মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে প্রেক্ষাপট ও পরিণতি সম্পর্কে আলোচনা করো?

ভূমিকা

ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি উল্লেখযোগ্য ধারা ছিল কমিউনিস্ট এর নেতৃত্বাধীন আন্দোলন 1925 খ্রিস্টাব্দে ২৬ ডিসেম্বর কানপুরে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই পার্টি দেশের কৃষক ও শ্রমিকদের ভারতের জাতীয় আন্দোলন শামিল করার চেষ্টা চালিয়ে যায়। বামপন্থার আদর্শের প্রসার এবং কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে ব্যাপক সৌমিক আন্দোলন ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে ভারতীয় কারণ হয়ে ওঠে। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে ডিসেম্বর মাসে কলকাতায় জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন বসে।

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিক এই অধিবেশনে যোগ দেয় এবং পূর্ণ স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রকে তাদের মূল লক্ষ্য বলে ঘোষণা করে। ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির অর্থাৎ বাম পন্থার প্রসার এবং কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব ব্যাপক শ্রমিক আন্দোলন ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এজন্য সরকার এদেশের বামপন্থার অগ্রগতি ও শ্রমিক আন্দোলন কে স্তব্ধ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এর মধ্যে অন্যতম ছিল মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে।

মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার প্রেক্ষাপট

ব্রিটিশ সরকার ৩৩ জন কমিউনিস্ট নেতাদের বিরুদ্ধে ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা শুরু করে। এই মামলার প্রেক্ষাপট নিচে উল্লেখ করা হলো-

১. শ্রমিক আন্দোলন

ভারতের বিভিন্ন কারখানায় কমিউনিস্ট পার্টি নেতৃত্বে শ্রমিক অসন্তোষ বাড়তে থাকে। কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দ শ্রমিকদের অভাব অভিযোগ নিয়ে আন্দোলনে স্বরূপ হলে ভারতের বিভিন্ন কলকারখানা শ্রমিক না কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে আন্দোলনে সামিল হয়। শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি প্রদান, কাজের সময় হ্রাস, বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথার বিলোপ, সংবাদপত্র ও বাক স্বাধীনতা, ট্রেন্ড ইউনিয়নে স্বাধীনতা প্রভৃতি দাবিতে বিভিন্ন স্থানে শ্রমিক আন্দোলন শুরু হয়। শ্রমিক আন্দোলনের ধারাবাহিক প্রসারে সরকার আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।

২. হুইটলি কমিশন

শ্রমিকদের ক্ষোভ বৃদ্ধি ও আন্দোলনের প্রচারে পরিপ্রেক্ষিতে সরকার তাদের খুব আন্দোলন দমনের উদ্যোগ নেয়। এই উদ্দেশ্যে সরকার ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে হুইটলি কমিশন গঠন করে। এর দ্বারা সরকার প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে শ্রমিকদের উন্নতির বিষয়ে জাতীয় নেতৃবৃন্দের চেয়ে সরকারি বেশি আগ্রহী। কিন্তু শ্রমিকরা এই কমিশন বর্জন করে।

৩. শ্রমিক-স্বার্থ বিরোধী আইন

বড়লাট লর্ড আর‌উইন শিল্প বিরোধ বিল ও জননিরাপত্তা বিল নামে শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী দুটি আইন পাশের উদ্যোগ নেন। শিল্প বিরোধ বিলের দ্বারা শ্রমিকদের ধর্মঘট বেআইনি ঘোষিত হয় এবং সালিশি কমিটির মাধ্যমে শ্রমিক মালিক বিরোধের মীমাংসার কথা বলা হয়। জননিরাপত্তা বিলের দ্বারা কমিউনিস্টের দমনের উদ্যোগ নেয়া হয়।

৪. মামলা

কমিউনিস্টদের কার্যকলাপ ও শ্রমিক আন্দোলন দমন করার উদ্দেশ্যে সরকার ১৯-২৯ খ্রিস্টাব্দে ভাঙ্গে-সহ ৩২ জন কমিউনিস্ট শ্রমিক নেতা কে গ্রেফতার করে তাদের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করে। এটি মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা নামে পরিচিত। অভিযুক্ত ৩৩ জন কমিউনিস্ট নেতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মুজাফফর আহমেদ, শিবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ধরণী গোস্বামী, শ্রীপাত অমৃত ডাঙ্গে, পি. সি. জোশী, গঙ্গাধর অধিকারী প্রমো অভিযুক্তদের মধ্যে তিনজন ব্রিটিশ নাগরিকও ছিলেন। এরা হলেন ফিলিপ স্প্র্যাট, বেঞ্জামিন ফ্রান্সিস ব্রাডলি এবং লেসটার হাচিনসন।

মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার পরিণতি

মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে থেকে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত চলে। এই মামলার গ্রেফতার হওয়া কমিউনিস্ট ইন্টারনেটের পক্ষে স‌ওয়াল করেন জহরলাল নেহেরু, এম. সি. চাগালা প্রমুখ। মামলার পরিণতি কমিউনিস্টদের পক্ষে মোটেই ভালো হয়নি, যেমন-

১. মামলা রায়

১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার গায়ে কমিউনিস্ট পার্টি যাবতীয় প্রচারকার্য নিষিদ্ধ করা হয়। বিভিন্ন কমিউনিস্ট নেতাদের বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড ঘোষণা করা হয়। দীর্ঘ মিয়াদি কারাদণ্ডপ্রাপ্ত নেতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মুজাফফর আহমেদ, শওকত উসমানী, কে. এন. জোগেলকর, শ্রীপাত অমৃত ডাঙ্গে, শিবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ধরণী গোস্বামী, পি. সি. যোশি, গঙ্গাধর অধিকারী ও ফিলিপ স্প্র্যাট প্রমুখ।

২. গান্ধীজীর ভূমিকা

কংগ্রেস নেতা গান্ধীজি মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার অভিযুক্ত কমিউনিস্টদের পক্ষ সমর্থন করেন। তিনি জেলে গিয়ে বন্দী নেতাদের শুভেচ্ছা জানান।

৩. অন্যান্য পদক্ষেপ

ভারতে কমিউনিস্ট আদর্শের প্রসার, শ্রমিক ইউনিয়ন গুলি সক্রিয়তা, শ্রমিক আন্দোলন প্রভৃতির স্তব্ধ করতে সরকার মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার পাশাপাশি আরও বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

৪. পার্টির ওপর নিষেধাজ্ঞা

বিভিন্ন কমিউনিস্ট নেতাদের ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে কমিউনিস্ট দলের প্রভাব আন্দোলনের গতি বৃদ্ধি পায়। শ্রমিক আন্দোলনের কমিউনিস্ট দলের প্রভাব লক্ষ্য করে সরকার ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুলাই কমিউনিস্ট পার্টির এবং তার সকল শাখা সংগঠনকে নিষেধ ঘোষণা করে। কিন্তু তার সাথে ও কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে কমিউনিস্ট দলের প্রভাব অক্ষুন্ন ছিল।

৫. বামপন্থী আদর্শের প্রসারে পরোক্ষ সহায়তা

মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা ভারতের বামপন্থার প্রসারে পরোক্ষভাবে সহায়তা করে। জেলে বন্দি বামপন্থী নেতাদের আদর্শ ও বক্তব্য সংবাদপত্রের মাধ্যমে দেশবাসী কাছে পৌঁছলে ভারত সমাজতন্ত্রের আদর্শ দ্রুত প্রসার লাভ করে।

উপসংহার

মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার পরোক্ষভাবে ভারতে বামপন্থার প্রসারে সহায়তা করে। জেলে মনি বামপন্থী নেতাদের আদর্শ ও বক্তব্য সংবাদপত্রের মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে পৌঁছলে ভারতের সমাজতন্ত্রের আদর্শ দ্রুত প্রসার লাভ করে। ফলে স্বাধীনতা আন্দোলনে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বইয়ের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর

Leave a Comment