১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে মন্টেগু-চেমসফোর্ড আইন প্রবর্তনের পটভূমি কি ছিল? এই আইনের ত্রুটি বিচ্যুতি লেখো?

সূচনা

১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে মর্লে মিন্টো সংস্কার আইন ভারতীয়দের খুশি করতে পারেনি। পরবর্তী প্রায় এক দশকে ভারতীয় রাজনীতিতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে যায়। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ সরকার ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে মন্টেগু-চেমফোর্ড শাসন সংস্কার নামে নতুন আইন প্রণয়ন করে।

মন্টেগু-চেমফোর্ড আইন প্রবর্তনের পটভূমি

বিভিন্ন বিষয়ের ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার আইন প্রবর্তনের পটভূমি হিসেবে কাজ করেছিল। যেমন-

১. সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ

প্রথমে বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতের ভেতরে এবং বাইরে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারতীয় বিপ্লবীদের সক্রিয়তার সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। বিপ্লবীরা সারা দেশে এক বিপ্লব সংঘটিত করার উদ্যোগ নেয়। এই পরিস্থিতিতে সরকার ভারতীয়দের খুব দমনের উদ্দেশ্যে ভারত-সচিব এডুইন স্যামুয়েল মন্টেগু ও ভাইসরয় লর্ড চেমসফোর্ড একটি যৌথ রিপোর্ট তৈরি করে। এই রিপোর্টের ভিত্তিতে ব্রিটিশ সরকার ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে নতুন ভারত শাসন আইন প্রণয়ন করে। এটি মন্টেগু-চেমসফোর্ড শাসন সংস্কার বা মন্ট-ফোর্ড শাসন নামে পরিচিত।

২. মর্লে মিন্টো আইনের ব্যর্থতা

১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে মর্লে মিন্টো আইনের দ্বারা নির্বাচিত জন প্রতিনিধিদের হাতে বিশেষ করে ক্ষমতা দেওয়া হয়নি বা ভারতে কোন দায়িত্বশীল শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়নি। এইজন্য ভারতীয় ক্ষুব্ধ হয়েছিল।

৩. কংগ্রেসের ঐক্য

কংগ্রেসের নরমপন্থী ও চরমপন্থীদের মধ্যে বিরোধ বাধলে চরমপন্থী 1907 খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। পরে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের লক্ষ্ণৌ অধিবেশনে চরমপন্থী রাবার কংগ্রেসের ফিরে এলে নরমপন্থী ও চরমপন্থির মধ্যে ঐক্য গড়ে ওঠে এবং কংগ্রেসের শক্তি বৃদ্ধি পায়।

৪. লক্ষ্ণৌ চুক্তি

কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নিজেদের বিরোধ দূর করে এবং ভারতের সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ আকর্ষণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়। এই উদ্দেশ্যে তারা লক্ষ্ণৌ চুক্তি ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে স্বাক্ষর করলে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন তীব্র হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। ফলে ব্রিটিশ সরকার আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।

৫. হোমরুল আন্দোলন

১৯১৬ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বাল গঙ্গাধর তিলক ও শ্রীমতি আরমানি বেসান্তের নেতৃত্বে সরকারের বিরুদ্ধে হোমরুল আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। ফলে সরকার নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়।

৬. স্বায়ত্ব শাসন দানের ঘোষণা

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ১৯১৪-১৮ খ্রিস্টাব্দে জয়লাভের জন্য ব্রিটিশ সরকার ভারতীদের সহযোগিতা লাভ, ভারতীয়দের খুশি করে যুদ্ধে এদেশের অর্থ ও জনবলের ব্যবহার প্রকৃতির প্রয়োজনে ভারত-সচিব মন্টেগু ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে ঘোষণা করে যে যুদ্ধের পর ভারতীয়দের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দেয়া হবে।

মন্টেগু-চেমসর্ফোড আইনের ত্রুটি বিচিত্র

১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে প্রবর্তিত মন্টেগু-চেমসর্ফোড আইনের বিভিন্ন ত্রুটি বিচ্যুতি লক্ষ্য করা যায়, যেমন –

১. বড়লাটের একাধিকপত্য

মন্টেগু-চেমসর্ফোড আইনের মাধ্যমে বড়লাট ও তার কার্যনির্ভর সভার হাতে সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়। তিনি আইনসভায় যে কোন প্রস্তাব নাকচ করতে পারতেন। এই আইনের ভারতের কোন প্রতিনিধিত্বমূলক শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়নি।

২. দায়িত্বশীলতার অভাব

এই আইন অনুসারে বড়লাট তার কাজের জন্য ভারতীয় আইনসভার কাছে দায়ী ছিলেন না। তিনি দায়ী ছিলেন ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ও ভারতের সচিবের কাছে। ফলে এই আইনে দ্বারা ভারতে কোন দায়িত্বশীল শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

৩. স্বায়ত্বশাসন অভাব

এই আইনের প্রদেশে স্বায়ত্বশাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলা হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। কেননা প্রদেশের গর্ভনর ছিলেন চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী। তিনি তার মন্ত্রিসভার যে কোন সিদ্ধান্ত নাকচ করতে পারতেন।

৪. আইনসভার ক্ষমতা হ্রাস

এই আইনের দ্বারা কেন্দ্রীয় গর্ভনর জেনারেল এবং প্রদেশে গর্ভনরের চূড়ান্ত আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে কেন্দ্র ও প্রদেশে নির্বাচিত আইনসভা কার্যত্ব ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে।

৫. ভোটাধিকার

মন্টেগু-চেমসর্ফোড আইনের সর্বসাধারণের ভোটাধিকার স্বীকৃতি হয়নি। এর দ্বারা স্বল্প সংখ্যক ধনী ব্যক্তি ভোটাধিকার পান যা ছিল ভারতের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১০%।

৬. সাম্প্রদায়িকতা

এই আইনের দ্বারা ভারতের সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ আরও বৃদ্ধি করা হয়। মুসলিমদের পাশাপাশি ভারতের সাংবিধানিক সরকারেরও বিষয়ে বিভিন্ন আলাপ আলোচনা চালায়।

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বইয়ের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর

Leave a Comment