‘কর্তার ভূত’ অবলম্বনে ‘স্বভাবদোষে যারা নিজে ভাবতে যায়’ তাদের চরিত্র বিশ্লেষণ করাে
কর্তার ভূত রচনায় লেখক ধর্মতন্ত্রের দ্বারা শাসিত জনসাধারণের সেই বেশিরভাগ অংশ, যারা ভীরু ও উদ্যমহীন, তাদেরই দেশসুদ্ধ সবাই বলে উল্লেখ করেছেন আর যারা যুক্তির আলােকে দেশের প্রাচীন সংস্কারের মায়াজাল থেকে নিজেদেরকে এবং দেশবাসীকে বের করে আনতে চাইছে, তাদের স্বভাবদোষে যারা নিজে ভাবতে যায়-এর পর্যায়ভুক্ত করেছেন।
মৌলিক চিন্তার অধিকারী এইসব ‘হুঁশিয়ার’ মানুষ কখনােই গড্ডলিকা- প্রবাহে গা ভাসায় না বলে তাদের ভাগ্যে জোটে ‘ভূতের কানমলা। আর এই ভূতের কানমলা যেহেতু খালি চোখে দেখা যায় না, তাই তা থেকে নিজেকে যেমন ছাড়ানাে যায় না, তেমনি সেখান থেকে পালানােও সম্ভব হয় না হুঁশিয়ারদের।
তা ছাড়া, ভুতুড়ে জেলখানার অধিবাসী এইসব মানুষরা সেখান থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করলেও তার পাচিল যেহেতু চোখে দেখা যায় না, তাই বােঝাও যায় না কীভাবে সেই পাঁচিল ভেঙে বাইরে বেরােনাে সম্ভব। অর্থাৎ, ধর্মতন্ত্র বা সংস্কারের বেড়িকে যারা অক্ষয় আশীর্বাদ বলে মানতে পারে না, সেইসব চিন্তাশীল মানুষের ওপর ধর্মতন্ত্রের শাস্তি চিরকালই বর্ষিত হতে থাকে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘কর্তার ভূত’ রচনায় দেশসুদ্ধ সবাই বলতে কোন্ ধরনের মানুষের কথা বলা হয়েছে?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘কর্তার ভূত রচনায় তৎকালীন সমাজের ভীরু, উদ্যমহীন ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষদের কথা বলতে গিয়ে দেশসুদ্ধ সবাই শব্দগুচ্ছ প্রয়ােগ করেছেন।
বুড়াে কর্তা মারা যাওয়ার সময় দেশসুদ্ধ সবাই অর্থাৎ দেশের বেশিরভাগ জনগণ তাকে জানায় যে, তিনি মারা যাওয়ার পর তাদের অবস্থা আরও করুণ হয়ে পড়বে। এই সমস্যার সমাধানের জন্য দেবতার ইচ্ছাতে বুড়াে কর্তা যখন ভূত হয়ে তাদের ঘাড়ে চেপে রইলেন, তখন দেশবাসী নিশ্চিন্ত হল। কারণ, ভবিষ্যৎকে মানার ক্ষেত্রেই ভাবনাচিন্তার প্রশ্ন আসে, ভূতকে মানার ক্ষেত্রে সেরূপ কোনাে দুশ্চিন্তা নেই। দেশসুদ্ধ লােক তাই চোখ বুজে জীবন কাটাতে থাকে, প্রাচীন কৌলীন্য ও আভিজাত্য অনুভব করে এবং আনন্দিত হয়।
ভূতের জেলখানায় জনসাধারণকে যে ঘানি ঘােরাতে হয়, তা থেকে এক ছটাক তেলও বের হয় না, বের হয় কেবল ঘানি টানা মানুষের তেজ—আর তার ফলে মানুষ ক্রমশ ঠান্ডা হয়ে যায়। ফলে এই ব্যবস্থায় মানুষের অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের সংস্থান না হলেও সমাজে শান্তি বজায় থাকে। ভূত শাসনতন্ত্রে দেশবাসী সর্বদা এ কথা ভেবে গৌরব অনুভব করত যে, খোঁটায় বাঁধা ভেড়া যেমন মাটিতেই পড়ে থাকে, তাদের ভবিষ্যৎও তেমনি ভূতের খোঁটায় বাঁধাযেন একেবারে চিরকালের মতাে মাটি।
কর্তার ভূত ছোট গল্পের বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করাে।
‘কর্তার ভূত’ রচনাটিকে রবীন্দ্রনাথ সাজিয়েছেন মঙ্গলকারী বাস্তুভূতের লােকপ্রচলিত সংস্কারকে ভেঙে। তিনি যখন বলেন—“আমাদের সেই সর্বাঙ্গসম্পন্ন প্রাচীন সভ্যতা বহুদিন হল পঞত্বপ্রাপ্ত হয়েছে, আমাদের বর্তমান সমাজ তারই প্রেতযােনি মাত্র’, তখনই ‘কর্তার ভূত’-এর পূর্বাভাস পাওয়া যায়।
আমাদের সমাজের দিকে তাকালে যে একটা আশ্চর্য আপাত শান্তির ভাব চোখে পড়ে, তারই আড়ালে যে স্থবিরত্ব, মানসিক ক্লীবতা ও দুর্বলতা, ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কারাচ্ছন্নতা আছে, সেটিকেই রবীন্দ্রনাথ কর্তার রূপকে হাজির করেছেন তাঁর এই রচনায়। প্রাচীন বিশ্বাসরূপ ভূতের কাছে যাবতীয় চিন্তাচেতনা বন্ধক রেখে এক নিষ্প্রাণ সমাজ ক্রমশ গড়ে উঠেছে। কিন্তু সে সমাজ তাে পৃথিবী থেকে আলাদা নয়।
অন্যান্য দেশের সমাজের মধ্যে যে অগ্রগামিতা রয়েছে, নতুন চেতনার যে ঔজ্জ্বল্য সেখানে বিরাজমান, তার তুলনায় নিজেদের সমাজের বদ্ধরূপ স্বাভাবিকভাবেই বর্গির হানার মতাে কয়েকজনের মনে আন্দোলন জাগায়। কর্তার ভূত রচনার চতুর্থ ও পঞ্চম অধ্যায়ে এই প্রশ্নগুলিকেই তুলে ধরা হয়েছে প্রচলিত ছড়ার মােড়কে।
অতীতের সংস্কারকে আঁকড়ে ধরা, অভিশপ্ত এদেশের সমাজচিত্রই এ রচনার বিষয়বস্তু। তবে, রচনার বিষয়কে প্রকাশ করতে লেখক গ্রহণ করেন গল্প বলার এক বিশেষ ভঙ্গিকে। তবে, বক্তব্য প্রাধান্য পেলেও ‘কর্তার ভূত’ ‘প্যারাবল’ বা নীতি গল্প নয়। একে রূপক ব্যঙ্গ বা রূপকধর্মী ছােটোগল্পই বলা সংগত।
কর্তার ভূত ছোট গল্প অবলম্বনে ভুতুড়ে জেলখানার বর্ণনা দাও। কাদের সম্বন্ধে এবং কেন লেখক বলেছেন যে, তারা ভয়ংকর সজাগ আছে?
‘কর্তার ভূত’ রচনায় লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন যে, ভূতের নায়েব হলেন ভূতশাসিত কারাগারের পাহারাদার। সেই কারাগারের পাঁচিল অবশ্য চোখে দেখা যায় না। এ কারণে সেখানে যেসব মানুষ বন্দি থাকে, তারা বুঝে উঠতে পারে না যে, কীভাবে সে-পাঁচিল ফুটো করে সেখান থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব।
ভুতুড়ে কারাগারেও সাধারণ কারাগারের মতাে অপরাধীদের ঘানি ঘােরাতে হয়। তবে অবিরাম ঘুরিয়েও সেখানকার ঘানি থেকে এক ছটাকও তেল বের হয় না। বরং সেই ঘানি ঘােরালে বের হয় কেবল ঘানি ঘােরানাে মানুষের তেজ ও শক্তি। সেই শক্তি শরীর থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় এদেশের মানুষ ক্রমশ ঠান্ডা হয়ে আসে।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মানুষ ‘ভূতগ্রস্ত’ অর্থাৎ সংস্কারাচ্ছন্ন না হওয়ায় সেইসব দেশে ঘানি থেকে যে তেল বের হয়, সেই তেল দিয়ে তারা তাদের দেশের রথচক্রকে সচল রাখে। অর্থাৎ গঠনমূলক শ্রমের মধ্য দিয়ে তারা তাদের দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে বদ্ধপরিপকর।
তা ছাড়া, ‘অন্য সব দেশে ভূতের বাড়াবাড়ি হলেই মানুষ অস্থির হয়ে ওঝার খোঁজ করে’। অর্থাৎ ধর্মতন্ত্র ও কুসংস্কার সেখানে মাথাচাড়া দিলে বিদেশিরা বিজ্ঞানের দ্বারস্থ হয়। আর এসব কারণেই বিদেশিরা একেবারে নিরুদ্যম হয়ে পড়েনি বা নেতিয়ে যায়নি, তারা ভয়ংকর সজাগ আছে।