ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সমর্থক উপযোগবাদী জেমস মিলে দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা করো? অথবা, ভারতের ইতিহাস উপযোগবাদী ব্রিটিশ দার্শনিক জেমস মিলের দৃষ্টিভঙ্গির কিরূপ ছিল?

জেমস মিল

ভারতের ব্রিটিশ শাসন ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ঘটনাকে বিভিন্ন ঐতিহাসিক গোষ্ঠী বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করেছেন। এসব দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো – (১) সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি (২) জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি (৩) মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। আধুনিক ব্রিটিশ ঐতিহাসিকগণ ব্রিটিশ পাঠকদের কথা ভেবে এবং সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে আধুনিক ভারতে ইতিহাস রচনা বা ব্যাখ্যা করেছেন। ব্রিটিশ উপযোগীবাদী বা হিতবাদী দার্শনিক গন মনে করেন যে, ভারতে উপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসন ভারতবাসীর পক্ষে কল্যাণকর ও আশীর্বাদ স্বরূপ ছিল। ভারতে ইতিহাস রচয়িতা উপযোগীবাদী দার্শনিকদের মধ্যে সর্বাধিক অগ্রগণ্য ছিলেন বিখ্যাত ঐতিহাসিক ও রাষ্ট্র নীতিবিদ জেমস মিল ১৭৭৩-১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে। ভারতের ইতিহাস রচনা ও এদেশের ব্রিটিশ শাসন সম্পর্কে তা দৃষ্টিভঙ্গি নিচে উল্লেখ করা হলো-

১. ভারতের ইতিহাস রচনা

স্কটল্যান্ড এর বাসিন্দা জেমস মিল লন্ডনে অবস্থানকালে উপযোগবাদী দর্শনের অন্যতম প্রবক্তা জেরেমি বেন্থামের দর্শনের দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত হন। কখনো ভারতে না এসে বিভিন্ন তথ্য, মহাফেজখানার নথিপত্র প্রভৃতি ওপর ভিত্তি করে তিনি ভারতের ব্রিটিশদের সম্রাট প্রতিষ্ঠার ইতিহাস বিষয়ে দ্য হিস্ট্রি অফ ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি এই গ্রন্থটি রচনা করে ব্রিটিশ সরকারের সুনজরে আসেন এবং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উচ্চ পদে চাকরি লাভ করেন। তার মতে, একজন যোগ্য ব্যক্তি সারা জীবন ভারতে বসবাস করে ভারত সম্পর্কে যে জ্ঞান অর্জন করতে পারবেন, ইংল্যান্ড একটি ছোট্ট ঘরে মাত্র এক বছর চর্চা করে ভারত সম্পর্কে আরো বেশি জ্ঞান লাভ।

২. দৃষ্টিভঙ্গি

১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে তিন খন্ডে প্রকাশিত দার হিস্ট্রি অফ ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান গ্রন্থের জেমস মিল সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতে ইতিহাস রচনা করেছেন। এই গন্ধে তিনি ভারতে হিন্দু সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে পাশ্চাতপদ ও নিকৃষ্ট বলে উল্লেখ করে এবং তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি ভারতীয় সমসাকে তিনটি শাখায় বিভক্ত করেছে, যথা- (১) সরকার রূপ (২) আইনের প্রকৃতি (৩) করব্যবস্থা। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, এই তিনটি বিভাগের সংস্কার করলে ভারতীয় সমাজের উন্নয়ন সম্ভব হবে।

৩. মুখ বিভাজন

ঐতিহাসিক জেমস মিল ভারতের ইতিহাস কে তিনটি যুগে ভাগ করেছেন। যথা- (১) হিন্দু যুগ (২) মুসলিম যুগ (৩) ব্রিটিশ যুগ। এই তিন যুগের সভ্যতা কে তিনি যথাক্রমে হিন্দু সভ্যতা, মুসলিম সভ্যতা ও ব্রিটিশ সভ্যতা বলে উল্লেখ করেছেন। মিলের এই সাম্প্রদায়িক চিন্তাকে ঐতিহাসিক স্যার হেনরি এলিট সমর্থন করেছেন।

৪. ভারতীয় সভ্যতার পশ্চাদ গামিতা

পাশ্চাত্য সভ্যতার শ্রেষ্ঠ তে বিশ্বাসী জেমস মিলের কাজে প্রাচীন ভারত দাতা প্রাচ্যের সকল সভ্যতায় পশ্চাৎপদ বলে মনে হয়েছিল। তার মতে, ভারতীয় সমাজ ছিল অত্যন্ত পিছিয়ে পড়া এমন কি ইউরোপের সমান্ততান্ত্রিক যুগের চেয়েও নিম্নমানের। জেমস মিল মনে করতেন যে অষ্টাদশতকে ভারতীয়দের দুর্দশা আসলে তাদের অতীত দুর্দশার স্বাভাবিক পরিণতি। ভারতীয় ইতিহাসের বিভিন্ন চিত্র, ধর্ম, সাহিত্য, শিল্প, আইন বিধি প্রভৃতি সবকিছুকে জেমস মিল নিকৃষ্ট বলে মনে করতেন। এইভাবে মিল ভারতীয়দের বর্তমানে দুরবস্থার জন্য অতীতকে দায়ী করে ব্রিটিশ শাসনকে দায় মুক্ত করার চেষ্টা করেছে।

৫. ব্রিটিশ শাসনকে সমর্থন

জেমস মিলের মতে, কোন অধিক তার উন্নতি জাতি অপেক্ষা কৃত কম উন্নতির জাতির উন্নতি ঘটানো সহায়তা করতে পারে। ব্রিটিশরা উন্নত সভ্যতার অধিকারী বলে তাদের শাসনাধীন ভারতীয় সভ্যতার উন্নতি ঘটবে। মিল মনে করতেন যে ভারতীয় সভ্যতা উন্নত তার হলে ব্রিটিশ জাতির ওপর ভারতীয়দের শাসন ও যুক্তিসঙ্গত হতো। জেমস মিলে দৃষ্টিভঙ্গি তার সামরিক সাম্রাজ্যবাদী ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিনিধি মূলক ছিল।

৬. ব্রিটিশ শাসনের প্রয়োজনীয়তা

জেমস মিল মনে করতেন যে, ভারতীয় স্বৈরাচারী ব্রিটিশ শাসনের প্রসারে খুব জরুরী। ভারতীয়দের স্বায়ত্ত শাসন বা স্বাধীনতা দানের কোন প্রশ্নই ওঠে না। ভারতে অনন্তকাল ধরে ব্রিটিশ শাসন টিকে থাকবে। ভারতের ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠা হওয়ায় ভারতীয়রা ব্রিটিশ সভ্যতার সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেয়েছে। ব্রিটিশ শাসনের মধ্যে ইউরোপীয় জ্ঞান, শিল্প, রীতিনীতি প্রভৃতি ভারতীয়দের মধ্যে প্রসারিত হলে অর্ধসভ্য ভারতীয়রা সভ্য হয়ে উঠবে। তারা যত সভ্য হবে ততই সুখি হয়ে উঠবে।

৭. জোন্সের দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতা

ব্রিটিশ প্রাচ্যবিদ স্যার উইলিয়াম জোন্স মনে করতেন যে, ভারতের পৌরাণিক ও কল্পকাহিনী থেকে দেশে সাহিত্য রচনা করা সম্ভব। প্রাচ্য দেশীয় গ্রন্থ বলি অনুবাদের দ্বারা ইউরোপীয় সাহিত্য আরো সমৃদ্ধ হতে পারে। কিন্তু মিল জন্সের দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতা করে জন্সের দৃষ্টিভঙ্গিকে রক্ষণশীল আখ্যা দেন। মিল মনে করতেন যে, কোন দেশের সংস্কৃতি পরিচয়ের ক্ষেত্রে তার অতীতে কোন প্রাসঙ্গিকতা নেই। তাই বর্তমানে ভারতের অতীতেরও কোন গুরুত্ব নেই।

সমালোচনা

জেমস মিল ভারত সম্পর্কে যে ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রবর্তন করেন তা ব্রিটিশ ঐতিহাসিক বিদ্যের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত ছিল। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন সহ বিভিন্ন আধুনিক কালের বিভিন্ন ভারতীয় ঐতিহাসিক ভারতীয় সভ্যতা সম্পর্কে জেমস মিলে দৃষ্টিভঙ্গির কঠোর সমালোচনা করেছেন। ১. ভ্রান্ত যুগ বিভাজন : ভারতীয় ইতিহাস যুগের বিভাজনের মিলে দৃষ্টিভঙ্গি ভ্রান্ত। কারণ প্রাচীন যুগে ভারতের হিন্দু ছাড়াও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষ ছিল। তেমনি মধ্যযুগের ভারতে মুসলিমদের রাজনৈতিক কৃতিত্বের মধ্যে ও দেশের অধিকাংশ মানুষ ছিলেন হিন্দু এবং হিন্দুদের বিভিন্ন আঞ্চলিক রাজত্বের অস্তিত্ব ছিল। আধুনিক যুগে ভারতের ব্রিটিশদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলেও দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ছিল হিন্দু ও মুসলিম। ২. জাতি বিদ্বষী মনোভাব : জাতি বিদ্বষী সমর্থক জেমস ছিল ব্রিটিশ সভ্যতাকে উন্নত হিসেবে বিচার করে ভারতীয় সভ্যতাকে ঘৃণার চোখে দেখে কুরুচির পরিচয় বহন করেছেন। ৩. শাসক ও শাসিতের ব্যবধান : মিলের ঐতিহাসিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে শাসক ও শাসিতের মধ্যে ব্যবধান ও বিভেদের বীজ রোপিত হয়েছে। ৪. তথ্যের ভুল : মিলের গ্রন্থে বহু মতামত ভ্রান্ত। তাছাড়া তোরও প্রচুর ভুল ভ্রান্তি আছে

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বইয়ের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর

Leave a Comment