সার্জেন্ট পরিকল্পনায় ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন দিক
সার্জেন্ট পরিকল্পনার নতুন কোনাে শিক্ষাদর্শ বা শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের সুপারিশ করা হয়নি। তবে এই পরিকল্পনাটি ছিল ভারতের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন অংশের মৌলিক উপাদানগুলির যৌগিক সমবায়। এই পরিকল্পনায় শিক্ষার বিভিন্ন স্তর ও বিভিন্ন দিকের কথা বিবেচনা করা হয়েছে এবং বারোটি অধ্যায়ের পর্যায়ক্রমে সেগুলিকে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার যে প্রধান দিকগুলি (aspects) এই পরিকল্পনায় স্থান পেয়েছে, সেগুলি হল—
- প্রাথমিক শিক্ষা,
- প্রাথমিক শিক্ষা,
- মাধ্যমিক শিক্ষা,
- উচ্চশিক্ষা,
- কারিগরি শিক্ষা,
- বয়ঙ্ক শিক্ষা,
- শিক্ষক-শিক্ষপ,
- শারীরশিক্ষা ও স্বাস্থ্য শিক্ষা,
- প্রতিবন্ধীদের জন্য শিক্ষা,
- কর্মসংস্থান ব্যবস্থা,
- সহপাঠক্রমিক কার্যাবলির ব্যবস্থা এবং
- শিক্ষা প্রশাসন।
সার্জেন্ট পরিকল্পনায় উল্লিখিত মাধ্যমিক শিক্ষা-সম্পর্কিত সুপারিশ
মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পর্কে সার্জেন্ট পরিকল্পনায় যে সুপারিশগুলি করা হয়েছে, সেগুলি হল—
(১) স্বয়ংসম্পূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা গঠন: মাধ্যমিক শিক্ষা হবে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ শিক্ষা। বেশিরভাগ শিক্ষার্থী যাতে সরাসরি কর্মোপযােগিতা লাভ করতে পারে, তাই হবে এই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য।
(২) উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার প্রচলন: 11 থেকে 17 বছর বয়স পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার ব্যবস্থা থাকবে।
(৩) উচ্চমাধ্যমিক স্তরে ভর্তির নিয়ম নির্ধারণ: যেসব শিক্ষার্থী সাধারণ শিক্ষার্থীদের তুলনায় পড়াশােনায় ভালাে, তারাই উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সুযােগ পাবে।
(৪) উচ্চমাধ্যমিক স্তরে ছাত্রসংখ্যা নির্ধারণ: নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভরতির সুযোগ পাবে শতকরা কুড়ি জন।
(৫) মেধাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের উচ্চমাধ্যমিক স্তরে ভর্তির সুযােগ: বুনিয়াদি বিদ্যালয়ের উচ্চমেধার শিক্ষার্থীরা যাতে উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভরতির সুযোগ পায়, তার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
(৬) শিক্ষার্থীদের বেতন নির্ধারণ: মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পঠনপাঠনের জন্য শিক্ষার্থীদের বেতন দিতে হবে। বেতন হার অবশ্যই শিক্ষার্থীদের সামর্থ্যের মধ্যে হতে হবে। দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিটি বিদ্যালয়ে পঞ্চাশ শতাংশ আসন অবৈতনিক শিক্ষার জন্য সংরক্ষিত রাখতে হবে।
(৭) অ্যাকাডেমিক ও টেকনিক্যাল বিদ্যালয় স্থাপন: মাধ্যমিক স্তরে দুই ধরনের বিদ্যালয় থাকবে। এগুলি হল-অ্যাকাডেমিক বিদ্যালয় এবং টেকনিক্যাল বিদ্যালয়। অ্যাকাডেমিক বিদ্যালয়ে বিশুদ্ধ কলা ও বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যবস্থা থাকবে এবং টেকনিক্যাল বিদ্যালয়ে ফলিত বিজ্ঞান (Applied Sciences), শিল্প ও বাণিজ্য শিক্ষার ব্যবস্থা থাকবে।
(৮) পাঠক্রমে বৈচিত্র আনয়ন: উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠক্রম হবে বৈচিত্র্যময়। অ্যাকাডেমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষণীয় বিষয় হিসেবে থাকবে মাতৃভাষা, ইংরেজি এবং অন্য যে-কোনাে একটি আধুনিক ভাষা, ভূগােল, ইতিহাস, গণিত, বিজ্ঞান, অর্থনীতি, পৌরবিজ্ঞান, কৃষি, চারুশিল্প, সংগীত, শারীরশিক্ষা, প্রাচীন ভাষা ইত্যাদি। এই বিষয়গুলির মধ্য থেকে শিক্ষার্থী তার পছন্দমতাে বিষয় নির্বাচন করতে পারবে। কোনাে শিক্ষার্থীকে সব বিষয় পড়তে হবে না। অন্যদিকে, টেকনিক্যাল বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিষয়সমূহের ওপর অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। ধাতুর কাজ, কাঠের কাজ, প্রাথমিক ইঞ্জিনিয়ারিং প্রভৃতির পঠনপাঠনের ব্যবস্থা করতে হবে। বাণিজ্যিক বিষয়ের মধ্যে বুক কিপিং, টাইপিং, শর্টহ্যান্ড ইত্যাদি শেখানাের ব্যবস্থা রাখতে হবে। বালিকাদের জন্য গার্হস্থ্য বিজ্ঞান বিকল্প বিষয় হিসেবে অনুশীলনের ব্যবস্থা থাকবে।
(৯) বৃত্তিদানের ব্যবস্থা: দরিদ্র ও উচ্চ মেধাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তিদানের ব্যবস্থা করতে হবে।
(১০) মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা: শিক্ষার মাধ্যম হবে শিক্ষার্থীর মাতৃভাষা। তবে সকল শিক্ষার্থীকে আবশ্যিক দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ‘ইংরেজি পড়তে হবে।
সার্জেন্ট পরিকল্পনায় উল্লিখিত উচ্চশিক্ষা-সম্পর্কিত সুপারিশ
সার্জেন্ট পরিকল্পনায় উচ্চশিক্ষা সম্পর্কে নিম্নলিখিত সুপারিশগুলি করা হয়েছে—
(১) ভর্তি-সংক্রান্ত কঠোর নিয়ম প্রবর্তন: বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে শিক্ষার মানােন্নয়নের জন্য মহাবিদ্যালয়গুলিতে ভরতির ব্যাপারে কঠোর নিয়মকানুন প্রবর্তন করতে হবে। উন্নত মেধাসম্পন্ন শিক্ষার্থীরাই কেবলমাত্র উচ্চশিক্ষার সুযােগ লাভ করবে। উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা শেষ করার পর দশ থেকে পনেরাে শতাংশ যােগ্য শিক্ষার্থী যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভরতি হতে পারে, তার জন্য প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
(২) ইন্টারমিডিয়েট স্তরের অবসান: ইন্টারমিডিয়েট স্তরের শিক্ষার অবসান ঘটাতে হবে। ওই স্তরের দুই বছরের শিক্ষাকালের এক বছর উচ্চমাধ্যমিক স্তরের সঙ্গে যুক্ত করার ব্যবস্থা করতে হবে।
(৩) তিন বছর ব্যাপী ডিগ্রি কোর্স প্রবর্তন: ডিগ্রি কোর্সের মেয়াদ হবে ন্যূনতম তিন বছর। প্রয়ােজনে এর মেয়াদ আরও বাড়ানাে যেতে পারে।
(৪) দরিদ্র, মেধাবী শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা: উচ্চ মেধাসম্পন্ন দরিদ্র শিক্ষার্থীরা যাতে আর্থিক কারণে উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত না হয়, তার জন্য প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
(৫) টিউটোরিয়াল ব্যবস্থার উন্নয়ন: শিক্ষার্থী এবং অধ্যাপক অধ্যাপিকাদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে তােলার জন্য এবং শিক্ষাদানের কাজকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক করার জন্য টিউটোরিয়াল ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হবে।
(৬) উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার মানােন্নয়ন: স্নাতকোত্তর শিক্ষা ও গবেষণার মান উন্নয়নের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
(৭) অধ্যাপকদের বেতন বৃদ্ধি ও সুবিধা প্রদান: যােগ্যব্যক্তিরা যাতে অধ্যাপনা পেশায় যুক্ত হন, তার জন্য অধ্যাপকদের বেতন বৃদ্ধি করতে হবে ও চাকুরির ক্ষেত্রে অন্যান্য সুযােগসুবিধাও দিতে হবে।
(৮) শিক্ষাক্ষেত্রে সর্বভারতীয় সংস্থা গঠন: দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানের মধ্যে সমতা বজায় রাখার উদ্দেশ্যে এবং তাদের বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যে সমন্বয় সাধন করার জন্য ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি গ্রান্টস্ কমিটির অনুকরণে একটি সর্বভারতীয় সংস্থা গঠনের জন্য প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
(৯) পরীক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন: বিশ্ববিদ্যালয়গুলি যাতে সমাজের চাহিদার প্রতি নজর রাখে এবং পরীক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটায়, সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে।