মন্ত্রীসভার সঙ্গে সম্পর্কের নিরিখে ডারতের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও পদমর্যাদা
ভারতের রাষ্ট্রপতির শাসনতান্ত্রিক পদমর্যাদার প্রশ্নটি নিয়ে সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মধ্যে যথেষ্ট মতানৈক্য লক্ষ করা যায়। অনেকে তাঁকে জাঁকজমকপূর্ণ সাক্ষীগোপাল (magnificent cipher) বা নামসর্বস্ব শাসক বলতে চান। আবার অনেকে তাঁকে প্রকৃত শাসক (real executive) হিসেবে অভিহিত করার পক্ষপাতী।
রাষ্ট্রপতিকে নামসর্বস্ব শাসক বলার যুক্তি
[1] সংসদীয় শাসনব্যবস্থা: ভারতে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা অনুসৃত হওয়ায় এখানে দেশের প্রকৃত শাসনক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রীসভাকে দেওয়া হয়েছে। সংবিধানের ৭৫(৩) নং ধারা অনুসারে, মন্ত্রীসভা তার সম্পাদিত কাজকর্মের জন্য রাষ্ট্রপতির বদলে লোকসভার কাছে দায়বদ্ধ থাকে। কাজেই তত্ত্বগতভাবে রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের প্রধান হলেও শাসন বিভাগের প্রধান নন।
[2] সাংবিধানিক স্বীকৃতি: সংবিধানের ৭৪ (১) নং ধারায় বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্রপতিকে তাঁর কাজকর্মে সাহায্য করা ও পরামর্শ দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন একটি মন্ত্রীসভা থাকবে। ৪৪তম সংবিধান সংশোধনী অনুসারে, রাষ্ট্রপতি মন্ত্রীসভার কোনো পরামর্শ বা সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য ফেরত পাঠাতে পারেন, কিন্তু পুনর্বিবেচনার পর মন্ত্রীসভা যদি দ্বিতীয়বার একই পরামর্শ দেয় তাহলে মন্ত্রীসভার সেই পরামর্শ বা সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ করতে রাষ্ট্রপতি বাধ্য থাকবেন। অনুরূপভাবে, রাষ্ট্রপতি পার্লামেন্টের পাঠানো কোনো বিলে সম্মতি না দিয়ে বিলটিকে পুনর্বিবেচনার জন্য ফেরত পাঠালে সংশ্লিষ্ট বিলটি পার্লামেন্টের উত্তয়কক্ষে পুনরায় গৃহীত হলে রাষ্ট্রপতি তাতে স্বাক্ষর দিতে বাধ্য থাকেন।
[3] জরুরি ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা: সংবিধানের ৪৪তম সংশোধনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির জরুরি অবস্থা সংক্রান্ত ক্ষমতাকে সংকুচিত করা হয়েছে। বর্তমানে রাষ্ট্রপতি মন্ত্রীসভা বা ক্যাবিনেটের লিখিত সুপারিশ ছাড়া জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন না [৩৫২(৩) নং ধারা]। যে-কোনো ধরনের জরুরি অবস্থার ঘোষণার বিষয়টি একমাসের মধ্যে সংসদের উভয়কক্ষের উপস্থিত করতে হয়। এক্ষেত্রে ভোটদানকারী সদস্যদের দুই- তৃতীয়াংশের অনুমোদন প্রয়োজন তা না হলে ঘোষণাটি বাতিল হয়ে যায়।
[4] সামরিক ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা: রাষ্ট্রপতির সামরিক ক্ষমতা সংসদীয় আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। জাতীয় প্রতিরক্ষা কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি তাঁর সামরিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকেন।
[5] পরোক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা: রাষ্ট্রপতি জনগণের ভোটে সরাসরি নির্বাচিত হন না। এই কারণে রাষ্ট্রপতি জনপ্রতিনিধিত্বের দাবি করতে পারেন না। অনেকে বলেন যে, রাষ্ট্রপতির পরোক্ষ নির্বাচনের সাংবিধানিক ব্যবস্থা এটা নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে যে ভারতের সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত মন্ত্রীসভা হল প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী, রাষ্ট্রপতি নন।
[6] স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতার অনুপস্থিতি: সংবিধান বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে রাজ্য প্রশাসনে রাজ্যপালের হাতে যেরকম ‘স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা’ ন্যস্ত রয়েছে, রাষ্ট্রপতির হাতে তেমন কোনো ক্ষমতা দেওয়া হয়নি।
ররাষ্ট্রপতিকে প্রকৃত শাসক বলার যুক্তি
[1]প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রীদের নিয়োগ-সম্পর্কিত বিষয়ক ক্ষমতা: সংবিধানের ৭৫(১) নং ধারা অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রীপরিষদের নিয়োগকর্তা হলেন রাষ্ট্রপতি। ৭৫(২) নং ধারা অনুযায়ী, মন্ত্রীদের স্বপদে অধিষ্ঠিত থাকা রাষ্ট্রপতির সন্তুষ্টির ওপর নির্ভরশীল। সংসদীয় গণতন্ত্রের রাতি অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি লোকসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের বা সংখ্যাগরিষ্ঠ জোটের নেতা বা নেত্রীকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করেন। কিন্তু সংবিধানে সম্পর্কে কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয়নি। তা ছাড়া লোকসভায় কোনো দল বা জোট সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে ব্যর্থ হলে রাষ্ট্রপতি স্ববিক্টেনা অনুসারে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করতে পারেন।
[2] সাংবিধানিক স্বীকৃতি: সংবিধানের ৫৩(১) নং ধারায় কেন্দ্রীয় সরকারের সমগ্র শাসনক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে দেওয়া হয়েছে। সংবিধানে বলা হয়েছে, তিনি নিজে বা তাঁর অধস্তন কর্মচারীদের মাধ্যমে এই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন। সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে, এর অর্থ হল সংবিধান প্রত্যক্ষভাবে রাষ্ট্রপতির হাতে দেশের সমগ্র শাসনভার অর্পণ করেছে, মন্ত্রীসভার হাতে নয়।
[3] অধ্যাদেশ বা অর্ডিন্যান্স জারির ক্ষমতা: সংসদের অধিবেশন বন্ধ থাকাকালীন রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ বা ‘অর্ডিন্যান্স’ জারি করতে পারেন। এ অর্ডিন্যান্স আইনের মতো সমানভাবে কার্যকরী হয়। তবে অর্ডিন্যান্স জারির দিন থেকে ছয় সপ্তাহের মধ্যে সেটিকে অনুমোদনের জন্য সংসদে পেশ করতে হয়। সংসদ অনুমোদন না দিলে সংশ্লিষ্ট অর্ডিন্যান্সটি বাতিল বলে গণ্য হয়। কাজেই রাষ্ট্রপতি অন্তত ছয় সপ্তাহের জন্য স্বেচ্ছায় প্রশাসনিক কাজকর্ম পরিচালনা করতে সক্ষম। এ ছাড়া সংবিধানে কোথাও বলা হয়নি যে, রাষ্ট্রপতি মন্ত্রীসভার পরামর্শ অনুসারে অর্ডিন্যান্স জারি করবেন বা করতে বাধ্য থাকবেন।
[4] নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি: ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের শাসনতান্ত্রিক প্রধান রাজা বা রানির সঙ্গে যাঁরা ভারতের রাষ্ট্রপতির তুলনা করেন তাদের অভিমত যথার্থ নয় বলে অনেকে মনে করেন। যুক্তরাজ্যের রাজা বা রানির পদ বংশানুক্রমিক, অন্যদিকে ভারতের রাষ্ট্রপতি পাঁচ বছরের জন্য কেন্দ্র ও রাজা আইনসভার প্রতিনিধিদের দ্বারা সাংবিধানিকভাবে নির্বাচিত হন। কাজেই ব্রিটেনের রাজা বা রানির মতো ভারতের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে নিছক নিয়মতান্ত্রিক শাসক বলে অভিহিত করা ঠিক নয়।
[5] সাংবিধানিক সংকট নিরসনের ক্ষমতা: ভারতের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ত্রিশঙ্কু লোকসভার ক্রমবর্ধমান প্রবণতায় রাষ্ট্রপতির ভূমিকা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ও অনিবার্য হয়ে উঠেছে। এই প্রসঙ্গে, ১৯৯৯ সালের এপ্রিল মাসে লোকসভায় আস্থাভোট গ্রহণের জন্য বাজপেয়ী সরকারকে রাষ্ট্রপতি কোচিরিল রামন নারায়ণনের নির্দেশ এবং আস্থাডোটে সরকার পরাজিত হওয়ার পর বিরোধীরা সরকার গঠনে ব্যর্থ হলে লোকসভা ভেঙে দিয়ে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্দেশ দেওয়ার ঘটনা উল্লেখ করা যায়।
[6] সংবিধান রক্ষার দায়িত্ব: সংবিধানকে রক্ষা করার জন্য রাষ্ট্রপতিকে শপথ নিতে হয় (৬০ নং ধারা)। এই ধারা অনুসারে, মন্ত্রীসভার কোনো পরামর্শকে অসাংবিধানিক মনে করলে রাষ্ট্রপতি তা গ্রহণ নাও করতে পারেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ, ১৯৯৭ এবং ১৯৯৮ সালে যথাক্রমে উত্তরপ্রদেশে ও বিহারে ৩৬৫ নং ধারা জারির জন্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সুপারিশের ঘটনা দুটি উল্লেখ করা যায়। তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি কে আর নারায়ণন এই দুটি ঘটনায় এক নজিরবিহীন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি মন্ত্রীসভার সুপারিশ অনুমোদন না করে তা পুনর্বিবেচনার জন্য ফেরত পাঠিয়ে দেন। অনুরূপ দৃষ্টান্ত সেবে, ২০০৬ সালের মে মাসে রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালাম কর্তৃক । কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার ‘লাভজনক পদ’-সম্পর্কিত বিল পুনর্বিবেচনার জন্য ফেরত পাঠিয়ে দেওয়ার ঘটনা উল্লেখ করা যায়।
উপসংহার: উপরোক্ত আলোচনার শেষে বলা যায়, ভারতের রাষ্ট্রপতিকে নিম্নক নামসর্বস্ব শাসক বা জাঁকজমকপূর্ণ সাক্ষীগোপাল বলে অভিহিত। করা যায় না। ভারতের রাষ্ট্রপতি সংবিধানের রক্ষাকর্তা ও জাতির প্রতীক। সাধারণত এই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সীমিত হলেও লোকসভা নির্বাচনে কোনো দল বা জোট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হলে বা প্রধানমন্ত্রী লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন হারালে রাষ্ট্রপতির। ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।