ভারতে দেশীয় রাজ্যগুলি নিয়ে গৃহীত যুক্তরাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা সম্পর্কে আলোচনা করো? এই পরিকল্পনা কেন ব্যর্থ হয়েছিল?

যুক্তরাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা ও দেশীয় রাজ্য সমূহ

সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসক বড় লাট লর্ড ওয়েলসলি এদেশে আসার আগে ভারতের ক্ষুদ্র অংশে প্রত্যক্ষ ব্রিটিশ আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ওয়েলসলি ও তার পরবর্তী বিভিন্ন গর্ভনর জেনারেল ভারতে ব্রিটিশ শাসনের প্রসার ঘটান। এক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন লর্ড ওয়েলসলি এবং লর্ড ডালহৌসি। পুনমের শতকে প্রথম দিকে ভারতের বৃহদংশের প্রত্যক্ষ ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। অবশ্য পৃথ্বীর রাজ্যের বাইরে তখনো কয়েকটি বৃহৎ ও অসংখ্য দেশীয় রাজ্যর অস্তিত্ব ছিল। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে সরকার কর্তৃক নিযুক্ত সাইমন কমিশন ভারতে আসার পর থেকে ব্রিটিশ ভারত ও ভারতের দেশীয় রাজ্যগুলিকে নিয়ে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় গঠনের জন্য আলোচনা শুরু হয়।

১. নেহেরু রিপোর্ট

১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে মতিলাল নেহেরু নেতৃত্বে ভারতের জন্য একটি সংবিধানে খরসা রচিত হয় যা নেহেরু রিপোর্ট নামে পরিচিত। এই রিপোর্টে ব্রিটিশ ভারত ও দেশীয় রাজ্যগুলিকে নিয়ে একটি যুক্তরাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়। এ রাষ্ট্রের কেন্দ্র ও রাজ্যের দায়িত্বশীল সরকার গঠিত হবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের মূল ক্ষমতা থাকবে কেন্দ্রীয় আইনসভার হাতে। তবে দেশীয় রাজ্যগুলি নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিষয় যথেষ্ট ক্ষমতা লাভ করবে এবং নিজেও রাজ্যের অভ্যন্তরে স্বতন্ত্র রক্ষা করতে পারবে।

২. গোলটেবিল বৈঠক

১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনের প্রথম গোল টেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকের আলোচনায় বিষয়বস্তুর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ব্রিটিশ ভারত ও দেশীয় রাজ্যগুলিকে নিয়ে একটি ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠন। ভারতের বিভিন্ন দেশীয় রাজ্যের প্রতিনিধিরাও এই বৈঠকে যোগ দেয়। তবেই আলোচনা সফল হয়নি

৩. দিল্লি চুক্তি

দেশীয় রাজ্যগুলির সংগঠন চেম্বার অফ প্রিন্সেস ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে নিজেদের মধ্যে দিল্লি চুক্তি স্বাক্ষর করে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রতিষ্ঠার দাবি জানান। এর পাশাপাশি প্রস্তাবিত এই যুক্তরাষ্ট্রেদেশীয় রাজ্যগুলি নিজেদের অধিকার সুরক্ষিত করার জন্য বিভিন্ন দাবিও জানানো হয়, যেমন- তাদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনসভার উচ্চ আসন সংরক্ষণ এবং প্রয়োজনে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেরিয়ে যাওয়ার অধিকার দাবি করা হয়। তাদের অধিকাংশ দাবি দেওয়া ব্রিটিশ সরকার ও ভারতের জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ খারিজ করে দিলে যুক্তরাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়।

৪. ভারত শাসন আইন ১৯৩৫

ব্রিটিশ সরকার ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে ভারত শাসন আইনে বলে যে, ভালো তো অন্তত ৫০ শতাংশ দেশে রাজ্য ইন্সট্রুমেন্ট অফ অ্যাকশন নামক চুক্তিতে স্বাক্ষর করলে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠনে আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ নেওয়া হবে। প্রস্তাবই দেই যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিস্তরীয় কেন্দ্রে আইনসভার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ শাসন দেশীয় রাজ্যগুলির প্রতিনিধিদের জন্য রাখা হয়। কিন্তু এই পরিকল্পনা ও বাস্তবায়িত হয়নি।

৫. নির্বাচনের পরবর্তী উদ্যোগ

১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে নির্বাচনে কংগ্রেস ব্যাপক সাফল্য লাভ করার পর লর্ড লিনলিথগো দেশীয় রাজ পুরুষদের কাছে পুনরায় যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো প্রস্তাব দেন জানুয়ারি ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু দেশীয় রাজ্যগুলি এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এরপর ইউরোপের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে দেশীয় রাজ্যগুলিকে নিয়ে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠনের প্রয়াস আপাতত বন্ধ হয়।

যুক্তরাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনার ব্যর্থতা

ব্রিটিশ শাসনকালে বিভিন্ন আলোচনার মাধ্যমে বেশ কয়েকবার ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। কিন্তু প্রতিবারই এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। এই ব্যর্থতার বিভিন্ন কারণ ছিল, যেমন –

১. গণতান্ত্রিকতার আশঙ্কা

দেশীয় রাজ্যের শাসক নিজ নিজ রাজ্যের স্বৈরাশাসন চালু করেছিলেন। তারা আশঙ্কা করেন যে প্রস্তাবের যুক্তরাষ্ট্রে যোগ দিলে ব্রিটিশ ভারতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিতিতে দেশীয় রাজ্যগুলি শাসকদের স্বৈরা শাসনের বিরোধিতা করে সেখানে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে মদদ দিতে পারেন।

২. আধিপত্য আশঙ্কা

ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের ব্রিটিশ সরকার ছিল সর্বশক্তিমান। সরকার দেশীয় রাজ্যগুলির ওপর যখন তখন যে কোন অজুহাতে প্রাধান্য বিস্তার করত। প্রয়োজনে তারা যেকোনো দেশীয় রাজ্যের শাসন ক্ষমতা কেড়ে নিতে পারত। যুক্তরাষ্ট্র গঠিত হলে প্রস্তাবিত এই রাষ্ট্রে দেশীয় রাজ্যগুলির অধিকার কতটা থাকবে তা তারা কেন্দ্রের আধিপত্যের শিকার হবে কিনা তা 1935 খ্রিস্টাব্দে ভারত শাসন আইন বা এর পূর্ববর্তী আলোচনা করিতে স্পষ্ট ভাবে উল্লেখ ছিল না।। তাই দেশীয় রাজ্যগুলির প্রস্তাবের যুক্তরাষ্ট্রের যোগ দিতে শঙ্কিত ছিল।

৩. ক্ষুদ্র রাজ্যগুলির আশঙ্কা

স্বাধীনতা লাভের পূর্ববর্তী ২ দশকে ভারতে অসংখ্য ক্ষুদ্র দেশীয় রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল না। তারা আশঙ্কা কলেজে পস্তাবিত ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের যোগ দিলে এই রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় আইনসভার তাদের রাজ্যের প্রতিনিধির সংখ্যা খুব কম হবে। ফলে তাদের স্বাধীনতা ও অধিকার যথেষ্ট খর্ব হবে।

৪. কংগ্রেসের আশঙ্কা

কংগ্রেসে আশঙ্কা করে যে, দেশীয় রাজ্যগুলোকে নিয়ে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠিত হলে সেই রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় আইনসভার কংগ্রেস সংখ্যাধিক আসন লাভের ব্যর্থ হবে। তাই কংগ্রেস এ বিষয়ে উদাসীনতা দেখায়। লন্ডনের লেবার পার্টি মন্তব্য করেছিলেন যে, ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে ভারত শাসন আইনের দ্বারা ভারতের রাজভক্তদের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে এ দেশে ব্রিটিশ স্বার্থরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

উপসংহার

ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা বারংবার ব্যর্থ হওয়ার পর ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে মন্ত্রী মিশন বা ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবিত পুনরায় ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়। বলা হয় যে ব্রিটিশ শাসিত ভারত এবং ভারতের দেশীয় রাজ্যগুলিকে নিয়ে একটি যুক্তরাষ্ট্র গঠিত হবে। এই যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রের হাতে কেবলমাত্র বিদেশি নীতি, দেশ রক্ষা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার দায়িত্ব থাকবে এবং প্রদেশ গুলিতে পূর্ণ স্বায়ত্ত শাসন প্রবর্তিত হবে। কিন্তু এই পরিকল্পনাও বাস্তবায়িত হয়নি।

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বইয়ের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর

Leave a Comment