সূচনা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সূচনা কালে ভারতের বড়লাট ছিলেন লিনলিথগো। বিশ্বযুদ্ধ জনিত পরিস্থিতি, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ভারতের অন্যতম ব্রিটিশ উপনিবেশ ব্রিটিশ শাসককে সংকটে ফেলে। ব্রিটিশ সরকার যুদ্ধে ভারতের সাহায্যে লাভের লক্ষ্যে সচেষ্ট হয়ে ওঠে। এই লক্ষ্য পূরণের জন্য বড়লাট লিনলিথগো সক্রিয় হয়ে ওঠেন এবং কিছু প্রস্তাব পেশ করেন।
লিনলিথগো প্রস্তাব
১. প্রেক্ষাপট
১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে ৩ সেপ্টেম্বর হিটলারের পোল্যান্ড আক্রমণের মধ্যে দিয়ে ইউরোপ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা ঘটে। ইংল্যান্ডের মিত্রপক্ষ জোটের হয়ে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এ সময় ভারতের বড়লাট লিনলিথগো একতরফা ঘোষণায় বলেন যে ভারত বৃটেনের পক্ষে বিশ্ব যুদ্ধে যোগ দিয়েছে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হলো যে লিনলিথগো ভারতীয় নেতৃ বর্গ বা কেন্দ্রীয় আইনসভার সঙ্গে কোন রকম পরামর্শ না করেই এই ঘোষণা করে দেন। তাই লিনলিথগো এই ঘোষণায় ভারতীয় জনগণ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন।
২. কংগ্রেসের শর্তাধীন সহযোগিতার সিদ্ধান্ত
লিনলিথগোর ঘোষণার প্রতিবাদে জাতীয় কংগ্রেস মন্ত্রিসভার থেকে পদত্যাগ করে। তবে কংগ্রেস ব্রিটিশের সঙ্গে আলাপ আলোচনার পথ খোলা রাখে। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি এক প্রস্তাব গ্রহণ করে। এই প্রস্তাবে ব্রিটেনের পক্ষ অবলম্বন এর ব্যাপারে কংগ্রেস শর্তের উল্লেখ করে। প্রথম শর্তে বলা হয়, কেন্দ্রে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জাতীয় সরকার গঠন করতে হবে। আর দ্বিতীয় শর্তে বলা হয়, ব্রিটিশকে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যে যুদ্ধ শেষে তারা ভারতকে স্বাধীনতা প্রদান করবে। জাতীয় কংগ্রেসের এই ভূমিকার বিরুদ্ধে সরব হয়ে বামপন্থী গোষ্ঠীগুলি। ফরওয়ার্ড ব্লক, সমাজবাদী পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি সহ বিভিন্ন গোষ্ঠী এক জোট হয়ে বলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আসলে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ তাই ভারতবাসীর উচিত এই যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন শুরু করা। এই লক্ষী বামপন্থী গোষ্ঠী গুলি কংগ্রেসের উপর চাপ তৈরি করে।
৩. ব্রিটিশের বিভেদকামী ভূমিকা
বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ব্রিটিশ ভারতে মুসলিম লীগকে অধিক গুরুত্ব দিতে শুরু করে। বিশেষত কংগ্রেসের বিরুদ্ধে লীগের বিদ্বেষ বৃদ্ধি লক্ষ্যে ব্রিটিশ সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে লিভ ও কংগ্রেসের দ্বন্দ্ব আরো প্রকট হয়ে ওঠে।
৪. লিনলিথগোর আগস্ট প্রস্তাব
জুতো শুরুর প্রথম দিকে ব্রিটিশ কোন ভাষা হয়ে পড়লে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ পুনরায় কংগ্রেস সহ অন্যান্যদের সহযোগিতা লাভের জন্য সচেষ্ট হয়ে ওঠে। বিডি সরকার ভারতবাসীর সমর্থন আদায়ের জন্য কিছু সংস্কারের কথা ঘোষণা করে। গর্ভনর জেনারেল এক ঘোষণায় বলেন (১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে ৮ আগস্ট) –
(১) ব্রিটিশ সরকার ভারতের ডমিনিয়ন ধরনের এর দায়িত্বশীল গণতান্ত্রিক সরকার গঠনে ইচ্ছুক।
(২) ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে ভারত শাসন আইনের কোন পরিবর্তন করার আগে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পরামর্শ নেয়া হবে। পাশাপাশি ভারতের বিভিন্ন দল, সম্প্রদায় এবং দেশীয় রাজ্যদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করা হবে।
(৩) ভারতের একটি যুদ্ধ উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হবে।
৫. কংগ্রেসের রামগড় অধিবেশন
কংগ্রেসের রামগড় অধিবেশনে (১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে মার্চ) লিনলিথগোর প্রস্তাব সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করা হয়। লিনলিথগোর ডোমিনিয়নের মর্যাদা দান যে স্বরাজের সমর্থক নয় সে কথা কংগ্রেস নেতৃ বর্গ বহু আগে উপলব্ধি করে। তাই রামগড় অধিবেশনে স্থির হয় –
(১) সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে জাতীয় কংগ্রেস অংশ নেবে না।
(২) ডোমিনিয়নের প্রস্তাব আগ্রহ করা হবে।
(৩) গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রতিনিধি নির্বাচনের মাধ্যমে গণপরিষদ গঠন করতে হবে।
(৪) জাতীয় কংগ্রেস সাংগঠনিকভাবে নিজেদেরকে প্রস্তুত করবে এবং সংকট তৈরি হলে আইন অমান্য করবে।
৬. মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশন
মুসলিম লীগ কংগ্রেসের গণপরিষদ গঠনের দাবি প্রত্যাখ্যান করে। লীগ আশঙ্কিত হয় এই ভেবে যে, প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে গণপরিষদ বা সংবিধান সভা গঠিত হলে জাতীয় কংগ্রেসের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব বা প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হবে। এই সময়কালে মুসলিম লীগে লাহোর অধিবেশনে মুসলিমদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র পাকিস্তান গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। ফলে জাতীয় রাজনীতিতে এক জটিল আবর্তে নিক্ষিপ্ত হয়।
৭. সমালোচনা
বড়লাট লিনলিথগোর প্রস্তাবগুলিতে ভারতীয়দের হাতে তেমন কোন ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। তাছাড়াও এই প্রস্তাবে দুটি ক্ষেত্র ত্রুটিপূর্ণ ছিল,
প্রথমত, এই প্রস্তাবে ভারতকে পূর্ণ স্বাধীনতা দানের ব্যাপারে স্পষ্ট কোন উল্লেখ ছিল না। বলা হয়েছিল যুদ্ধ শেষে ভারতকে ব্রিটিশ কমনওয়েলথের মধ্যে একটি ডোমিনিয়নের মর্যাদা দেওয়া হবে।
দ্বিতীয়ত, এই প্রস্তাবে সাংবিধানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। এই অহেতুক প্রতিশ্রুতি দান আসলে জিন্নার পাকিস্তান দাবিকে সমর্থন করেছিল বলা চলে। তাই এই প্রস্তাবকে কংগ্রেসের হতাশা জনক বলে আখ্যা দেয়। ব্রিটিশ সংবিধান বিশেষজ্ঞ হডসন লিনলিথগো প্রস্তাবকে সমালোচনা করে বলেছেন -“এই প্রস্তাব ছিল অস্পষ্ট, অসংলগ্ন চিন্তা হীনতার প্রতিফলন।
৮. ফলাফল
(১) গান্ধীজীর ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহ : জাতীয় কংগ্রেস দ্বারা আগস্ট প্রস্তাব সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান হয়েছিল। জাতীয় কংগ্রেস নিজেদেরকে সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং অন্যান্য কিছু কারণে ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে বৃহত্তর আন্দোলন করতে না চাইলেও ইংরেজদের অমনীয় মনোভাবের কারণে তারা আইন অমান্য আন্দোলন শুরুর হুমকি দেয়। বড়লাট লিনলিথগোর ঘোষণার আপত্তি তুলে গান্ধীজী ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহের উদ্যোগ নেন। বল্লভ ভাই প্যাটেল, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, জওহরলাল নেহেরু, চক্রবর্তী রাজগোপালচারী প্রমুখ নেতৃ বর্গ গান্ধীজীর নেতৃত্বাধীন এই আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানায়। কংগ্রেস কার্যকরী সমিতির অনুমোদনের পর প্রদেশ কংগ্রেস কমিটিগুলি এবং কংগ্রেসের সাধারণ কর্মীগণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে অংশ নেয়।
(২) জাতীয় রাজনীতির অচলাবস্থা : কংগ্রেস ছাড়াও লিগ-সহ অন্যান্য দলগুলি ও ব্রিটিশের বিরোধিতা শুরু করে। ফলে জাতীয় রাজনীতিতে এক অচলাবস্থা তৈরি হলো। জাতীয় রাজনীতির এই অচলাবস্থা দূর করার জন্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল এই প্রস্তাবের কিছু অংশ সংশোধন করে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ক্রইপস মিশন কে ভারতে পাঠান।