রাওলাট আইন ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সরকার ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে একদিকে মন্টেগু-চেমসর্ফোড সংস্কার আইন প্রবর্তন করে জনগণকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করে, অন্যদিকে ভারতীয়দের ব্রিটিশ বিরোধী গণ আন্দোলন ও বৈপ্লবিক কার্যকলাপ সম্পন্ন বন্ধ করার উদ্দেশ্যে সরকার ইংল্যান্ডের বিচারপতি স্যার সিডনি রাওলাট এর সভাপতিতে পাঁচজন সদস্যকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে করে। এটি ‘রাওলাট কমিশন’ বা ‘সিডিশন কমিশন’ নামে পরিচিত। এই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ভারতের কেন্দ্রীয় আইনসভা ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি মাসে এক দমন মুলক বিল উত্থাপিত হয়। ভারতীয়দের সদস্যদের প্রতিবাদের ভারতীয়দের সদস্যদের প্রতিবাদের উপেক্ষা ১৮ মার্চ আইনে পরিণত হয়। এটি রাওলাট আইন নামে পরিচিত।
রাওলাট আইন প্রবর্তনের কারণ
১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে দমন মূলক রাওলাট আইন প্রবর্তনের বিভিন্ন কারণ ছিল, যেমন –
১. শ্বেতাঙ্গদের খুশি করার চেষ্টা
১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে মন্টেগু-চেমসর্ফোড শাসন সংস্কারের মাধ্যমে সরকার ভারতীয়দের কিছুটা তোষণ ও তাদের কিছু কিছু স্বায়ত্বশাসন অধিকার দেওয়ার চেষ্টা করে। এতে লগ্ন সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতা সম্পন্ন কিছু কিছু ইংরেজ অসন্তুষ্ট হয়। এই শ্রেণীকে খুশি করার উদ্দেশ্যে সরকার ভারতীয়দের ওপর তীব্র দমনমূলক আইন চাপিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে।
২. সরকার সুপারিশ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কালে ভারতের ব্রিটিশ সরকার বিলাতের প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলেনকে এক পত্রে জানাই যে, যুদ্ধের পর ভারতের পরিস্থিতি ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। এই সম্ভাবনা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার উদ্দেশ্যে আগাম ব্যবস্থা নিতে ভারত সরকার প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলেনকে অনুরোধ করে।
৩. ভারত রক্ষা আইন
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতের ব্রিটিশ সব ধরনের আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে সরকার ভারতরক্ষা আইন নামে একটি দমন মুলক আইন প্রবর্তন করেছিল। যুদ্ধ শেষে এই আইনের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এই অবস্থায় যুদ্ধ পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার ভারত রক্ষা আইনের মত একটি নতুন দমন মুলক আইনের প্রণয়নের প্রয়োজন অনুভব করে।
৪. মুসলিমদের ক্ষোভ
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ মুসলিম জগতের ধর্মগুরু তুরস্কের খলিফা ইংল্যান্ডের বিক্ষোভ জোটের হয়ে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। এজন্য দুধের পর ব্রিটিশ সরকার পরাজিত তুরস্করের খালিফার ক্ষমতা যথেষ্ট পরিমাণে খর্ব করে। তারা তুরস্কের ব্যবচ্ছেদদের উদ্যোগ নেয়। এতে ভারতীয় মুসলিম সম্প্রদায় ব্রিটিশদের উপর অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে খলিফাৎ আন্দোলন শুরু করে।
৫. গণ আন্দোলন
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতের দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধ, অনাবৃষ্টির ফলে শস্যহানি, বেকারত্ব, মহামারীর প্রকোপ প্রভৃতির ফলে দেশবাসীর অবস্থা শোচনীয় হয়ে ওঠে। সরকার এ বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন থাকায় দেশবাসী ব্রিটিশ সরকারের উপর অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়। এই ক্ষোভ দিকে গণ আন্দোলনরূপে ছড়িয়ে পড়ে।
৬. শ্বেতাঙ্গদের অমানবিকতা
দক্ষিণ আফ্রিকার সহ অন্যান্য ব্রিটিশ উপনিবেশ গুলিতে প্রচুর ভারতীয় কর্মরত ছিল। সেখানে ব্রিটিশ সরকার ও শ্বেতাঙ্গরা ভারতীয়দের সঙ্গে খুবই অমানবিক আচরণ করতো। এই খবর ভারতের ছড়িয়ে পড়লে ভারতীয়রা এ দেশের সরকার ও শ্বেতাঙ্গদের প্রতি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়।
৭. বিপ্লববাদের প্রসার
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতের সরকারের বিরুদ্ধে বিপ্লবীদের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। বিপ্লবীরা দেশের বিভিন্ন স্থানের সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শ্বেতাঙ্গদের ওপর আক্রমণ ও হত্যাকাণ্ড চালাতে শুরু করলে সরকার অত্যন্ত আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় সরকার ভারতীয়দের ওপরে প্রচন্ড দমন গুলো নীতি গ্রহণ করলে সংকট জন পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে।
৮. সিভিশন কমিটি
ভারতের ব্রিটিশ বিরোধী ক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরের মাসে ইংল্যান্ডের বিচারপতি স্যার সিডনি রাওলাটের সভাপতিত একটি কমিটি গঠন করে। এটি সিডিসন কমেডি নামে পরিচিত। এই কমিটি ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে এপ্রিল মাসে তার প্রতিবেদন পেশ করে। এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ১০ মার্চ কুখ্যাত রাওলাট আইন পাশ হয়।
উপসংহার
নগ্ন দমনমূলক রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে সারাদেশ জুড়ে তীব্র প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এই আইন পাশের প্রতিবাদে মোহাম্মদ আলী জিন্না, মদনমোহন মালব্য ও মাজহার-উল-হক আইন পরিষদের সদস্য পদ ত্যাগ করেন। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে সদ্য ভারতের ফিরে এসে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী রাওলাট আইনের প্রতিবাদ করে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দেন। তার ডাকে ভারতের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়।