সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতি কি এবং এই নীতির প্রবর্তনের প্রেক্ষাপট মূল নীতিগুলির উল্লেখ করো? এই নীতির কি প্রক্রিয়া হয়েছিল?

সম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতি

ব্রিটিশ সরকার ভারতের তাদের শাসন ও নিরাপদ ও দীর্ঘস্থায়ী করার উদ্দেশ্যে হিন্দু মুসলিম সহ বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি চেষ্টা চালায়। এজন্য সরকার ভারতে বিভাজন ও শাসন নীতি অনুসরণ করে। সরকারের বিভাজন ও শাসন নীতিকে কার্যকরী করতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী রামেস ম্যাকডোনাল্ড ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে আগস্ট মাসে বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক নির্বাচনের কথা ঘোষণা করেন। তার এই নীতি সম্প্রদায়িক বাটোয়ারা নামে পরিচিত।

প্রেক্ষাপট

১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হওয়ার আগে রাজনীতি দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে উভয় সম্প্রদায়ের বিভেদ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। গান্ধীজী নেতৃত্বে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হলে খিলাফৎ আন্দোলনে দুজন অগ্রণী নেতা এবং এক সময়কার একান্ত অনুগামী বলে পরিচিত মোহাম্মদ আলী ও সৌকত আলী আইন অমান্য আন্দোলনে থেকে দূরে থাকেন। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে বোম্বাই অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় মুসলিম সম্মেলনের মোহাম্মদ আলী ঘোষণা করেন যে, কংগ্রেসের আন্দোলনে আসলে হিন্দুদের আন্দোলন এবং গান্ধীজীর আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য হলো মুসলিম সম্প্রদায়কে হিন্দু মহাসভার উপর নির্ভরশীল করে তোলে। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ সরকার ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ আগস্ট সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতি ঘোষণা করে। এই নীতি ঘোষিত হওয়ার প্রেক্ষাপট নিচে আলোচনা করা হলো-

১. আইন অমান্য আন্দোলন

মহাত্মা গান্ধী নেতৃত্বে জাতীয় কংগ্রেস 1930 খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করে। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, ডক্টর আনসারী প্রমুখ জাতীয়তাবাদী মুসলিম নেতার প্রবাল উৎসাহে আইন অমান্য আন্দোলনে যোগদান করলে হিন্দু মুসলিম ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে সরকার বিপদে পড়ে যায়। সরকার বাধ্য হয়ে ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকারের উদ্যোগে লন্ডনে পরপর তিনটি গোল টেবিল বৈঠকের আয়োজন করে।

২. প্রথম গোলটেবিল বৈঠক

লন্ডনে অনুষ্ঠিত প্রথমবার গোল টেবিল বৈঠক ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে কংগ্রেস ছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলি যোগদান করে। বৈঠকে উপস্থিত জিন্না, আগা খাঁ, মোহাম্মদ শফি, মোহাম্মদ আলী, ফজলুল হক প্রমো মুসলিম লীগ নেতারা সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে পৃথক নির্বাচনে দাবি জানান। তারা সরকারকে জানিয়ে দেয় যে মুসলিমদের স্বার্থ সুরক্ষিত না হলে কোন সংবিধানই মানা হবে না।

৩. দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠক

১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে সেপ্টেম্বর মাসে লন্ডনে দ্বিতীয় গোল টেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে কংগ্রেস যোগ দিলেও সরকারি প্ররোচনায় মুসলিম লীগ ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিজেদেরকে সাম্প্রদায়িক স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে অযৌক্তিক সীমাহীন দাবি জানান। ফলে এই বৈঠক শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয় এবং গান্ধীজীর শূন্য হাতে ফিরে আসেন।

৪. তৃতীয় গোলটেবিল বৈঠক

১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনের তৃতীয় গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে কংগ্রেস জোক না দিয়ে আইন অমান্য আন্দোলনে তীব্রভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সরকার এরূপ তীব্র আন্দোলন সম্প্রদায়িক ফাটল ধরানোর চেষ্টা চালায়। জাতীয় আন্দোলনকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে সরকার ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতি ঘোষণা করে।

মূলনীতি

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী রমেশ ম্যাকডোনাল্ড কর্তৃক সম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতির দ্বারা –

(১) মুসলিম, শিখ, বৌদ্ধ, ভারতীয় খ্রিষ্টান, ইঙ্গ ভারতীয়, ইউরোপীয় প্রকৃতি বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে পৃথক নির্বাচনী অধিকার দেয়া হয়। অর্থাৎ এই নীতির দ্বারা মুসলিমদের জন্য সুরক্ষিত আসন শুধু মুসলিমরা বা শিখদের জন্য সুরক্ষিত আসনে শুধু শিখরা নির্বাচিত হওয়ার অধিকার পাবে।

(২) হিন্দু সম্প্রদায়কে বর্ণহিন্দু, নিম্ন বর্ণের হিন্দু বা দলিত, অস্পৃশ্য হিন্দু প্রভৃতি আগে বিভক্ত তাদের জন্য পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থা করা হয়।

(৩) কোন কোন নির্বাচন কেন্দ্রে শুধু অস্পৃশ্য সম্প্রদায় কে ভোট দানের অধিকার দেয়া হয়।

প্রতিক্রিয়া

সরকার কর্তৃক সম্প্রদায়িক বাটোয়ারা নীতি ঘোষিত হলে ভারতীয় রাজনীতিতে এর তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, যেমন –

১. সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জয়

সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতির মাধ্যমে মুসলিম লীগের যাবতীয় সাম্প্রদায়িক দাবি দাওয়া মেনে নেওয়া যায়। শুধু বাকি থাকে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। ফলে আপাত মুসলিম সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ব্যাপক জয় ঘোষিত হয় এবং লীগের মানসিক শক্তি যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। অবশ্য জাতীয়তাবাদী মুসলিম নেতারা সরকারের সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারা নীতি সমর্থন করেননি।

২.গান্ধীজীর অনশন অনশন

জাতীয় কংগ্রেস সম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতি তীব্র বিরোধিতা করে। গান্ধীজী সরকারের এ নীতির প্রতিবাদে কুড়ি সেপ্টেম্বর জার্বেদা জেলে আমারও না অনশন করলে তার জীবন রক্ষার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেস নেতারা আইন অমান্য আন্দোলন পরিচালনার গুরুত্ব না দিয়ে দলিত সম্প্রদায় নেতা ড. বি. আর. আম্বেদকর এর সঙ্গে আলোচনা বেশি গুরুত্ব দেন।

৩. পুনা চুক্তি

সরকারের সম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতি ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে দলিত নেতা ড. বি. আর. আম্বেদকর গান্ধীজীর মধ্যে আলোচনার উপর উভয়ের মধ্যে পুনা চুক্তি চব্বিশ সেপ্টেম্বর ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির দ্বারা-

(১) আম্বেদকরের দলিত হিন্দুদের পৃথক নির্বাচনের দাবি ত্যাগ করেন ও হিন্দুদের যৌথ নির্বাচনে নীতি মেনে নেওয়া হয়।

(২) সাম্প্রদায়িক বাটোয়ার মাধ্যমে তাপশিলি সম্প্রদায় যতগুলি আসন পেত তার দ্বিগুণ আসন তাদের জন্য সংরক্ষিত হয়।

(৩) গান্ধীজীর ২৬ সেপ্টেম্বর এর অনশন ভঙ্গ করেন।

৪. পৃথক পাকিস্তানের দাবি

সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারা নীতি ঘোষণা করার পর লীগের পৃথক পাকিস্তানের দাবি আরো জোরালো হয়। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে চৌধুরী রহমৎ আলীও তার অনুগামীরা এখন অথবা কখনো না শীর্ষক চারপাতার এক পুষ্টিকায় ভারতীয় মুসলিম অধ্যুষিত পাঁচটি প্রদেশ- পাঞ্জাব, আফগান প্রদেশ বা উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, কাশ্মীর, সিন্ধু এবং বেলুচিস্থতান দিয়ে পৃথক পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের দাবি জানান। কিছুকাল পরে তিনি পাকিস্তান জাতীয় আন্দোলন শুরু করেন এবং প্রস্তাবিত পাকিস্তান ভূখণ্ডের কয়েকটি প্রচার কেন্দ্র স্থাপন করেন।। কিছুকাল পর 1940 খ্রিস্টাব্দে লিগের লাহোর অধিবেশনে পৃথক পাকিস্তানের দাবি জানানো হয়।

উপসংহার

ব্রিটিশ সরকারি সম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতির ভারতের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক বিভেদ বহুগুণ বৃদ্ধি করে। হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রতি সম্ভাবনা ক্রমে দূরে সরে যায়। এই চূড়ান্ত প্রকাশ লক্ষ্য করা যায় ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে লিগের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম ঘোষণা, কলকাতা, নোয়াখালী, ত্রিপুরা, বিহার সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মধ্যে। সাম্প্রদায়িক বিভেদের কারণে ভারতের বিভাজন অনস্বীকার্য হয়ে পড়ে।

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বইয়ের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর

Leave a Comment