সূচনা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ১৯১৪-১৮ খ্রিস্টাব্দের সময় ব্রিটিশ সরকার চেয়েছিল যুদ্ধে ভারতের অর্থ, সম্পদ ও জনবল পূর্ণভাবে ব্যবহার করতে। যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের বিভিন্ন আকর্ষণীয় প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভারতের গণ আন্দোলন প্রশমিত করার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর সরকার সেসব প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে গিয়ে ভারতীয়দের ওপরে বিভিন্ন দমন মূলক নীতি চাপিয়ে দেয়। ভারতীয়দের মতামত প্রকাশের অধিকার কেড়ে নেয়ার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়। ব্রিটিশ সরকার দমন পীড়নের একটি নিকৃষ্টতম দৃষ্টান্ত হলো রাওলাট আইন প্রবর্তন ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে।
রাওলাট আইনের শর্তাবলী
ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী জাতীয়তাবাদ, গণ আন্দোলন, বিপ্লবী কার্যকলাপ প্রভৃতি ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে কুখ্যাত রাওলাট আইনের বিভিন্ন ধারা যুক্ত করা হয়। এই আইনে বলা হয় যে-
১. প্রচারকার্য দন্ডনীয়
সরকার বিরোধী যে কোন প্রচারকার্য নিয়ে অপরাধ বলে গণ্য করা হবে।
২. বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার
সন্দেহভাজন যে কোন ব্যক্তি কে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করা যাবে। গ্রেফতারের পর বিনা বিচারে তাদের অনির্দিষ্ট কাল আটকে রাখা বা নির্বাচন দেওয়া যাবে।
৩. বাড়ি তল্লাশি
সরকার বিনা পরোয়ানায় যেকোনো ব্যক্তির বাড়ির তল্লাশি করতে পারবে।
৪. বিচারকার্য
বিশেষ আদালতে সন্দেহ ভাজন অপরাধী বিচার হবে। বিচারকগণ কোন মজুরির সহায়তা এবং কোন সাক্ষ্য প্রমাণ ছাড়া বিচার করতে পারবে।
৫. সংবাদপত্রের কন্ঠরোধ
কোন সংবাদপত্র স্বাধীনভাবে সংবাদ পরিবেশন করতে পারবে না।
৬. নিষেধাজ্ঞা
রাওলাট ডাইনে অভিযুক্ত ব্যক্তি রাজনীতি, শিক্ষা বা ধর্ম সংক্রান্ত কোনো কার্যাবলিত অংশগ্রহণ করতে পারতেন না। তাছাড়া এই আইনের গ্রেফতার হওয়ার ব্যক্তির মুক্তির জন্য অর্থ জমা দিতে হতো।
৭. মুক্তির জন্য অর্থদণ্ড
রাহুল আর্ট আইনে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিরা মুক্তির জন্য অর্থ জমা দিতে হতো।
৮. আপিলের নিষেধাজ্ঞা
রাওলা ডাইনীর দ্বারা যেসব বিচার কার্য সম্পন্ন হবে, সেই বিচারের রায়ের বিরুদ্ধে কোন উচ্চতর আদালতে আপিল মামলা দায়ের করা যাবে না।
রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া
নগ্ন দমন মূলক রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে ভারতের সর্বোচ্চ তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ঐতিহাসিক এইচ. এইচ. ডডওয়েলে বলেছেন যে, “এক সংকটজনক মুহূর্তের কুখ্যাত রাওলাট আইনে ভারতের সর্বজনীন প্রতিরোধ গড়ে উঠতে সাহায্য করেছিল।”
১. নেত্রবৃন্দের প্রতিবাদ
কুখ্যাত রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। কেন্দ্রীয় আইনসভার সকল বেসরকারি সদস্য রাওলাট আইনের বিরোধিতা করেন। নরমপন্থী হিসাবে পরিচিত সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও আইনের প্রতিবাদ করেন। বোম্বাই হাইকোর্টের বিচারপতি স্যার নারায়ণ চন্দ্র বার্কার এই আইনে কে অনাবশ্যক ও অসংগত বলে অবহিত করে।
২. গান্ধীজীর ভূমিকা
গান্ধীজি অত্যাচারী রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তিনি বলেছেন যে যে সরকার শান্তির সময় এই ধরনের নির্মম আইনের আশ্রয় নিয়েছে, সেই সরকার কখনো নিজেকে সভ্য সরকার বলে দাবি করতে পারেন না। তিনি এই আইনকে উকিল নেহি, দলিল নেহি, আপেল নেহি বোলে মন্তব্য করেন। এই আইনের প্রতিবাদে তিনি সরকারের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দেন।
৩. আইনের পরিষধ ত্যাগ
রাওলাট আইনের প্রতিবাদে মোহাম্মদ আলী জিন্না, মদনমোহন মালব্য এবং মাজহার-উল-হক আইন পরিষদের সদস্য পদত্যাগ করেন। জিন্না বলেন যে, যে সরকার দেশের শান্তির সময় এরূপ নির্যাতনমূলক আইন পাস করেছেন সেই সরকার নিজেকে কখনোই সভ্য সরকার বলে দাবি করতে পারেন না। লালা লাজপৎ রায় বলেছেন যে, এই আইনের ফলে আবার নতুন করে বিপ্লবী কার্যকলাপ শুরু হবে।
৪. সংবাদপত্রের প্রতিবাদ
বিভিন্ন সংবাদপত্র রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সরব হয়। ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’ ‘হিন্দু’, ‘দা নিউ ইন্ডিয়ান’ , ‘বোম্বাই ক্রনিক্যাল’, ‘কিশোরী’ প্রভৃতি সংবাদপত্রে এই আইনের তীব্র প্রতিবাদ করা হয়। রাওলাট আইন কে অমৃতবাজার পত্রিকা এক ভয়াবহ ভ্রান্তি ও কেশরি পত্রিকার উৎপিরনের দানবীযন্ত্র বলে অবহিত করে।
৫. জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ড
কুখ্যাত রাওলাড আইন ও অন্যান্য কয়েকটি ঘটনার প্রতিবাদে ১৩ই এপ্রিল পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগের সাধারণ মানুষের একটি শান্তিপূর্ণ জমায়েত অনুষ্ঠিত হয়। এই সমাবেশের নিরস্ত্র জনতার ওপর সরকারের পুলিশ মাইকেল ও ডায়ারের নেতৃত্বে নিরিবি বিচারের গুলি চালালে অন্তত এক হাজার মানুষের মৃত্যু ও প্রচুর মানুষের আহত হয়। এই ঘটনার প্রতিবাদে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সরকারের দেওয়ানা নাইট উপাধি ঘৃণাভরে ত্যাগ করেন। ডক্টর বিপান চন্দ্র লিখেছেন যে এই আন্দোলনের মাধ্যমে সারাদেশে যেন বৈদ্যুতিক তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ল। ভারতীয়রা আর বিদেশি শাসনের কাছে নথি স্বীকার করতে রাজি নয়।
উপসংহার
ব্রিটিশ সরকার প্রবর্তিত রাওলাট আইন এ দেশে ইংরেজদের হিংস্রতার আসল রূপটি প্রকাশ করে দেয়। এই আইন দেশের হিন্দু ও মুসলিম উভয়ের সাম্প্রদায়কে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ঐক্যবদ্ধ হতে অনুপ্রাণিত করে। রাওলাট আইন দেশবাসীকে পরোক্ষ গান্ধীজী নেতৃত্বাধীন আন্দোলনে শামিল হতে প্রেরণা যোগায়।