লোককথার সংজ্ঞা
লোক কথার প্রকৃত সংজ্ঞা নিয়ে সাহিত্যিক, ঐতিহাসিক ও গবেষকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। সাধারণভাবে বলা হয় লোক কথা হলো এক ধরনের কাল্পনিক গল্পকথা যেগুলি অতীত বা ঐতিহাসিক ঘটনার অনুকরণে গড়ে ওঠে। লোক কথায় ঐতিহ্যবাহী লৌকিক সাহিত্যের প্রতিফলন ঘটে যার দ্বারা প্রাকৃতিক বা আধ্যাত্মিক ঘটনাবলী ব্যাখ্যা দান করা হয়। কোন কালে বা কোন মানবসমাজে এই উদ্ভব ঘটেছিল তা জানা যায়। শুভ্রাচি নদীর থেকেই লোকের মুখে মুখে বংশ পরম্পরায়, লোকো কথাগুলি প্রচার হয়ে আসছে। অনুমান করা হয় সভ্যতার ইতিহাসে গোষ্ঠী জীবন শুরু হওয়ার পর থেকেই লোকসমাজে লোককথা সৃষ্টি হয়। কার্ল টম টমলিনসন ও ক্যারল লিঞ্চ-ব্রাউন-এর মতে, “মানুষের জীবন ও কল্পনার সংমিশ্রণে যেসব গল্পকথা গড়ে উঠেছে” সেগুলি হল লোককথা।
লোককথা বৈশিষ্ট্য
লোক কথা বৈশিষ্ট্য গুলি নিম্নরূপ-
(১) লোক ঐতিহ্য
লোক কথার মূল বৈশিষ্ট্য হল এর ঐতিহ্য। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের লোক ঐতিহ্য গুলি এতে স্থান পায়। ‘আরব্য রজনী’, ‘ঈশপের নীতিকথা’, ‘কথাসরিৎ সাগর’, ‘বৃহৎ কথা মঞ্জুরী’, ‘পঞ্চতন্ত্র’, ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’, ‘বত্রিশ সিংহাসন’, ‘লুসিয়াস অ্যাপুলিয়াসের লোককথা সংগ্রহ’, ‘জাঁ দ্য ফঁতেন -এর নীতিকথা’ প্রভৃতি লোক কথার উপকৃষ্ট উদাহরণ।
(২) ঘটনার প্রাধান্য
লোক কথাগুলিতে ঘটনা বা বিষয়বস্তুর প্রধান লক্ষ্য করা যায়। ঘটনা বিন্যাসে দুই ধরনের প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়, একটি হলো ঘটনার সূচনা, সমস্যা, চরম মুহূর্ত, শংকর থেকে উত্তরণ এবং সর্বশেষ মিলানান্তক পরিণতি। আর দ্বিতীয়টি হল কাহিনীর মূল চরিত্রের গৃহত্যাগ, বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জন এবং সর্বশেষ নিজের এলাকায় প্রাত্যাবর্তন। লোক কথা বলিতে এই দুই ধরনের বিষয়বস্তু মেলবন্ধন ঘটে থাকে।
(৩) মানুষের আলোচনা
লোক কথাগুলির কেন্দ্রীয় চরিত্র মানুষ। সাধারণ মানুষের প্রতিদিনকার জীবন কাহিনী লোককথার আলোচিত হয়। মানুষের প্রত্যহিক জীবনে ছোট ছোট ঘটনাগুলি এতে স্থান পায়। মানবিক কর্মকাণ্ড ঘিরে লোককথার অগ্রগতি ঘটে। অনেক সময় রূপক ধর্মীতার আশ্রয় নেওয়া হলেও তার আড়ালে থাকে মানব চিত্র।
(৪) শ্রুতিভিত্তিক
লোক কথা হল মৌখিক ঐতিহ্য ভিত্তিক সাহিত্য বা শ্রুতি সাহিত্য। নিরক্ষর ও শিক্ষিত উভয় শ্রেণীর মানুষের মুখে মুখে লোক কথাগুলি এক পুরুষ থেকে পরের পুরুষ পর্যন্ত প্রচারিত হয়। এক অঞ্চলের লোককথা আর লোকমুখের অন্য অঞ্চলের প্রচারিত হয়।
(৫) অতি কাল্পনিক
লোককথা কাহিনীগুলি প্রকৃতিগত বিচারে অতি কাল্পনিক। লোক কথা গলিতে যে রূপকথা, পরি কথা, পশু কথা, পুরান বা কিংবদন্তি স্থান পায় শেষ হবে চরিত্রগুলি বাস্তবধর্মী নয়, কল্পনা ধর্মী। লোক কথা রচয়িতা গান কল্পনার জগত থেকে বিভিন্ন চরিত্র তুলে ধরেন। যেমন- ডাইনি, দৈত্য, পড়ি, ড্রাগন, ভূত-প্রেত প্রভৃতি।
(৬) রূপকধর্মী চরিত্রগঠন
লোককথায় রাজা-রানী-রাজপুত্র-রাজকন্যা-রাক্ষস-দৈত্য-ডাইনি-জাদুমন্ত্র-অলৌকিকতা ইত্যাদি বহিঃ সৌধের অন্তরালে সাধারণ মানুষের জীবনে আশা-আকাঙ্ক্ষা, চাওয়া-পাওয়া, কামনা বাসনা গুলি লুকিয়ে থাকে। অনেক সময় রূপক ধর্মীতা বজায় রাখার জন্য বিভিন্ন পশুপাখি, কীট পতঙ্গের মধ্যে মানুষের মতো ব্যক্তিত্ব আরোপ করা হয়। যারা মানুষের মতো করে কথা বলে এবং মানুষের মতো করে নিজেদের চিন্তা ভাবনার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়।
(৭) সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা
বিশ্ব সাহিত্যে লোকো কথা সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা অসীম। এক দেশের লোককথা সেই দেশ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনপ্রিয়তা লাভ করে ও গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। হঠাৎ লোক কথা কোন ভৌগলিক সীমানার মধ্যে আবদ্ধ থাকে না, তাবিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। সুদারল্যান্ড ও আলবাথনাট মনে করেন-দূর দেশে যাত্রা করা নাবিক, বণিক, সন্ন্যাসী, চারণ কবি, যোদ্ধা, যুদ্ধ বন্দি, ক্রীতদাস ও নারীর প্রমুখের মাধ্যমে লক্ষ্য কথার কাহিনীগুলি দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে।
(৮) অনির্দিষ্ট স্থান-কাল-পাত্র
লোক কথার গল্পের স্থান-কাল-পাত্রের কোন সুনির্দিষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায় না।
লোক কথার গুরুত্ব
লোক কথার কাহিনীগুলি বাস্তব ধর্মী বা ইতিহাস ভিত্তিক না হলেও লোক সাহিত্যের ইতিহাসে সেগুলি মূল্যহীন নয়। লোক কথার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গুরুত্ব হল-
(১) সমাজ সংস্কৃতির পরিচয়গত
বিভিন্ন দেশের নির্দিষ্ট সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের লোক কথা গুলি গড়ে ওঠে। তাই লোগ কথাগুলি হয়ে ওঠে সুনির্দিষ্ট আঞ্চলিক ঐতিহ্যের পরিচালক। ধর্ম বিশ্বাস, সংস্কার, খাদ্যাভ্যাস, বেশভূষা, সমাজরীতি-সহ সমাজ-সংস্কৃতিক সমগ্র পরিচয় দানে সাহায্য করে থাকে লোক কথা।
(২) অতীত ইতিহাসের ধারণাদানে
বহু যুগ আগে কোন জনগোষ্ঠীর বিস্তৃত ইতিহাসে পূর্ণ গঠনের ক্ষেত্রে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের সহায়ক হিসেবে কাজ করে লোককথা। তাই লোক কথাকে বলা হয় এক জীবন্ত ও অবিনশ্বর জীবাশ্ম। নৃতত্ত্ববীদের ধারণায় আজ লোক সাধারণের মধ্যে যে সমস্ত বিশ্বাস, সংস্কার, প্রথা প্রভৃতির প্রচলন রয়েছে, সেগুলি অধিকাংশেরই হদিশ মেলে লোক কথায়।
(৩) মনোরঞ্জন ও শিক্ষাদানে
যুগের পর যুগ ধরে লোক কথার কাহিনী পাঠ করে পাঠক কুলে আনন্দ লাভ করে আসছে। নানা ধরনের অতি মানবিক কাহিনীগুলি পাঠকের মনোরঞ্জন করে। পাশাপাশি লোকও কাহিনীগুলি পরোক্ষভাবে মানুষকে শিক্ষা দেয়। লোক কথাগুলি সমাপ্তিতে থাকে নানা ধরনের নীতিবাক্য। তাই বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন লোক কথার উপযোগিতা প্রসঙ্গে বলেছেন- “যদি তোমার সন্তানকে বুদ্ধিমান করে তুলতে চাও তবে তাদের লোককথার গল্প পড়তে দাও। যদি তাদের আরব বুদ্ধিমান করে তুলতে চাও তবে তাদের আরো বেশি লোক কথার গল্প পড়তে দাও।”