আকবর ও সুলেমানের কৃতিত্বের তুলনা / পার্থক্য
খ্রিস্টীয় ষােড়শ শতক বিশ্বের মুসলিম ইতিহাসে গৌরবােজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এই শতকে প্রথম সেলিমের পুত্র সুলেমান (১৫২০-১৫৬৬ খ্রিস্টাব্দ) তুরস্কের অটোমান সিংহাসনে এবং হুমায়ুনের পুত্র আকবর (১৫৫৬-১৬০৫ খ্রিস্টাব্দ) ভারতের মােগল সিংহাসনে আরােহণ করেন। তাদের কৃতিত্বের জন্য আকবর ‘The Great’ এবং সুলেমান The Magnificent’ নামে পরিচিত হন। নীচে আকবর ও সুলেমানের কৃতিত্বের তুলনামূলক আলােচনা করা হল一
আকবর
- মােগল সম্রাট আকবর তার ক্ষুদ্র সাম্রাজ্যের সীমানা বহুদূর বিস্তৃত করেন। তিনি তার মৃত্যুর কিছুকাল পূর্ব পর্যন্ত সাম্রাজ্যবাদী নীতির মাধ্যমে ভারতের বৃহদংশে মােগল সাম্রাজ্যের প্রসার ঘটান। তার মৃত্যুকালে মােগল সাম্রাজ্য উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে নর্মদা নদী ও পূর্বে ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে পশ্চিমে হিন্দুকুশ পর্বত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
- একজন সুনির্মাতা হিসেবে আকবর যথেষ্ট কৃতিত্বের ছাপ রাখেন। তার নির্মিত স্থাপত্যকীর্তিগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল দেওয়ান-ই-আম, দেওয়ান-ই-খাস, জামি মসজিদ, বুলন্দ দরওয়াজা, হূমায়ুনের সমাধি প্রভৃতি।
- মােগল সম্রাট আকবর ধর্মসহিষুতার এক অনন্য নজির স্থাপন করেন। আকবর সুল-ই-কুল’ বা ধর্মীয় সমন্বয়ের আদর্শ প্রচার করেন, অ-মুসলিমদের ওপর থেকে জিজিয়া কর ও তীর্থকর তুলে দেন এবং উচ্চ রাজপদে বহু হিন্দু ও রাজপুতকে নিয়ােগ করেন।
- আকবর শাসনকার্যের সুবিধার জন্য তার সাম্রাজ্যকে ১৮ টি প্রদেশ বা সুবায় ভাগ করেন এবং জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে একই ধরনের শাসনরীতি চালু করেন। ইতিহাসবিদ লেনপুল বলেছেন যে, “আকবর ছিলেন ভারতে রাজত্বকারী সকল সম্রাটদের মধ্যে মহত্তম।
- আকবর জ্ঞানীগুণী ও বিদ্বানের সমাদর ও পৃষ্ঠপােষকতা করতেন। ‘নবরত্ন’ নামে যে নয়জন জ্ঞানীগুণী তার রাজসভা অলংকৃত করেন, তাদের মধ্যে ছিলেন আবুল ফজল, ফৈজি, ভগবান দাস, বীরবল, টোডরমল, তানসেন, মানসিংহ প্রমুখ। তার আমলে হিন্দি, ফারসি-সহ বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষা ও সাহিত্য, চিত্রশিল্প ও সংগীতের প্রভূত উন্নতি ঘটে।
- আকবরের মধ্যে বিভিন্ন রাজকীয় প্রতিভার সমাবেশ ঘটেছিল। বিভিন্ন ঐতিহাসিক আকবরকে মােগল বংশের শ্রেষ্ঠ সম্রাট বলে স্বীকার করে নিয়েছেন। ইতিহাসবিদ কে. টি. শাহ বলেছেন যে, “আকবর শুধু মােগল যুগের নয়, তিনি ছিলেন মৌর্য পরবর্তী ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট।”
সুলেমান
- অটোমান সুলতান সুলেমানও সিংহাসনে বসার পর থেকে সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণ করেন এবং রাজত্বকালের বেশিরভাগ সময় জুড়ে তিনি রাজ্যসীমার প্রসার ঘটান। তিনি অটোমান সাম্রাজ্যের আয়তন দ্বিগুণ বৃদ্ধি করেন। তিনি ইউরােপের পূর্ব অংশ, মধ্যপ্রাচ্য, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল প্রভৃতি এক সুবিস্তৃত ভূখণ্ড অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে আনেন।
- অটোমান তুর্কি সুলতান সুলেমানও ছিলেন সুনির্মাতা। তিনি বিভিন্ন মসজিদ, বিদ্যালয়, নগর-প্রাচীর, সেতু, দুর্গ প্রভৃতি নির্মাণ করেন এবং ইস্তানবুল নগরীর পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। সুলেমানীয় মসজিদ তাঁর অন্যতম কীর্তি।
- অটোমান সুলতান সুলেমানও ছিলেন পরধর্মসহিষ্ণু শাসক। তিনি তার বিশাল সাম্রাজ্যে বসবাসকারী বিভিন্ন ধর্মের মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। হ্যাপসবার্গ বংশের রাষ্ট্রদূত বাসবে বলেছেন যে, সুলেমানের সুসংগঠিত মুসলিম সাম্রাজ্যে খ্রিস্টানরা নিরাপদে বসবাস করতে পারত।
- অটোমান সুলতান সুলেমানও তার সাম্রাজ্যে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সামরিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থায় নানা উন্নয়নমূলক সংস্কার সাধন করেন। বিভিন্ন আইন রচনা করে তিনি প্রাচ্যে ‘আইন-প্রণেতা (Law Giver), হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
- শিল্প, সাহিত্য ও বিজ্ঞানের অনুরাগী অটোমান সুলতান সুলেমানও শিল্পী, বিদ্বান ও বিজ্ঞানীদের পৃষ্ঠপােষকতা করেন। তার আমলে এবং তার পৃষ্ঠপােষকতায় সাহিত্য, শিল্প, সংগীত প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটে। তিনি নিজেও ‘মুহিবর’ (Muhibbr) ছদ্মনামে বহু কবিতা লিখেছেন।
- সুলেমানের রাজত্বকালে অটোমন সাম্রাজ্য গৌরবের চূড়ান্ত শিখরে উন্নিত হয়। শেকসপিয়র তাঁর ‘মারচেন্ট অব ভেনিস’ নাটকে সুলেমানের প্রতিভার প্রশংসা করেছেন। দেশের স্বার্থে আকবর যেমন রাজপুত জাতির সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করেন, সুলেমানও পবিত্র রােমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ফ্রান্সের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করেন।