‘গুরু’ নাটকে মােট কটি সংগীত রয়েছে? নাটকটিতে সংগীতের ভূমিকা আলােচনা করাে
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গুরু’ নাটকে মােট সাতটি সংগীত বা গান রয়েছে।
গুরু নাটকের সাতটি গানের মধ্যে ছটি গান অচলায়তনেও ছিল, একটি গান নতুন সংযােজিত হয়েছে। গানের প্রয়ােগেও কিছু বদল ঘটিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। “তুমি ডাক দিয়েছ কোন্ সকালে” গানটিকে রবীন্দ্রনাথ গুরু নাটকে চারবারে ভেঙে ব্যবহার করেছেন, যেটি অচলায়তনে দুবারে ব্যবহৃত হয়েছিল। গুরুর আগমনে আত্মমগ্নভাবে পঞ্চক গেয়েছে তার এই আহ্বান গীত। পঞকের দ্বিতীয় গান “ওরে ওরে ওরে আমার মন মেতেছে”-তে আকাশের ঘননীল মেঘের মধ্যে পঞক শুনেছে। উদার মুক্তির ডাক। আবার “এ পথ গেছে কোত্থানে গাে কোত্থানে” গানে পঞ্চক তার মুক্তির পথের সন্ধান করেছে। পাহাড়ের পারে, সাগরের ধারে, ‘দুরাশার দিকপানে’।
যূনকদের “আমরা চাষ করি আনন্দে” আর “সব কাজে হাত লাগাই মোরা” -গান দুটিতে এই যৌথ কর্মমুখর জীবনের আনন্দের কথাই প্রকাশ পায়। “ও অকূলের কুল, ও অগতির গতি” দর্ভকদের এই গানটিতে প্রকাশ পেয়েছে অকৃত্রিম ঈশ্বরভক্তি।
গুরু নাটকের শেষে “ভেঙেছ দুয়ার, এসেছ জ্যোতির্ময়” গানটি অচলায়তন নাটকে ছিল না। যে গুরুর নেতৃত্বে অচলায়তনে দীর্ঘকাল ধরে সযত্নে লালিত যাবতীয় প্রথাসর্বস্বতা বা সংস্কার ভেঙে পড়েছে, তাকে কেন্দ্র করেই এই গানটি গাওয়া হয়েছে। এইভাবে ঘটনার আবহ, চরিত্রের তাৎপর্য এবং নাট্যব্যঞ্জনাকে সার্থক করে তুলতে ‘গুরু’ নাটকে গান খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে।
রূপক নাটক হিসেবে ‘গুরু’-র সার্থকতা আলােচনা করাে
কোনাে গভীর বিষয়কে একটি ছদ্মবেশের আশ্রয় নিয়ে যখন প্রকাশ করা হয় তখনই আমরা তাকে রূপক বলে থাকি। যে কোনাে রূপক নাটকেরই দুটি আখ্যান থাকে। বাইরের আখ্যান সেখানে গৌণ, ভেতরের আখ্যানই মুখ্য।
রবীন্দ্রনাথের গুরু নাটকের অচলায়তন পুথিনির্ভর, সংস্কারসর্বস্ব, নিয়মতান্ত্রিক জীবনদর্শনের রূপক, যা আসলে স্থবিরতারই নামান্তর।
‘গুরু’ নাটকের বিষয় হল প্রথার সঙ্গে প্রাণের দ্বন্দ্ব। নাটকের সূচনাতেই গুরু-র ধারণাকে কেন্দ্র করে অচলায়তনে শুরু হয় নাট্যদ্বন্দ্ব। গতিহীন অচলায়তনের বেশিরভাগ বাসিন্দা বা স্থবিরকদের কাছে শাস্ত্রের বিধান, নিয়মতান্ত্রিকতা আর গুরু সমার্থক। আবার পঞ্চক ও আচার্যের কাছে তিনি মুক্তির দূত। অচলায়তনের বাইরে শূনকদের কাছে তিনি ‘দাদাঠাকুর’ আর সরলমতি দর্ভকদের কাছে গােসাঁই। শেষ-অবধি অবশ্য প্রাচীর ভেঙে গুরুই সকলকে মিলিয়ে দেন প্রথামুক্তির পথে।
রূপকধর্মকে প্রতিষ্ঠায় একজটা দেবী, মহাময়ূরী দেবী, কুলদত্তের ক্রিয়াসংগ্রহ, মহাতামস ব্রত ইত্যাদি যে অসংখ্য দেবতা, প্রথা বা রীতিনীতির উল্লেখ আছে সেগুলি আসলে প্রথা ও সংস্কারের প্রতীকী তাৎপর্যকেই বহন করে। এ ছাড়া গুরু-ও কেবল নিছক এক ব্যক্তি নন, তিনি রূপকার্থে একটি ধারণা যা বদ্ধ প্রাণহীন জীবনে আলাের পথ দেখায়, মুক্তির গান শােনায়।
গুরু নাটকে যে নাট্যদ্বন্দ্বের প্রকাশ ঘটেছে তা নিজের ভাষায় আলােচনা করাে
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গুরু’ নাটকে দ্বন্দ্ব হল প্রথার সঙ্গে প্রাণের। পঞ্চকের গান গাওয়া কিংবা গুরুর আগমনকে কেন্দ্র করে এই দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হলেও তা ঘনীভূত হয় সুভদ্রের আয়তনের উত্তর দিকের জানলা খােলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে। উত্তরে একজটা দেবীর অধিষ্ঠান হওয়ায় এই ঘটনায় আসন্ন সর্বনাশের ছায়া দেখে ক্ষুদ্ধ ও শঙ্কিত হন উপাধ্যায়, মহাপঞ্ক প্রমুখ অচলায়তনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। অন্যদিকে ‘তিনশাে পয়তান্তিশ বছরের আগল তুমি ঘুচিয়েছ’ বলে পঞ্চক স্বাগত জানায় সুভদ্রকে। দ্বন্দ্ব তীব্রতর হয়েছে যখন আচার্য পঞ্চকের পক্ষে যােগ দিয়েছেন। নাটকের একদিকে যেমন ‘জীর্ণ পুথির ভাণ্ডার’, যুক্তিহীন আচার আচরণে প্রশ্নহীন আনুগত্য তেমন অন্যদিকে রয়েছে ‘আকাশের ঘননীল মেঘের মধ্যে মুক্তির ডাক’, গানের সুর, প্রাচীর ভাঙার আকাঙ্ক্ষা।
এই দ্বন্দ্বকেই আরও স্পষ্টরূপে উপলব্ধি করা যায় পঞ্চকের সঙ্গে শূনকদের কথােপকথনে। মুক্তির স্বাদ পাওয়া যুনকদের লােহার কাজ করতে, কাকুড় বা খেসারি ডাল চাষ করার ক্ষেত্রে কোনাে আপত্তি লক্ষ করা যায় না।
দাদাঠাকুরের নেতৃত্বে শূনকরা ভেঙে দেয় অচলায়তনের প্রাচীর। নাটকের শেষে গুরুর নিঃসংশয় প্রতিষ্ঠায় উদার অভ্যুদয়-এর জয়গান ঘােষিত হয়েছে, তার মধ্যেও নিহিত আছে। অন্ধকার আর আলাের, পুরােনাে আর নতুনের চিরকালীন দ্বন্দ্বে প্রাণের জাগরণের কথা।
গুরু নাটকে সংলাপ রচনায় নাট্যকারের সার্থকতা আলােচনা করাে
সংলাপ নাটকের প্রাণস্বরূপ। সংলাপের মধ্যে দিয়েই নাটকে চরিত্রের বিকাশ কিংবা নাটকের দ্বন্দ্ব প্রতিভাত হয়। ‘গুরু নাটকের সংলাপ রচনার ক্ষেত্রেও রবীন্দ্রনাথের এই দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়।
নাটকটি যাতে বক্তব্যধর্মী না হয়ে যায়, সেজন্য রবীন্দ্রনাথ সংক্ষিপ্ত সংলাপের ওপর বেশি গুরুত্ব আরােপ করেছেন। যেমন, নাটকের শুরুতেই গুরুর আবির্ভাব নিয়ে আলােচনা করেছে বালকের দল-
তৃতীয়। কিন্তু ভাই গুরু কী?
দ্বিতীয়। তা জানি নে।
তৃতীয়। কে জানে?
দ্বিতীয়। এখানে কেউ জানে না।
মাত্র কয়েকটি অতিসংক্ষিপ্ত সংলাপ, কিন্তু তার মধ্যেই বালকদলের অজ্ঞতাকে ছাপিয়ে প্রকাশিত হয়েছে গুরুর বিরাটত্বের ইঙ্গিত। মহাপকের সঙ্গে পঞ্চকের সংলাপও এক্ষেত্রে উল্লেখযােগ্য-
পঞ্চক। গুরু আসছেন যে। তাই আমার কেবলই মন্তরে ভুল হচ্ছে।
আপাত সাধারণ সংলাপে বুদ্ধি আর হাস্যরসের নিপুণ মিশ্রণে তাকে অসাধারণ তাৎপর্যময় করে তুলতে পেরেছেন নাট্যকার। সংলাপের মধ্যে সংকেতময়তাও নিয়ে এসেছেন নাট্যকার। যেমন, দাদাঠাকুর প্রসঙ্গে পঞককে প্রথম যূনক বলেছে-
উনি গেলে তােমাদের অচলায়তনের পাথরগুলাে সুস্ধ নাচতে আরম্ভ করবে, পুথিগুলাের মধ্যে বাঁশি বাজবে।
বিষয়বস্তুর ব্যঞ্জনা এই সংকেতময় সংলাপে সার্থকভাবে ফুটে উঠেছে। এভাবে চরিত্র ও বিষয় অনুযায়ী সংলাপ সৃষ্টিতে নাট্যকার রবীন্দ্রনাথ তাঁর শিল্পদক্ষতার অসামান্য নজির রেখেছেন।