সুয়েজখালে : হাঙ্গর শিকার রচনা অবলম্বনে বাঘা নামের প্রথম হাঙরটির বর্ণনা দিয়ে জানাও যে কীভাবে তাকে শিকারের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল?
স্বামী বিবেকানন্দের সুয়েজখালে হাঙ্গর শিকার রচনায় সুয়েজ বন্দরে দাঁড়িয়ে থাকা জাহাজের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাদের বারান্দায় প্রায় মিনিট পয়তাল্লিশ অপেক্ষার পর, চারপাশের উত্তেজিত চিৎকার শুনে লেখক চেয়ে দেখেন যে, জাহাজ থেকে প্রায় দুশাে হাত দূরে মশকের মতাে বিরাট বড়াে আকারের একটি হাঙর পাঁচ সাত ইঞ্চি জলের নীচে থেকে জাহাজের দিকেই ভেসে আসছে।
জাহাজের দ্বিতীয় শ্রেণির এক ফৌজি যাত্রীর জোগাড় করা বড়শিতে সেরখানেক শুয়ােরের মাংস গেঁথে, ভালাে করে দড়ি দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়। তারপর দড়ি দিয়ে বাঁধা, ফাতনা-সমেত বড়শিটা জলে ফেলে দেওয়া হয় একদিকটা ধরে রেখে। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর দেখা যায়, শুয়োরের মাংসের লােভে বাঘা হাঙর পালতােলা নৌকোর মতা ধা করে সামনে এসে দু বার টোপ না গিলে ল্যাজ নাড়িয়ে, শরীর ঘুরিয়ে দূরে চলে যায়। তৃতীয়বার ঘুরে এসে সে টোপটা মুখে নেয় এবং তারপর চিৎ হয়ে পড়ে যায়। টোপ খেয়েছে ভেবে চল্লিশ-পঞ্চাশ জন লােক দড়ি ধরে প্রাণপণে টানতে শুরু করে। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। যাত্রীরা তাড়াহুড়ােয় হাঙরটিকে টোপ উদরস্থ করার পর্যাপ্ত সময় না দেওয়ায় একসময় ওই হাঙরের মুখ থেকে টোপ খুলে যায়। বাঘা নামের হাঙরটা তাই তক্ষুনি পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল।
থ্যাবড়া নামের হাঙরটিকে কীভাবে শিকার করা হয়েছিল তার বিস্তৃত বিবরণ দাও
স্বামী বিবেকানন্দের সুয়েজখালে : হাঙ্গর শিকার রচনায় ‘বাঘা হাঙর পালিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আর-একটি হাঙর টোপের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে, লেখক যার নাম দেন থ্যাবড়া।
থ্যাবড়া খানিকক্ষণ বড়শির ধারে কাছে ঘুরপাক খাওয়ার পর টোপটা মুখে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে। এরপর চিৎ হয়ে শুয়ে আড়াআড়িভাবে টোপটা গিলে যেই চলে যেতে উদ্যত হয়- অমনি সবাই-মিলে টান দেয় কাছিতে। অবাক হয়ে থ্যাবড়া মুখ- ঝাড়া দিয়ে টোপটাকে ঝেড়ে ফেলতে চাইলে বড়শিটা পুরােপুরি তার শরীরের মধ্যে গেঁথে যায়। এরপর সবাই মিলে প্রাণপণে কাছি ধরে টানতে থাকলে ক্রমশ থ্যাবড়ার মাথাটা এবং অর্ধেক শরীর জলের ওপর দেখা যায়। টানাটানির ফলে বড়শিতে আরও বিদ্ধ হয় থ্যাবড়া, তার ঠোট এফেঁড়-ওফোঁড় হয়ে গেল। এসব দেখে এক যাত্রী, পাহারাদার জল-পুলিশকে অনুরােধ করেন সাবধানে হাঙরটির ল্যাজের দিকে একটা দড়ি বেঁধে দিতে। নইলে মাত্র একটা দড়ি দিয়ে এতবড়াে একটা জন্তুকে টেনে তােলা মুশকিল হবে। এরপর টানা শুরু হলে দেখা যায় যে, হাঙরটির পেটের নীচে ঝুলছে তার নাড়ি-ভুঁড়ি, যা টানাটানির চোটে পেটের বাইরে বেরিয়ে এসেছে। একজন যাত্রীর কথামতাে ওগুলি কেটে দেওয়া হলে হাঙরের ওজন অনেকটাই কমে যায়, কিন্তু রক্তের স্রোত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তারপর সবার সাহায্যে থ্যাবড়া হাঙরটিকে টেনে জাহাজে তােলা হয়।
সুয়েজখালে : হাঙ্গর শিকার রচনায় লেখক যে বনিটো মাছের কথা উল্লেখ করেছেন, রচনা অনুসরণে তার বিস্তৃত বিবরণ দাও।
‘সুয়েজখালে : হাঙ্গর শিকার রচনাটিতে লেখক স্বামী বিবেকানন্দ যেসব মাছের উল্লেখ ও বর্ণনা করেছেন, তার মধ্যে বনিটো মাছ উল্লেখযােগ্য।
জাহাজের কাছে একটি হাঙর এসে উপস্থিত হয়েছে একথা শুনে লেখক জাহাজের পেছনদিকে দ্বিতীয় শ্রেণির ছাদের বারান্দায় রেলিং ধরে সামনে ঝুঁকে মুখ বাড়িয়ে হাঙর দেখতে চেষ্টা করেন এবং প্রাথমিকভাবে ব্যর্থ হন। ঠিক ওই সময়েই হাঙরের পরিবর্তে তিনি দেখতে পান যে, অনেকটা গাঙ্ধাড়া মাছের মতাে দেখতে একপ্রকার মাছ দলে দলে ভেসে বেড়াচ্ছে। আর একপ্রকার খুব ছােটো আকারের মাছ সেই জলে গিজগিজ করছে। এই দুইরকম মাছ ছাড়া একটি বড়াে মাছ, তিরের মতাে দ্রুতগতিতে এদিক-ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। ইলিশ মাছের মতাে দেখতে দ্রুতগামী ওই মাছটিকে প্রাবন্ধিক প্রথমে হাঙরের বাচ্চা বলে মনে করলেও পরে সহযাত্রীদের কাছ থেকে জানতে পারেন যে, ওই মাছটির প্রকৃত নাম বনিটো। এই প্রসঙ্গে লেখকের মনে পড়ে যায়, পূর্বেই তিনি পড়েছিলেন যে, বনিটো মাছের মাংস খুব সুস্বাদু এবং লাল রঙের। মালদ্বীপ থেকে এই মাছটি শুটকিরূপে বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়। এত বড়াে মাছটা যখন তিরবেগে জলের ভিতর ছুটে বেড়াচ্ছিল, তখন তার প্রতিটি দেহ ভঙ্গিই লেখক স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলেন সুয়েজের স্বচ্ছ জলের মধ্য দিয়ে। প্রাবন্ধিক একটানা প্রায় আধ ঘণ্টার মতাে এই বনিটো মাছের ছুটোছুটি লক্ষ করেছিলেন।
সুয়েজখালে : হাঙ্গর শিকার রচনায় হাঙরের পাশে থাকা ছােটো মাছ ও হাঙর-চোষক মাছের বিস্তৃত বিবরণ দাও।
সুয়েজখালে : হাঙ্গর শিকার রচনায় একটি হাঙর জাহাজের কাছে এলে লেখক বিবেকানন্দ দেখতে পান যে, তার আগে আগে কয়েকটা ছােটো মাছ এগিয়ে চলেছে। এদের মধ্যে আড়কাটী মাছ বা পাইলট ফিশ হাঙরকে শিকার দেখিয়ে দেয় এবং হাঙরের উচ্ছিষ্ট পায়। লেখক আরও দেখলেন যে, কতকগুলি অন্যজাতীয় ছােটো মাছ হাঙরের পিঠে, পেটে এবং অন্যান্য জায়গায় খেলে বেড়াচ্ছে। এদের দু-একটি আবার হাঙরের ঘাড়ে চেপে বসেছে। যে-মাছগুলি হাঙরের আশেপাশে এবং তার গায়ে, পিঠে চড়ে সাঁতরাচ্ছে, তাদের নাম হাঙর-চোষক (Shark-Sucker)। মাছটির পিঠের পাখনার সামনের অংশটায় অর্থাৎ বুকের দিকটায় চার ইঞ্চি লম্বা ও দুই ইঞ্চি চওড়া একটি চ্যাপটা আকৃতির গােলাকার চোষক অঙ্গ আছে। জুতাের নীচের অংশের মতাে খাঁজ-কাটা, খরখরে অংশবিশিষ্ট এই চোষক- অঙ্গের সাহায্যেই এই মাছ হাঙরের গায়ে চুম্বকের মতাে আটকে থেকে চলে-ফিরে বেড়ায়। হাঙরের গায়ে লেগে থাকা পােকা- মাকড় খেয়েই এই মাছেরা বেঁচে থাকে। আড়কাটী ও হাঙর- চোষক—এই দুইপ্রকার সহায়ক-পার্শ্বচর মাছ দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়েই হাঙর চলাফেরা করে। ‘সুয়েজখালে : হাঙ্গর শিকার রচনায় লেখক স্বামী বিবেকানন্দ বনিটো মাছ ছাড়া এই দুটি সামুদ্রিক মাছেরও বর্ণনা করেছেন।