সাম্রাজ্যবাদের সংজ্ঞা
১. সাধারণ ধারণা
সাম্রাজ্যবাদের সংজ্ঞা নিয়ে নানান মত রয়েছে। প্রথম দিকে এর অর্থ ছিল সামারি কর্তৃত্ব। পরবর্তীকালে বলা হয় একটি দেশে নিজের স্বার্থ অন্য দেশে স্বাধীনতা ও সর্বভৌমত্ব বিনাশ বা সংকোচিত করে সেই দেশ ও জাতির উপরে যে প্রভূত্ব বা কর্তৃত্ব স্থাপনের চেষ্টা করে তাহলে সাম্রাজ্যবাদ।
২. সংজ্ঞা সম্পর্কিত নানা মত
(১) লেনিনের মত : ভি. আই. লেনিন তার ‘Imperialism, the Highest Stage of Capitalism’ গ্রন্থে লিখেছেন- ‘সাম্রাজ্যবাদ হল পুঁজিবাদের একচেটিয়া পর্যায়’।
(২) মর্গ্যানথাউ এর মত : অধ্যাপক হান্স মর্গ্যানথাউ এর ধারণা নিজে এলাকার বাইরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সম্প্রসারণই হলো সাম্রাজ্যবাদ।
(৪) পামারও পার্কিসনের মত : তামার ও পারকিশনের মতে সাম্রাজ্যবাদ হল এমন একটি সম্পর্ক যার মধ্যে কোন এলাকা বা তার জনগণ অন্য এলাকা বা অন্য সরকারের অধীনে হয়।
(৫) বনের মত : জুয়েলার্স বনের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদ হল সাম্রাজ্য স্থাপন, সংগঠন ও রক্ষণাবেক্ষণের এমন একটি নীতি যার দ্বারা একটি দেশ অন্য দেশকে অধীনস্থ করে।
(৬) সি. ডি. বার্নাস-এর মত : ) সি. ডি. বার্নাস বলেছেন সাম্রাজ্যবাদ হল বিভিন্ন দেশ ও জাতির উপরে চাপিয়ে দেওয়া এক ধরনের আইন ও শাসন ব্যবস্থা।
(৭) সুম্যান- এর মত : সুম্যান- এর মতে, বল প্রয়োগ ও হিংসার সাহায্যে কোন দেশের ওপর বৈদেশিক শাসন চাপিয়ে দেওয়াকে সাম্রাজ্যবাদ বলে।
(৮) হিলফারডিঙ্গ-এর মত : হিলফারডিঙ্গ সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক সংজ্ঞা উপস্থাপন করে বলেন যে, সাম্রাজ্যবাদ হল একচেটিয়া পুজের স্বার্থ রক্ষাকারী ব্যবস্থা।
(৯) কার্ল কাউৎস্কির মত : কার্ল কাউৎস্কির মতে, সাম্রাজ্যবাদ হলো অতি উন্নত পর্যায়ের শিল্পন্নত পুঁজিবাদের ফল।
(১০) হজের মত : চার্লস হজ তার ‘The Background of International Relation’ গ্রন্থে বলেছেন-সাম্রাজ্যবাদ বলতে অন্য দেশের স্বাধীনতার ওপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ কে বোঝায়।
(১১) ওয়েলসের মত : এইচ. জি. ওয়েলসের মতে, সাম্রাজ্যবাদ হলো এক সচেতন জাতীয় রাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টা।
(১২) বেয়ার্ড-এর মত : চার্লস বেয়ার্ড এর মতে, সাম্রাজ্যবাদ হলো কোন একটি রাষ্ট্র কর্তৃক অপরাষ্ট্রের ভূখণ্ড দখল এবং তার ওপর নিজের প্রভাব প্রতিষ্ঠা।
সাম্রাজ্যবাদের বিভিন্ন রূপ
সাম্রাজ্যবাদের বিভিন্ন রোগ থাকলেও তিনটি রূপকেই মূলত স্বীকৃতি জানানো হয়। এগুলি হল -সামরিক সাম্রাজ্যবাদ, অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ ও সংস্কৃতি সাম্রাজ্যবাদ।
১. সামরিক সাম্রাজ্যবাদ
সাম্রাজ্যবাদের একটি প্রধান রূপ হল এর সামরিক রাজনৈতিক দিক। আলেকজান্ডার, নেপোলিয়ন, হিটলারের মতো সমর বিজেতা গন সামরিক বিজয়ের মধ্যে দিয়ে অপর রাজ্য দখল করেছেন। তাদের এই সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকা রক্ত ক্ষীয় যুদ্ধ ঘটেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজ নিজ স্বার্থে অন্য দেশের সঙ্গে জোর বদ্ধ হয়েছে এবং সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করেছে। চোকোশ্লোভাকিয়া অথবা হাঙ্গেরিতে সোভিয়েতের সামরিক হস্তক্ষেপের পর অথবা নিকারাগুয়াতে বিদ্রোহীদের মার্কিন তরফ সামরিক অস্ত্র যোগানে এর মধ্যে সামরিক সাম্রাজ্যবাদ পরিচয় মিলে। অধ্যাপক ডেবিট টমসনের মধ্যে, সাম্রাজ্যবাদের ফলে যুদ্ধ শুরু হয়, এক কথায় অর্থ সত্য আবার এক কথায় সত্য যে, যুদ্ধের ভীতি থেকে সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভব ঘটে।
২. অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ
সামরিক সাম্রাজ্যবাদ ছাড়াও অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ। বাণিজ্যিক স্বাস্থ্য রক্ষা তাগিদেই মূলত এটির উদ্ভব। ইউরোপ শিল্প বিপ্লবের পরবর্তী পর্যায়ে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, বেলজিয়াম ইত্যাদি দেশের শিল্পপতিগণ সাম্রাজ্যবাদকে ত্বরান্বিত করেন। পুঁজি পতিদের উদ্ভব, কাঁচামাল সংগ্রহ, উৎপাদিত শিল্প পণ্য বিক্রি এবং উদ্বৃত্ত মূলধন বিনিয়োগের জন্য সাম্রাজ্যবাদের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। পরবর্তী সময়ের ব্যক্তিগত উদ্যোগের পাশাপাশি বণিক কোম্পানিগুলো উদ্যোগ এবং রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ করুন সাম্রাজ্যবাদের বিস্তার ঘটে। দেখা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থের লক্ষ্যে লাতিন আমেরিকার উপর শোষণ চালায়। তৈল সম্পদের লোভে ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মতো দেশগুলি আরব বিশ্বের ওপর প্রভুত্ব কায়েম করে।
৩. সংস্কৃতি সাম্রাজ্যবাদ
সাম্রাজ্যবাদের আরো একটি রূপ হল সংস্কৃতি সাম্রাজ্যবাদ। সামরিক বা অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যকে এড়িয়ে অন্য দেশের সংস্কৃতি ঐতিহ্য, অধিবাসী রুচিবোধ, মনন শীলতা, পছন্দ-অপছন্দের দিকগুলি কে নিয়ন্ত্রণ করার প্রচেষ্টা হলো সংস্কৃতি সাম্রাজ্যবাদ। সংস্কৃতি সাম্রাজ্যবাদের মূল উদ্দেশ্য সংস্কৃতির ভাব বিনিময়ের মধ্যে দিয়ে নিজে নিজে দেশের সংস্কৃতির প্রসারণ ঘটানো। অনেক সময় সামরিক সাম্রাজ্যবাদ ও অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ কায়েম করার লক্ষ্যে সংস্কৃতি সাম্রাজ্যকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সংস্কৃতি ধ্যানধারণায় প্রচারের নামে রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রসারেরও চেষ্টা চালানো হয়, যেমন পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ব ইউরোপের দেশ গুলিতে কমিউনিস্ট নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে সংস্কৃতি সাম্রাজ্যবাদের প্রসারে ঘটানোর চেষ্টা চালিয়েছিল। মূলত ১৯৫০ দশকের থেকেই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সংস্কৃতিতে সাম্রাজ্যবাদের প্রভাব বাড়তে থাকে।