সূচনা: আকবর মােগলপ্রশাসনের এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসেবেতিনি ভারতে প্রথম মনসবদারি প্রথা চালু করেন (১৫৫৭ খরি.)। সামরিক অসামরিক যে-কোনাে কর্মচারী মনসবদার হতে পারতেন।
মনসবদারি ব্যবস্থা
[1] অর্থ: ‘মনসব’ কথাটির আক্ষরিক অর্থ “পদমর্যাদা’, মতভেদে উচ্চপদ বা অবস্থান। এই অর্থে মনসবদার হলেন প্রশাসনের উচ্চপদাধিকারী। মােগল যুগে ‘মনসব’ শব্দটি একটি পদকে বােঝাত। ধীরে ধীরে এই পদের সঙ্গে দায়িত্ব, মর্যাদা প্রভৃতি যােগ হয়।
[2] প্রেক্ষাপট: আকবরের আগে পর্যন্ত মােগল প্রশাসনের সামরিক, বেসামরিক সমস্ত উচ্চপদস্থ কর্মচারীকে বেতনের বদলে জায়গির প্রদান করা হত। কিন্তু ধীরে ধীরে এই ব্যবস্থায় নানা দুর্নীতির অনুপ্রবেশ ঘটলে নতুন এক প্রথা প্রবর্তনের প্রয়ােজনীয়তা দেখা দেয়। অপরদিকে যথেষ্ট হারে জায়গির বিতরণ করায় ‘খালিসা’ জমির পরিমাণ কমে যায়। এই প্রেক্ষাপটে প্রবর্তিত হয় মনসবদারি প্রথা।
[3] বিভিন্ন স্তর: আবুল ফজল তার আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, আকবর মনসবদারদের ৬৬টি Rank বা পদমর্যাদার স্তর ধার্য করেন। সর্বনিম্ন স্তরে ছিল ১০ জন অশ্বারোহী সেনাবিশিষ্ট সেনাপতি এবং সর্বোচ্চস্তরেছিল ১০ হাজার অশ্বারোহী সেনাবিশিষ্ট সেনাপতি। তবে আবুল ফজলের ধারণায় কাগজে কলমে ৬৬টিস্তর দেখানাে হলেও প্রকৃত অর্থেমনসবদারিব্যবস্থায় ৩৩টি স্তর ছিল বলে ইতিহাসবিদরা মনে করেন।
[4] বেতন: মােগল যুগে মনসবদারদের বেতন খুব একটা কম ছিল না|স্তরভিত্তিক মনসবদারগণ বেতন পেতেন। মনসবদারদের যা বেতন দেওয়া হত, সমস্ত খরচ মেটানাের পরেও তাদের হাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে টাকা অবশিষ্ট থাকত।
[5] জাঠ ও সওয়ার: মনসবদার নামকরণের সঙ্গে জাঠ ও সওয়ার নামে দুটি পদ যুক্ত ছিল। এই দুই পদের স্বরূপ ও অর্থ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবু বলা হয় যে, জাঠ হল মনসবদারের ব্যক্তিগত পদমর্যাদা ও তার প্রাপ্ত বেতনের পরিচয়। আর সওয়ার হল মনসবদারের অধীনস্থ সেনার পরিচয়। আকবর তার রাজত্বকালের ৪০তম বর্ষে (১৫৯৫-৯৬ খ্রি.) জাঠ ও সওয়ার পদ দুটি চালু করেন।
[6] মনসবদারি প্রথার ফলাফল: [i] আকবর ও তাঁর পরবর্তী সম্রাটগণ মনসবদারি প্রথার সাহায্যে এক বিশাল সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন [ii] মনসবদার পদ এবং এর সঙ্গে যুক্ত জায়গির বংশানুক্রমিক না হওয়ায় মােগল যুগে সামন্ত প্রথার উদ্ভব ঘটেনি৷ [iii] মনসবদারি প্রথার ফলেই মােগল প্রশাসনে বিদেশি অভিজাত শ্রেণি, যথা- উজবেগি, আফগানি, তুরানি, ইরানি, এদের প্রাধান্য খর্ব হয়। [iv] মনসবদারি প্রথার ফলে মােগল রাজতন্ত্র শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
[7] ত্রূটি: মনসবদারি প্রথা ত্রূটিমুক্ত ছিল না। [i] মনসবদারি প্রথা ছিল এক জটিল ও অস্থায়ী পদ্ধতি। সময়ের সাথে সাথে এই প্রথার মধ্যে প্রশাসনিক জটিলতা বাড়তে থাকে। [ii] বেশিরভাগ মনসবদারদের অধীনস্থ সেনারা ছিল অদক্ষ অযোগ্য। [iii] বহু ক্ষেত্রে মনসবদারদের অধীনস্থ সেনাদের সঙ্গে সম্রাটের তরফে কোনাে যােগসূত্র না থাকায়, তাদের মধ্যে সম্রাট বা মােগল সাম্রাজ্যের প্রতি কোনাে আনুগত্য গড়ে ওঠেনি। এজন্য আরভিন (Irvine) বলেছেন—“মােগল সামরিক ব্যবস্থার মধ্যেই মােগলদের ধ্বংসের বীজ লুকিয়েছিল।”
উপসংহার: আকবর প্রবর্তিত মনসবদারি প্রথা ছিল সম্পূর্ণ নতুনভাবে উপস্থাপিত পুরানাে একটি প্রথা। আকবরের নিজ দক্ষতা গুণে এই প্রথায় সম্মিলিতভাবে সেনানায়ক, অভিজাতশ্রেণি ও আমলা সম্প্রদায় রাষ্ট্রের সেবায় নিয়ােজিত ছিল।