যুগোশ্লাভিয়া ও রাশিয়ার মনোমালিনের কারণ
ভূমিকা
পূর্ব ইউরোপে যেসব রাষ্ট্রের সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার প্রত্যেকটির পেছনের রাশিয়ার মদত থাকলেও, ব্যতিক্রম ছিল যুগোশ্লাভিয়া। পূর্ব ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলির মধ্যে যুগোশ্লাভিয়া জার্মানির হাত থেকে মুক্তি এবং সেখানে রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ ও প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা কোন ক্ষেত্রেই লাল ফৌজ এর সাহায্য নেয়নি।
১. যুগোশ্লাভিয়া স্বাধীন বিদেশ নীতি
স্বাধীনোত্তর যুগোশ্লাভিয়া বিদেশ নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে সোভিয়েত মডেলকে অনুসরণ করেন নি। এর ফলে যুগোশ্লাভিয়া সোভিয়েত সম্পর্কের অবনতি সূচনা ঘটে। আলবেনিয়াতে যুগোশ্লাভিয়া প্রভা বিস্তারের চেষ্টায় রাশিয়া মেনে নিতে পারেনি। মার্শাল টিটোর যুগোশ্লাভিয়া মস্কোর সম্পর্কের অবনতি শুরু হয়।
২. টিটোর স্বাধীনতা প্রিয়তা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ঠিক পরই সৌভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান স্টালিনের সঙ্গে যুগোশ্লাভিয়া রাষ্ট্রপ্রধান মার্শাল টিটোর সংঘাত বাদে। এই সংঘাতের মূল কারণ ছিল মার্শাল জোসেফ ব্রোজ টিটোর স্বাধীনতা প্রিয়তা। তিনি রাশিয়ায় নেতৃত্বাধীন সাম্যবাদী জোটের ধারণায় প্রভাবিত হননি। তিনি যুগোশ্লাভিয়া নেতৃত্বাধীন বলকান ফেডারেশন গঠনের সচেষ্ট হলে স্টালিন ক্ষিপ্ত হন, কেননা স্টালিন মনে করতেন এতে পূর্ব ইউরোপের নিরঙ্কুশ সাম্যবাদের প্রতিষ্ঠার বাধা প্রাপ্ত হবে। টিটো যুগোশ্লাভিয়া শহীদ রাশিয়ার পুলিশ ও সামরিক কর্মচারীদের ঘনঘন অনুপ্রবেশ মেনে না নিয়ে তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানালে যুগোশ্লাভিয়া সোভিয়েত সম্পর্কের অবনতি ঘটে। শহীদ সমালোচক মেডভেদভ মতে যুগোশ্লাভিয়া টিচার উত্তরো জনপ্রিয় বৃদ্ধি এবং স্বাধীন বিচার শক্তি স্টালিনকে ক্রুদ্ধ করেছিল।
৩. পুঁজিবাদের অনুপ্রবেশ
সোভিয়েত নিষেধাজ্ঞা জারি সত্ত্বেও পশ্চিমে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। একটি কমিউনিস্ট দেশ হয়েও যুগোশ্লাভিয়া যেভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য পুঁজিবাদী দেশগুলির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল তাতে সোভিয়েতের সঙ্গে যুগোশ্লাভিয়া সম্পর্কের অবনতি ঘটায় ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার।
৪. ক্রমশ সাম্যবাদের অনাস্থা
যুগোশ্লাভিয়া জাতীয়তাবাদী নেতারা বৃহত্তর যুগোশ্লাভিয়া গঠনের পথে সাম্যবাদের বিশ্বায়নকে অন্তরায় বলে মনে করতেন। সাম্যবাদের পথে অনেকটা এগিয়ে চলার পর হঠাৎ সাম্যবাদের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করায় যুগোশ্লাভিয়া সঙ্গে সোভিয়েতের তথা রাশিয়ার চরম মনোমালিন্য হয়।
« মনোমালিন্যের পরিণতি
যুগোশ্লাভিয়া ও রাশিয়ার বনমালীনের কমিউনিস্ট দুনিয়া টিটোর ওপর রুষ্ট হয়। রাশিয়ায় নানাভাবে তাকে ভয় দেখাতে থাকে। কিন্তু একদিকে সমগ্র যুগোশ্লাভিয়া এবং অন্যদিকে পশ্চিমী রাষ্ট্র বর্গের সামরিক ও আর্থিক সাহায্য টিটোকে রাশিয়ার রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করতে শক্তি যোগায়। শেষ পর্যন্ত টিটোকে বাঘে আনতে না পেরে যুগোশ্লাভিয়া কমিনফর্ম থেকে বিতাড়িত করা হয় ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে জুন মাসে।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রাশিয়া ও পোল্যান্ডের সম্পর্ক
সূচনা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে রাশিয়ার প্রত্যক্ষ সাহায্য নিয়ে এই পোল্যান্ড সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তাই পোল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ নীতি নির্ধারণ থেকে শুরু করে প্রতিটি পদক্ষেপ রাশিয়ার প্রভাব ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। পালিশ ইউনাইটেড ওয়ার্কার্স পার্টি বিংশতিতম কংগ্রেসের ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি মাস থেকে পোল্যান্ড রাশিয়ার বন্ধুত্বের সম্পর্ক নতুন দিক মর নেয়।
১. সম্পর্কের প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে পোল্যান্ড এক সর্বদলীয় যৌথ মন্ত্রিসভা গঠনের উদ্যোগ নেয়া হলে ও প্রকৃত অর্থে পোল্যান্ড কমিউনিস্টদের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছিল। পোল্যান্ডের কমিউনিস্ট নেতা বলেশলাভ বেরাট এ নেতৃত্বে পূর্ব পোল্যান্ড এক সোভিয়েত পন্থী সরকার গঠিত হয়। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে আগস্ট মাসে এই সরকার পোল্যান্ডের এক বিরাট অংশ রাশিয়া কে দান করেন। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে পোল্যান্ডে একটি নিরঙ্কু সাম্যবাদী সরকার গঠিত হয় এবং স্টালিনের পূর্ব প্রতিশ্রুতি মতো এই সরকারের কয়েকজন অ কমিউনিস্ট মন্ত্রী ও নেয়া হয়। তবে ঐ সমস্ত মন্ত্রীর কোন ক্ষমতাই ছিল না। এরপর পুলিশ ও সেনাবাহিনী পরিচালনার দিন ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে জানুয়ারিতে পোল্যান্ডে একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টি ও তার সহযোগী দলগুলি জয়লাভ করে এবং পোল্যান্ডের নতুন শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। নতুন সরকারের প্রধান নিযুক্ত হন বলেশলাভ বেরাট।
২. সম্পর্কের দ্বিতীয় পর্ব
(১) গোমুলকা-রুশ সমঝোতা : পোল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বিশৃঙ্খলা শুরু হলে স্টালিন এর নির্দেশে পোল্যান্ডের উদারপন্থী নেতা গোমুলকাকে কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হয় ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে। ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে গোমুলকাকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এরপর ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে বেরাটের মৃত্যু হলে পোল্যান্ডের সোভিয়েত বিরোধিতা তীব্র হয়। বিশেষ করে ক্রুশ্চেভের নিস্টালিনিকরণ নীতিতে উৎসাহিত হয়ে পোলিশ গণতন্ত্রীরা গোমুলকাকে নেতৃত্বে ফিরিয়ে আনার দাবি তোলেন। গণ বিদ্রোহ চরণে পৌঁছই। অবশেষে সোভিয়েত পলিটব্যুরো বাধা হয়ে গোমুলোকাকে নেতৃত্বে ফিরিয়ে আনে। ক্রুশ্চেভের নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধি দল পোল্যান্ডে আসেন এবং গোমুলকাকে পোলিশ কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করেন ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে নভেম্বর মাসের।
(২) সমঝোতার কারণ : গোমুলকাকে সঙ্গে এই আপসরফা হয়েছিলাম মূলত তিনটি কারণে, এগুলি হলো – (i) পোল্যান্ডে আপসরফা না করে সামরিক অভিযান চালালে গোটা পূর্ব ইউরোপ তথা সমাজতান্ত্রিক দুনিয়া জুড়ে তার প্রতিক্রিয়া হতে পারতো। (ii) গোমুলকা জাতীয়তাবাদী নেতা হলেও তিনি ছিলেন রুশ পন্থী ও মার্কিন বিরোধী। (iii) গোমুলকা জাতীয়তাবাদীদের প্রধান হিসেবে কথা দিয়েছিলেন ওয়ারশ চুক্তি ভঙ্গ করবেন না।
উপসংহার
অর্থনীতিতে ক্রমাগত সোভিয়েত হস্তক্ষেপ, কৃষিতে অবহেলা ইত্যাদির জন্য পুনরায় পোল্যান্ডে সোভিয়েত বিরোধিতা শুরু হয় এবং গোমুলকা সরকারের পতন ঘটে ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে।