মোগল সাম্রাজ্যের পতন কালে বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তি
১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মুঘল সাম্রাজ্য ক্রমে পতনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। এই সুযোগ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বেশ কয়েকটি স্বাধীন ও অর্থ স্বাধীন রাজ্যের উত্থান ঘটে। মুঘল প্রদেশ গুলি কয়েকজন শাসক ও মুঘল সম্রাটের প্রতি নামই মাত্র অনুগত জানিয়ে প্রায় স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতে থাকেন। মোগল সাম্রাজ্যের অবক্ষয়ের সময় ভারতে বিভিন্ন প্রান্তে কয়েকটি স্বাধীন বা অর্ধ স্বাদের আঞ্চলিক শক্তির উত্থান ঘটে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বাংলা, হায়দ্রাবাদ, অযোধ্যা, মহীশূর, মারাঠা প্রভৃতি। এসব রাজ্যগুলির অষ্টাদশ শতকে ভারতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১. বাংলা
মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেব তার বিশ্বস্ত অনুচর মুর্শিদ কুলি খাঁ কে বাংলার দেওনা অর্থাৎ রাজস্ব বিভাগের প্রদান কর্মচারী নিযুক্ত করেন ১৭০০ খ্রিস্টাব্দ। ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাংলা ও উড়িষ্যার সুবাদার বা নবাব নিযুক্ত হন। প্রকৃতপক্ষে এই সময় থেকে বাংলার স্বাধীন নবাবী শাসনের সূচনা হয়। মুর্শিদকুলি বাংলায় শান্তি-শৃঙ্খলা ও সুশাসন প্রবর্তন করেন। তার পরিবর্তে শাসক সুজাউদ্দিনের আমলে ১৭২৭-৩৯ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সঙ্গে বিহার যুক্ত হয়। পরবর্তী দুই নবাব সরফরাজ খাঁ ও আলীবর্দি খাঁ -র আমলে বাংলার স্বাধীনতা অক্ষুন্ন থাকলেও পরবর্তী নবাব সিরাজউদ্দৌলা পলাশীর যুদ্ধে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজদের কাছে পরাজিত হন। ফলে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়।
২. হায়দ্রাবাদ
দিল্লির মোগল দরবারে তুরানি গোষ্ঠীর অন্যতম নেতা মীর করমউদ্দিন তিন কলিজ খাঁ বা নিজাম-উল-মুলুক ১৭২খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট মোহাম্মদ শাহের প্রধানমন্ত্রী বা উজির নিযুক্ত হন। কিন্তু দুর্নীতিগ্রস্ত আমির-ওমরাহ এবং সম্রাট এর বিরোধিতা বিরক্ত হয়ে তিনি ১৭২৪ খ্রিস্টাব্দে উজির পথ ত্যাগ করেন এবং দক্ষিণাত্যে চলে যান। দক্ষিণাত্যের মোগল শাসিত দেশ গুলি কে নিয়ে হায়দ্রাবাদ কে কেন্দ্র করে তিনি প্রায় স্বাধীনভাবে রাজত্ব শুরু করেন। মোহাম্মদ শাহ তাঁকে দাক্ষিণাত্যের শাসনকর্তা বলে মেনে নেন এবং ‘আসফ ঝা’ উপাধি দেন।
৩. অযোধ্যা
মোগল আমলে অযোধ্যা ‘সুবা’ বা প্রদেশ বলতে বর্তমান অযোধ্যা, বরানসী, এলাহাবাদ ও কানপুরের একাংশ কে বোঝাত। ১৭২৪ খ্রিস্টাব্দে সাদাত খাঁ ১৬৮০-১৭৩৯ খ্রিস্টাব্দ অযোধ্যায় ‘সুবাদার’ না নবাব নিযুক্ত হন। তিনি অযোধ্যায় স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। সাদাত খাঁ অযোধ্যায় বংশানুক্রমিক শাসনের ভিত্তি রচনা করেন। অজয় ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে লর্ড ওয়েলসলির অধিনামূলক মিত্রতা চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্যায় ইংরেজদের অধীনস্থ হয়ে পড়ে।
৪. মহীশূর
নিরক্ষর ও ভাগ্যান্বেষী হায়দার আলী স্বাধীন মহীশূর রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। হায়দার প্রথম জীবনে মহীশুরের শাস ক নঞ্জরাজের অধীনে একজন সামান্য সৈনিক হিসেবে কাজ করতো। হায়দার ১৭৫৫ খ্রিস্টাব্দে দিন্দিগুলের ফৌজদার নিযুক্ত হন। পরে ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে নঞ্জরাজকে ক্ষমতা যুদ্ধ করে তিনি মহীশুরের সর্বময় কর্তা হয়ে ওঠেন। এভাবে স্বাধীন মহীশূর রাজ্যের উত্থান ঘটে। তার পুত্র টিপু সুলতান মহীশুরের ক্ষমতা যথেষ্ট বৃদ্ধি করেন। তবে চতুর্থ ইঙ্গ মহীশূর যুদ্ধের ১৭৯৮-99 খ্রিস্টাব্দের দিপু ইংরেজদের কাছে পরাজিত হন ও নিহত হলে স্বাধীন মহীশুরের পতন ঘটে।
৫. মারাঠা
মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের আমলে মারাঠা নেতা শিবাজী দাক্ষিণাত্যে মহারাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে শক্তি বৃদ্ধি করেন। শিবাজীর মৃত্যুর ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে একে একে শম্ভুজি, রাজা রাম, তৃতীয় শিবাজী ব্রোমক মারাঠা নেতা ওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যান। ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মুঘলদের হাত থেকে ছাড় পেয়ে শিবাজীর পুত্র শাহু মারাঠা সিংহাসনে বসে। তার আমলে একে একে বিভিন্ন মারাঠা পেশোয়া বা প্রধানমন্ত্রীর রাজ্যের প্রকৃত শাসন ক্ষমতা দখল করেন। শেষ পর্যন্ত তৃতীয় ইঙ্গ মারাঠা যুদ্ধে ১৮১৭-১৮ খ্রিস্টাব্দে মারাঠার ইংরেজদের কাছে পরাজিত হলে মারাঠা রাজ্যের বৃহদংশ ইংরেজদের দখলে চলে যায়।
উপসংহার
উপরে উক্ত রাজ্য গুলি ছাড়াও অষ্টাদশ শতকে আরো কয়েকটি ক্ষুদ্র স্বাধীন রাজ্যের উত্থান ঘটে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল রাজপূতন আর জয়পুরের অম্বর রাজ্য, আগ্রা ও মথুরা অঞ্চলে জাঠনেতা চুরামন ও বদন সিং এর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত ভরতপুর রাজ্য, আফগান নেতা মহম্মদ খা বঙ্গেশ এর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত ফারুখাবাদ রাজ্য, রোহিলা নেতা আলী মোহাম্মদ খাঁ নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত রোহিলা রাজ্য, শিখ নেতার রণজিৎ সিং এ নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত পাঞ্জাব রাজ্য প্রভৃতি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে মুঘল সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তূপ এর ওপর গড়ে ওঠার রাজ্যগুলিতে শীঘ্রই ইউরোপের বিভিন্ন উপনিবেশিক শক্তির, বিশেষ করে ব্রিটিশদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং অধিকাংশ রাজ্যয় পরবর্তীকালে ব্রিটিশদের অধিকারে চলে যায়।