সূচনা : ওই কিছু শব্দটির অর্থ ইতিহাসের পরম্পরাগত কথা (Tradition) ল্যাটিন ‘Traditions’ শব্দের অর্থ হল। হস্তান্তর সাধারণভাবে বলা যায় মৌখিক ঐতিহ্য হলো এমন এক মৌখিক গল্পধারা যার সংস্কৃতি বিষয়ে যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত হয়ে চলে। এই ধারণা গুলি অথবা বিষয় গুলি মৌখিকভাবে রূপান্তরিত হয়েছে। ভাষা এবং গানের মধ্যে এগুলি রূপ নিয়েছে লোক কাহিনী, প্রবাদ, গাথাকাহিনী, গান এবং স্তুতির মধ্যে দিয়ে। এইভাবে মৌখিক ইতিহাস, মৌখিক সাহিত্য, মৌখিক আইন এবং অন্যান্য জ্ঞান স্বরূপ গুলি লিখিত পদ্ধতি ছাড়াই বাহিত হয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে।
মৌখিক ঐতিহ্যের বিভিন্ন দিক
১. সংজ্ঞা
মৌখিক ঐতিহ্য হলো এমন এক সংস্কৃতিগত ধারণা যে এক প্রজন্ম থেকে অপর প্রজন্মের লোকমুখে প্রচলিত হয়। বিভিন্ন দিক থেকে মৌখিক ঐতিহ্যের সংজ্ঞা দেওয়া যায়। যথা –
(১) সাক্ষাৎকারের তথ্য সংগ্রহ ভিত্তিক : শ্রবণ, শ্রবণ-বীক্ষণ প্রভৃতি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে পূর্বনির্ধারিত বাক পরি কল্পিত সাক্ষাৎকার গ্রহণের দ্বারা ব্যক্তি বিশেষ বা ঘটনা ভিত্তিক তথ্য সংগ্রহ বা চর্চা কে মৌখিক ঐতিহ্য (Oral Traditions) বলে।
(২) মৌখিক বার্তাভিত্তিক : জন ভ্যানসিনা তার ‘Oral Traditions as History’ গ্রন্থে লিখেছেন মৌখিক ঐতিহ্য হলো “এক ধরনের মৌখিক বার্তা যা কথা, গান প্রভৃতির মাধ্যমে মুখে মুখে পূর্ববর্তী প্রজন্ম অতিক্রম করে পরবর্তী প্রজন্মে পৌঁছয়।
(৩) তথ্য বিশ্লেষণ ও চর্চাভিত্তিক : ওরাল হিস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন এর মতে “অতীতের ঘটনা সম্পর্কে মানুষের কণ্ঠস্বর, স্মৃতিকথা, বিভিন্ন সম্প্রদায় ও অংশগ্রহণকারীদের বক্তব্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বিশ্লেষণে চর্চা করা কে মৌখিক ইতিহাস বলে।
২. তত্ত্বগত দিক
তাত্ত্বিক বিচারে ইতিহাস রচনার মুখের কথায় ব্যবহারের দুটি দিক রয়েছে। একটি হলো আদর্শগত দিক অপরটি হল পদ্ধতিগত দিক। কার্তিক দিক থেকে ইতিহাস রচনার মুখের কথা ইতিহাস গুলি ব্যবহারে সঙ্গে সঙ্গে পপুলার ইতিহাসের এক ঘনিষ্ঠ সংযোগ স্থাপনের প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। যে সমাজের নিম্নবর্গীয় মানুষদের ইতিহাস জানার জন্য কোন লিখিত দলিল বা নথিপত্র মেলে না সেখানে মুখের কথা, স্মৃতি, ছড়া, প্রবাদ, কিংবদন্তি প্রভৃতি উপকরণ গুলি সাহায্য নিতে পারে। এগুলি হলো মূলত আদর্শগত দিক, আমার মৌখিক উপাদানের সংগ্রহের সম্ভাবনা, সীমাবদ্ধতা এবং ইতিহাস রচনার মুখের কথায় প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি হলো এর পদ্ধতিগত দিক।
৩. মুখের কথা ও মৌখিক ঐতিহ্যের মধ্যে পার্থক্য
মুখের কথা মৌখিক ঐতিহ্যের মধ্যে সামান্য হলেও পার্থক্য রয়েছে। মুখের কথা বলতে লেখকরা সাক্ষাৎকার ভিত্তিক বা স্মৃতি ভিত্তিক ঐতিহ্যকে বোঝান। অনেকে আবার প্রবাদ কেউ মুখের কথা উপাদান হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। মৌখিক ঐতিহ্য ইতিহাস ধর্মী দলিল দস্তা বেজ ও অন্যান্য লিখিত উপদানের সঙ্গে মুখের কথা কে যাচাই করে নেওয়ার প্রসঙ্গ আসে। যদিও এ ক্ষেত্রে কিসের ভিত্তিতে যাচাই করা হবে সে বিষয়ে কোনো স্পষ্ট ধারনা মেলে না।
৪. বৈশিষ্ট্য
মৌখিক ঐতিহ্যের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল-
(১) সাক্ষাৎকার : মৌখিক ঐতিহ্যের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য সাক্ষাৎকার অর্থাৎ কোন কাহিনী বা ঘটেনা একটি চিত্রের সঙ্গে অণু চিত্রের সাক্ষাতের কথোপকথন মৌখিক ভাবে বর্ণিত হয়। আধুনিক সভ্যতার সাক্ষাৎকার গুলির রেকর্ড করে রাখার সুবিধা রয়েছে, কিন্তু অতীতে তা ছিল না। শুভ্রাজি নদীতে সাক্ষাৎকারের মধ্যে দিয়ে যে ঘটনা বা কাহিনীর উদ্ভব ঘটতো তা লোকমুখী সাধারণত প্রচারিত হতো।
(২) অলিখিত : মৌখিক ঐতিহ্য হলো অলিখিত এক সংস্কৃতি বিষয়ে ও ঐতিহ্য। যেখানে দলিল দশটা বেজ বা মহাফেজখানা নথিপত্র গুলি ছাড়াই লোক-মুখী প্রচারিত কাহিনী বা ঘটনাকে গ্রহণ করা হয়। এই মৌখিক অলিখিত ঐতিহ্য লোক মুখে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে প্রবাহিত হয়। অনেক সময় মৌখিক ঐতিহ্যের উপর ভিত্তি করে লিখিত ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহ করা হয়।
(৩) সংরক্ষণ : শুভ প্রাচীন অতীতে কোন ঘটনা বা কাহিনীর বিবরণ লোক মুখে শোনার পর অনেকে সেগুলি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেন। কেউ কেউ সংরক্ষণের উপায় হিসেবে সেগুলিকে নথিভুক্ত বা রেকর্ড করে রাখেন। এছাড়াও লোকমুখী সোনা কোন কাহিনী বা ঘটনার তথ্যসূত্র গুলি বিভিন্ন মহাফেজখানা, গ্রন্থাগার, মট ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংরক্ষণ করে রাখা হয়। মূলত অতীতের এই কাহিনী বা ঘটনাগুলি যাতে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছই তা সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যেই এই সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়।
(৪) উৎস : সার্বিয়ান পন্ডিত ভুক-স্টিফেনভিক কারাডজিক (যিনি ছিলেন গ্রীম ভ্রার্তৃ বর্গের সমসাময়িক এবং বন্ধু) সর্বপ্রথম মৌখিক ঐতিহ্য অধ্যয়নের ক্ষেত্ররূপে তার উৎসের সন্ধান দেন। তিনি লক্ষ গাথার ঐতিহ্যকে মৌখিক ঐতিহ্যের উৎস রূপে চিহ্নিত করেন। তাকে অনুসরণ করে পরবর্তীকালে লোক ঐতিহ্য চর্চার মধ্যে দিয়ে প্রমাণিত হয় যে বিশেষ প্রয়োজনে ও সৃষ্টির আনন্দে আঞ্চলিক গোষ্ঠীসমাজ প্রাথমিকভাবে লোক কথার জন্ম দেয়।
৫. লোক ঐতিহ্যের বিকাশ
(১) বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দ্বারা : কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ অ্যাল্যান নেভিনস ‘কলম্বিয়া ওরাল হিস্ট্রি রিসার্চ অফিস’ প্রতিষ্ঠিত )১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে) করে মৌখিক ঐতিহ্যের আধুনিক ধারণার বিকাশ ঘটান। আমেরিকান মৌখিক ইতিহাসবিদগণ ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে ‘ওরাল হিস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন’ এবং ব্রিটিশ মৌখিক ইতিহাসবিদগণ ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে ওরাল হিস্ট্রি সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। এভাবে বিভিন্ন দেশে এই মৌখিক ইতিহাস চর্চার প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এই প্রতিষ্ঠান গুলির মৌখিক ইতিহাসের বিকাশ ও ব্যবহারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন।
(২) কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের চর্চার দ্বারা : বিশ শতকের শেষার্ধে আধুনিক ইতিহাস চর্চার এক গুরুত্বপূর্ণ শাখায় মর্যাদা পেয়ে মৌখিক ইতিহাস চর্চা। আধুনা বিশ্বের বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মৌখিক ইতিহাস বিশেষ মর্যাদা পেয়েছে।
(৩) বি. বি. সি-র প্রচেষ্ঠা : আধুনিক মৌখিক ইতিহাস চর্চার অগ্রগতি ও প্রসারে বি.বি.সি. (ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন)-র প্রচেষ্টায় স্মরণীয়। ১৯৯৮-৯৯ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এই আন্তর্জাতিক সংস্থাটি বিভিন্ন বেতার কেন্দ্র বিশ্বের নানান দেশের বহু ব্যক্তির মুখ থেকে মৌখিক ইতিহাস রেকর্ড করেন। এই রেকর্ড করা মৌখিক ইতিহাস বি.বি.সি. ‘The Century Speaks ‘ শিরোনামে ৬৪০ টি পর্ব সম্প্রচার করে।
৬. উদাহরণ
ইতিহাসে জনগৃক ইতিহাসিক হেরোডোটাস রচিত ইতিহাস গ্রন্থের গ্রিক পারস্যের মধ্যেকার যুদ্ধের বর্ণনা দিতে গিয়ে সেই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রত্যক্ষদর্শী লোকজনের মুখ থেকে সোনা যুদ্ধের ঘটনাবলী তিনি লিপিবদ্ধ করেন। প্রাচীন ভারতে আজাদের বৈদিক সাহিত্য শ্রুতি-সাহিত্য বলে অবহিত হয়েছে। প্রথম দিকে বেদ লিখিত অবস্থায় ছিল না। বংশ পরম্পরায় গুরুর কাছ থেকে শুনে শুনে শিষ্যরা এগুলি মনে রাখ তো বলে বেদের অপর নাম হয় শ্রুতি।
৭. সমালোচনা
(১) ভুল তথ্যের অনুপ্রবেশ : মৌখিক ঐতিহ্য লোক মুখে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে প্রচারিত হয়। তাই এতে অনেক সময় ভুল তথ্যের অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে।
(২) প্রক্ষিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা : বিভিন্ন অঞ্চলে, বিভিন্ন মৌখিক ঐতিহ্যের সুবাদে কোন কাহিনী ছড়িয়ে পড়ে। ফলে কাহিনীর ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয় না। এতে কাহিনী বা বিষয়বস্তুতে অনেক তথ্যসূত্র প্রক্ষিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়ে যায়।
৮. গুরুত্ব
মৌখিক ঐতিহ্য বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সমালোচিত হলেও এটি একেবারে গুরুত্বহীন নয়।
প্রথমত, ইতিহাসে প্রাথমিক উপাদান হিসেবে অনেক সময় মৌখিক ঐতিহ্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
দ্বিতীয়ত, সমাজের নিম্নবর্গের ইতিহাস রচনায় উৎস হিসেবে অনেক সময় মৌখিক ঐতিহ্যকে ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে কিংবদন্তি, প্রবাদ, স্মৃতিচারণ প্রভৃতির সাহায্য নেওয়া হয়।
তৃতীয়ত, ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে যখন প্রকৃতি লিখিত তথ্যের অভাব থাকে, তখন মৌখিক ঐতিহ্যই প্রধান অবলম্বন হয়ে ওঠে। তাই কানাডা সুপ্রিম কোর্ট এক ইতিহাসিক রায়ের বলেন – মৌখিক ইতিহাস বা ঐতিহ্য ও ইতিহাসে লিখিত তথ্যের মধ্যেই সমান গুরুত্বপূর্ণ।