বিশ্বায়নের পরিপ্রেক্ষিতে সার্বভৌমিকতার ধারণা
বিশ্বায়ন বা ‘Globalisation’ বিষয়টিকে কোনো একটি নির্দিষ্ট বাকো। সংজ্ঞায়িত করা কঠিন। বিশ্বায়ন একটি আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া। তবে বিশ্বায়ন। কোনো আকস্মিক প্রক্রিয়া নয়; তা বহু পূর্ব থেকেই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে। ক্রিয়াশীল।
বিশ্বায়নের ধারণা
১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে ঠান্ডা লড়াইয়ের পরিসমাপ্তির পরে বিশ্বায়ন পরিভাষাটির প্রয়োগ নতুন মাত্রা পায়। জোসেফ স্টিগলিৎস-এর মতে, বিশ্বায়ন হল বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও জনগণের মধ্যে এক নিবিড় সংযোগসাধনের প্রক্রিয়া। অনেকে একে নয়া উদারনৈতিক বিশ্বায়ন (Neo-Liberal Globalisation) বলে অভিহিত করেছেন। আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার (IMF), বিশ্বব্যাংক (World Bank) এবং বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা (WTO) আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশ্বায়নকে প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করে। রোলান্ড রবার্টসনের মতে, বিশ্বায়ন এক নয়া বিশ্বব্যবস্থা সম্প্রসারণের ধারণার সঙ্গে জড়িত। এককথায় বলতে গেলে বিশ্বায়ন হল বিশ্বব্যবস্থা সম্প্রসারণের এমন এক প্রক্রিয়া যার দ্বারা রাষ্ট্র-সংক্রান্ত সমন্ত সংকীর্ণ ধারণার অবসান ঘটে এবং অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী অবাধ আদানপ্রদানের পথ সুগম হয়। পুঁজির অবাধ চলাচল, মুক্ত বাজার অর্থনীতি, উদারীকরণ এবং বেসরকারিকরণ প্রভৃতি বিষয় বিশ্বায়নের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।
সার্বভৌমিকতার ধারণা
আধুনিক রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক ও তাৎপর্যপূর্ণ উপাদান হল সার্বভৌমিকতা। সার্বভৌমিকতার একত্ববাদী তত্ত্বের প্রধান প্রবত্তা বোদার মতে, “Sovereignty is the supreme and perpetual power of state” | রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতা চরম, অবাধ, অসীম এবং অবিভাজ্য। রাষ্ট্র ছাড়া কোনো সংঘ বা প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা ভোগ করার অধিকার নেই। সার্বভৌমিকতার দুটি দিক রয়েছে। একটি হল অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমিকতা এবং অপরটি হল বাহ্যিক সার্বভৌমিকতা। অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমিকতা অনুসারে রাষ্ট্র তার সীমানার মধ্যে চরম ক্ষমতার অধিকারী। রাষ্ট্রের নিজস্ব ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের আদেশ বা নির্দেশ অনুসারে আইন ব্যক্তি, সংঘ বা প্রতিষ্ঠান নির্বিশেষে সবার ওপর প্রযোজ্য হয়। অন্যদিকে, বাহ্যিক সার্বভৌমিকতার ধারণায় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জাতি-রাষ্ট্রের স্বাধীন ও সার্বভৌম সত্তার কথা তুলে ধরা হয়।
সার্বভৌমিকতার ধারণার ওপর বিশ্বায়নের প্রভাব
[1] জাতি-রাষ্ট্রের সংকট: রাজনৈতিক দিক থেকে বিশ্বায়ন জাতি-রাষ্ট্রের (Nation State) সংকট সৃষ্টি করেছে বলে অনেকে মনে করেন। জাতি- রাষ্ট্রগুলির সাবেকি চূড়ান্ত রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার ধারণা বিশ্বায়নের যুগে বহুলাংশে অচল হয়ে পড়েছে। বিশ্বায়ন জাতি-রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতাকে খর্ব করে রাষ্ট্রকে একটি ‘বাজারকেন্দ্রিক সংগঠনে’ পরিণত করেছে।
[2] সার্বভৌমিকতার চিরাচরিত ধারণার অবসান: অধ্যাপক হলটন তাঁর Globalisation and the Nation State গ্রন্থে জাতি-রাষ্ট্রের ওপর বিশ্বায়নের প্রভাব পর্যালোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, জাতি-রাষ্ট্রগুলি যে পৃথিবীতে বাস করে তার পরিবর্তন ঘটে চলেছে। বিশ্বায়ন হল এই পরিবর্তনের একটি প্রধান উৎস। বিশ্বায়নের বিভিন্ন দিক জাতি-রাষ্ট্রগুলির ভূমিকা ও পারস্পরিক সম্পর্কের পরিবর্তন সাধন করেছে। এই ধরনের পরিবর্তন নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মধ্যে রাষ্ট্রের চরম সার্বভৌমত্বের চিরাচরিত ধারণার অবসান ঘটাতে পারে।
[3] রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ: জোশেফ এস নাই এবং জন ডি জোনাহিউ তাঁদের Governance as a Globalisation World নামক এক গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, বিশ্বায়নের যুগে মূলধনের সচলতা (Mobility of Cap- ital), এক দেশ থেকে অন্য দেশে দক্ষ শ্রমিকের নির্গমন, তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে অর্থ ও শেয়ার হস্তান্তর ইত্যাদি বিষয়গুলির আধিক্য লক্ষ করা যায়। এই বিষয়গুলি সরকারের কর আরোপ করার চিরাচরিত ক্ষমতাকে ব্যাহত করেছে।
[4] স্বাধীন অর্থনৈতিক নীতির বিপন্নতা: অনেকে মনে করেন, বিশ্বায়নের ফলে সার্বভৌম জাতি-রাষ্ট্রের স্বাধীন অর্থনৈতিক নীতি সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে। অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের প্রভাবে সমস্ত দেশের অর্থনীতি পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। মূলধন ও প্রযুক্তির বিশাল প্রবাহ পণ্য ও পরিসেবার বাণিজ্যকে সমৃদ্ধতর করেছে। ফলে বিভিন্ন জাতীয় রাষ্ট্রের অর্থনীতি পরস্পরের সঙ্গে সংযোজিত হয়ে সমগ্র বিশ্বে এক অখন্ড বাজারের প্রবর্তন করেছে। বহুজাতিক সংস্থা, শক্তিশালী আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং বৃহদাকার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যব্যবস্থা একুশ শতকের বিশ্ব-অর্থনীতির মুখ্য পরিচালক ও নিয়ন্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার এবং বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি। উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলির অর্থনীতি ও উন্নয়ন এদের নীতি ও নির্দেশিকার ওপর নির্ভরশীল। এভাবে অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের ফলে জাতি-রাষ্ট্রের স্বাধীন অর্থনৈতিক নীতি বিপন্নতার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। এর প্রভাবে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি কাঠামোগত সংস্কার, সরকারি ক্ষেত্রগুলির বেসরকারিকরণ ও বিলগ্নিকরণ, ভরতুকি প্রত্যাহার, কর্মী সংকোচন প্রভৃতি নীতির রূপায়ণ করতে বাধা হচ্ছে।
[5 ] রাষ্ট্রব্যবস্থার মর্যাদা হ্রাস: বিশ্বায়নের ফলে রাষ্ট্রব্যবস্থা তার প্রয়োজনীয়তা হারিয়ে ফেলেছে। এমনকি রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের ধারণা নয়া আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় অবলুপ্ত হতে বসেছে বলে কেউ কেউ মনে করেন। বস্তুত, বিশ্বায়নের প্রভাবে একদিকে পৃথিবীতে ক্রমাগত আঞ্চলিক ও বিশ্বব্যাপী যোগাযোগ বেড়ে চলেছে। অন্যদিকে, জাতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সংস্থাগুলির সংখ্যা ক্রমশ কমে যাচ্ছে। এই পটভূমিকায় সার্বভৌমত্বের সাবেকি ব্যাখ্যা অচল হয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য হল, বিশ্বায়ন শুধুমাত্র স্বায়ত্তশাসনকে খর্ব করেনি, বিশ্বায়ন ধীরে ধীরে রাজনৈতিক, সামাজিক, জাতীয় এবং আঞ্চলিক পরিকাঠামোকে পরিবর্তিত করেছে। নতুন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের চিরাচরিত ক্ষমতা বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়েছে।
উপসংহার: পরিশেষে অধ্যাপক ডেভিড হেল্ডের সঙ্গে সহমত পোষণ। করে বলা যায়, বিশ্বায়নের প্রতিকূল প্রভাব সব রাষ্ট্রের ওপর সমানভাবে পড়েনি। অনগ্রসর ও উন্নয়নশীল দেশগুলির ওপর বিশ্বায়নের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। অধ্যাপক হেল্ডের মতে, তা সত্ত্বেও আইনানুগ সার্বভৌমিকতার ধারণার বাধ্যবাধকতা অব্যাহত রয়েছে। তবে জটিল আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার ফলে রাষ্ট্রের স্বাধিকার বর্তমানে সীমিত হয়ে পড়েছে।