উনি শো করেই খ্রিস্টাব্দে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন শুরু করলে গুজরাটে এই আন্দোলনে যথেষ্ট প্রভাব পড়ে। এখনকার বারদৌলি তমলুকে আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে। কল্যাণজী মেহতা, কউনবএরজই মেহেতা, দয়ালজি দেশাই প্রমুখ নেতা বারদৌলির জনসাধারণকে গুজরাটের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেন এবং সত্যাগ্রহের আদর্শ প্রচার করে জনগণকে সচেতন করে তুলতে থাকে। গান্ধীজীর উদ্যোগে এখানকার বিভিন্ন স্থানে সত্যাগ্রহ শিবির স্থাপন করে হরিজনদের মধ্যে সামাজিক উন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সুরা পান, পণপ্রথা প্রভৃতির বিরুদ্ধে হরিজন সমাজে প্রচার চালানো হয়।
২. কর বৃদ্ধি
কৃষকদের আর্থিক দুর্ধর্ষ সত্ত্বেও সরকার ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে ঘোষণা করেন যে, বারদৌলি অঞ্চলের আদর্শ ৩০ শতাংশ বৃদ্ধির করা হবে। এর ফলে সরকার ৩০ শতাংশের পরিবর্তে রাজস্ব ২১. ৯৭ শতাংশ বাড়ানো হবে বলে ঘোষণা করে।
৩. খাজনা বন্ধ
কৃষকদের ওপরে আদর্শ বৃদ্ধি করা হলে গান্ধীজীর অনুগামীরা কৃষকদের পুরনো আদর্শ দানব বন্ধ করতে বলেন। এক্ষেত্রে তাদের যুক্তি ছিল, সম্পূর্ণ রাজস্ব প্রধান বন্ধ করলে সরকার তার রাজস্ব বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে বাধ্য হবে। সাধারণ কৃষকরা সম্পূর্ণ রাজস্ব প্রধান বন্ধ করার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে। রাজস্ব প্রধান বন্ধ করে গুজরাটে বারদৌলির কৃষকরা সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সামিল হয়।
৪. বল্লভভাই প্যাটেলের উদ্যোগ
বারদৌলি সত্যাগ্রহ আন্দোলনে নেতৃত্বে দেওয়ার উদ্দেশ্যে গান্ধীবাদী যুবক সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে বারদৌলিতে আসেন। তা নির্দেশে বারদৌলির কৃষকরা খাজনা প্রধান বন্ধ করার শপথ গ্রহণ করে। প্যাটেল বারদৌলি অঞ্চলকে ১৩ টি অংশে বিভক্ত করে বিভিন্ন অংশে আন্দোলন পরিচালনার দায়িত্ব পৃথক পৃথক নেতাদের হাতে তুলে দেন। ছাত্র যুবসহ ১৫০০ স্বেচ্ছাসেবক আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যায়। বল্লভ ভাই প্যাটেল কে পুলিশ গ্রেফতার করলে গান্ধীজী বারদৌলিতে এসে ২ আগস্ট ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে আন্দোলনের আন্দোলনে নেতৃত্ব গ্রহণ করে।
৫. আন্দোলনের প্রসার
সত্যাগ্রহ আন্দোলন ক্রমে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আন্দোলনের খবর সংবাদপত্রের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে এবং সারাদেশে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। বোম্বাই আইন সভার সদস্যরা আন্দোলনরত কৃষকদের সমর্থন করে। আন্দোলনের সমর্থনে বোম্বাইয়ের মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের কাউন্সিলর কে. এন. মুন্সি ওর লালা জি নারায়ণজী তাদের সদস্যপদ থেকে ইস্তফা দেন। ফলে সরকার আরো বিপাকে পড়ে।
৬. মহিলাদের অংশগ্রহণ
বারদৌলি সত্যাগ্রহ আন্দোলনে মহিলারা ও যথেষ্ট সংখ্যায় যোগদান করে। মিঠুবেন প্যাটেল, ভক্তি বাঈ, মনিবেন প্যাটেল, সারদা মেহতা প্রমুখ নারী বারদৌলি সত্যাগ্রহে যোগ দিয়ে খ্যাতি অর্জন করেন।
আন্দোলনের প্রতিক্রিয়া
গুজরাটের বারদৌলি সত্যাগ্রহ আন্দোলন ক্রমে শক্তিশালী হয়ে উঠলে সরকার আতঙ্কিত হয়। ফলে সরকার কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়, যেমন-
১. তদন্ত কমিশন গঠন
কৃষকদের তীব্র আন্দোলনের চাপে সরকার রাজস্ব বৃদ্ধির বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে। এ কমিশন বারদৌলি রাজস্ব বৃদ্ধির সিদ্ধান্তকে অবিবেচনা প্রসূত ও অন্যায় কাজ বলে ঘোষণা করে।
২. নতুন রাজস্ব নির্ধারণ
রাজস্ব বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত তদন্ত কমিশন বারদৌলিতে ৩০ শতাংশের পরিবর্তে ৬.০৩ শতাংশ রাজস্ব বৃদ্ধি অনুমোদন করে। কৃষকরা গান্ধীজীর পরামর্শে এই নতুন রাজস্ব মেনে নেয়।
৩. কৃষকদের সাফল্য
বারদৌলির কৃষকদের সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সাফল্যের খবর গুজরাট তথা দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। তারা বারদৌলির আন্দোলনে সাফল্যে উৎসাহিত হয় এবং ভবিষ্যতে সরকার বিরোধী আন্দোলনের বিষয়ে মানসিক শক্তি অর্জন করে।
উপসংহার
বিংশ শতকে ব্রিটিশ শোষণের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা কৃষক আন্দোলন গুলির মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ছিল গুজরাটের শোষিত কৃষকদের আন্দোলন। এ আন্দোলনের সর্বপ্রথম গান্ধীজীর মতো সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদী নেতা যুক্ত হন এবং আন্দোলন পরিচালনায় পথ দেখান। অধ্যাপক সুমিত সরকার লিখেছেন যে, “গান্ধীবাদী জাতীয়তাবাদ নিশ্চিতভাবে গুজরাটে কৃষকদের জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু সুবিধা নিয়ে এসেছিল”।