ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সুভাষচন্দ্র বসুর ভূমিকা কি ছিল?

সূচনা

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস যার নামটি এক বিশাল জ্যোতিষ্কের মতো চিরদিন ভাস্বর হয়ে থাকবে তিনি হলেন সুভাষচন্দ্র বসু। দুঃসাধ্যের সাধক, দুর্গম পথের নির্ভীক এই যাত্রীকে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ আশীর্বাদ করে বলেছিলেন- “সুভাষচন্দ্র, বাঙালি কবি আমি বাংলাদেশের হয়ে তোমাকে দেশ ও নায়কের পদে বরণ করি।” তার গভীর দেশপ্রেম, অদম্য মনোবল, আত্মত্যাগ এবং প্রবাল শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তাল লড়াই চিরস্মরণীয়।

১. রাজনীতিতে অংশগ্রহণ

ছাত্র জীবন থেকে সুভাষচন্দ্র ইংরেজ শাসন বিরোধী এক তীব্র মনোভাব পোষণ করতেন। তাই তিনি ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে লোভনীয় চাকরিকে প্রত্যাখ্যান করেন। বারবার কারাবরণ সত্ত্বেও তিনি ভারতীয় রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত রাখেন। তিনি ছিলেন ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা ও সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী। তাই জাতীয় সংগ্রামের শ্রমিক শ্রেণী ব্যাপক অংশগ্রহণ করলে কংগ্রেসের মধ্যে যে বামপন্থী চিন্তাধারার অনুপ্রবেশ ঘটে তাতে জহরলাল নেহেরুর সঙ্গে তিনিও নেতৃত্ব দেন। ফলে কংগ্রেসের রক্ষণশীল দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠীর সঙ্গে তার বিরোধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।

২. গান্ধীজীর সঙ্গে মত বিরোধ

সুভাষচন্দ্রের নীতি ও আদর্শ দেশের যুবক সমাজকে আকৃষ্ট করে। কংগ্রেসের মধ্যেও তার সমর্থক সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ফলে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে হরিপুরা কংগ্রেসের তিনি সভাপতির নির্বাচিত হন। সভাপতি ভাষনের সুভাষচন্দ্র শ্রমিক ও কৃষক সংগঠনগুলিকে একত্রিত করে একটি প্রগতিশীল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মঞ্চ গঠনের মাধ্যমে দেশব্যাপী সংগ্রাম শুরুর আবহন জানান। কিন্তু তার এই সংগ্রামী দৃষ্টিভঙ্গি গান্ধীজি ও তার অনুগামীদের মনঃপূত না হওয়ায় গান্ধীজির ত্রিপুরি কংগ্রেস ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে সভাপতি হিসেবে পটভি সীতারামাইয়ার নাম প্রস্তাব করেন।

কিন্তু সকলকে বিস্মিত করে সুভাষচন্দ্র প্রণয় সভাপতি নির্বাচিত হন। এতে গান্ধীজি ও তার সার্থকরা ক্ষুন্ন হন এবং সুভাষচন্দ্র সঙ্গে কোন রকম সহযোগিতা না করা সিদ্ধান্ত নেন। ফলে বাধ্য হয়ে সুভাষচন্দ্র সভাপতি পদত্যাগ করেন এবং জাতীয় আন্দোলন কে প্রগতি ছিল সংগ্রামমুখী করে তুলতে ফরওয়ার্ড ব্লক নামে একটি নতুন দল গঠন করে বাইশে জুন ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে। পরিণতি হিসেবে সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত হন।

৩. ভারত ত্যাগ

১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে সুভাষের যুদ্ধবিরোধ মনোভাব উদ্বিগ্ন হয়ে ব্রিটিশ তাকে ভারতরক্ষা আইনে গ্রেফতার করে ২ জুলাই ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে। মুক্তি দাবিতে সুভাষ কারাগারের মধ্যে আমৃত্যু অনশন করেন। স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটলে পুলিশ তাকে স্বগৃহে অন্তরীন করে রাখে ৫ ডিসেম্বর ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু ব্রিটিশের করা প্রহরা এড়িয়ে, জিয়াউদ্দিনের ছদ্মবেশে সুভাষ পদত্যাগ করেন ১৭ই জুলাই ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে। ডক্টর অমলেশ ত্রিপাঠী সুবাসের দেশত্যাগ প্রসঙ্গে লেখেন -“ভারতের ‘তাসের দেশ’ ফেলে তারুণ্যের প্রতি রাজপুত্র বেরিয়ে পড়লেন এক দুঃসাহসিক অভিযানে।”

৪. জার্মানিতে কার্যকলাপ

দিল্লি থেকে সুভাষ পৌঁছন আফগানিস্তানের কাবুলে। কাবুল থেকে তিনি রাশিয়ায় যান ভারতবাসী স্বাধীনতা লাভের রুশোর সাহায্যের লক্ষ্যে। কিন্তু রুশ ও রাষ্ট্রপ্রধান স্টালিন এসময় রাশিয়ার ওপর জার্মানির সম্ভাব্য আক্রমণের পরিস্থিতিতে ইংরেজদের সঙ্গে মিত্রতা আশা করেছিলেন। তাই সাহায্যের কোনো আশ্বাস না পেয়ে তিনি বিমানযোগে জার্মানির বার্লিনে চলে আসে না ২৮ মার্চ ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে। বার্লিনে সুভাষজার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিবেনট্রপের সঙ্গে দেখা করে এবং জার্মানির সহযোগিতায় ব্রিটিশ বিরোধী প্রচার বন্দি ৪০০ ভারতীয় সেনাদের নিয়ে একটি মুক্তিসেনা গঠনের প্রয়াস চালাতে থাকেন।

জার্মানির বিদেশ দপ্তরে তথ্য কেন্দ্রে সহায়তা সুভাষচন্দ্র গ্রন করেন ওয়ার্কিং গ্রুপ ইন্ডিয়া, যা পরে স্পেশাল ইন্ডিয়ান ডিপার্টমেন্টে রূপান্তরিত হয়। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের শেষর্ধে সুভাষচন্দ্র বার্লিনে গিরিজা মুখার্জী, এম. আর. ব্যাস,এ. সি. এন. নাম্বিয়ার সহ ২০ জন ভারতীয়কে নিয়ে গঠন করে ফ্রি ইন্ডিয়া সেন্টার। এর মুখপাত্র হয় ইংরেজি ও হিন্দি দ্বিভাষিক পত্রিকা আজাদ হিন্দ। জার্মানির হাতে বন্দি ভারতীয় সৈন্যদের নিয়ে সুভাষ ইন্ডিয়ান আর্মি নামে এক সেনাদল গঠন করে ডিসেম্বরে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে।

এটাই ছিল আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠনের প্রথম পরিকল্পনা। ‘উল্লম্ফনকারী ব্যাঘ্র ‘ ছিল সেনাবাহিনীর প্রতীক। এই সেনাদল, সুভাষচন্দ্রের দেশপ্রেম ও বিপ্লবী আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে সর্বপ্রথম তাকে নেতাজি অভিধায় ভূষিত করে এবং জয় হিন্দ ধবনি দিয়ে অভিবাদন জানান। ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামকে গতিশীল করে তোলার উদ্দেশ্যে তিনি আজাদ হিন্দী রেডিও, ন্যাশনাল কংগ্রেস রেডিও ও আজাদ মুসলিম রেডিও নামে তিনটি গোপন প্রচার কেন্দ্র থেকে ফরাসি, ইংরেজি, হিন্দি, গুজরাতি ও বাংলা ভাষাতে নিয়মিত প্রচারের ব্যবস্থা করেছিলেন।

৫. জাপানি সরকারের প্রতিশ্রুতি আদায়

এদিকে ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে জার্মানির হঠাৎ রাশি আক্রমণ এবং ওই বছর ৭ ডিসেম্বর ব্রিটেন ও আমেরিকার বিরুদ্ধে জাপানের যুদ্ধ ঘোষণা বিশ্বযুদ্ধের পট পরিবর্তন ঘটে। সুভাষচন্দ্র উপলব্ধি করেন যে ভারতের মুক্তি প্রচেষ্টায় জাপানি সহযোগিতায় অধিকতর কার্যকরী হবে। ঠিক এই সময় জাপান প্রবাসী বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে সুভাষচন্দ্র ৩ মাসের অধিক সময় ধরে এক দুঃখ সাহসিক সাবমেরিন অভিযান শেষে টোকিও ও উপস্থিত হন ১৩ জুন ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দ।

ভারতের স্বাধীনতা প্রশ্ন সুভাষচন্দ্র পরপর দুবার জাপানি প্রধানমন্ত্রী হিদেকি তোজর সঙ্গে দেখা করেন। জাপানের আইন সভায় ডায়েট এ সুভাষচন্দ্রের উপস্থিতিতে তোজো ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য জাপানের তরফে সুভাষকে নিঃশর্ত সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। স্বাধীনতা সংগ্রামী জাপানি সরকারের শরবতভাবে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি নিয়ে সুভাষচন্দ্র সিংগাপুরে যান।

৬. আজাদ হিন্দ সরকার প্রতিষ্ঠা

সিঙ্গাপুরের চার জুলাই রাসবিহারী ও সুভাষচন্দ্রের হাতে তার প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান ইনডিপেন্ডেন্স লিখবা ভারতীয় স্বাধীনতা সংঘের দায়িত্বভার অর্পণ করেন। পরে ২৫ আগস্ট নেতাজি আনুষ্ঠানিকভাবে আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়কত্ব গ্রহণ করেন এবং ২১ অক্টোবর আজাদ হিন্দী সরকার নামে অস্থায়ী ভারত সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। ইতালি, জার্মানি ও জাপান সহ নটি দেশের সমর্থন লাভ করে এই নবগঠিত আজাদ হিন্দ সরকার। জাপান আজাদ হিন্দ সরকারকে স্বীকৃতি দেয় এবং তার হাতে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ এর অধিকার সমর্পণ করে। নেতাজি ওই দ্বীপ দুটি নামকরণ করে যথাক্রমে শহীদ ও স্বরাজ। এরপর আজাদ হিন্দ সরকার গ্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।

৭. দিল্লি অভিযান

১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের ৪ জানুয়ারি নেতাজি রেঙ্গুনে এসে তার সামরিক দপ্তর স্থাপন করেন। ঈদের মধ্যে আজাদ হিন্দ ফৌজ পাঁচটি ব্রিগেডে বিভক্ত হয়ে যায়, যথা -গান্ধী ব্রিগেড, আজাদ ব্রিগেড, নেহেরু ব্রিগেড, সুভাষ ব্রিগেড, ঝাঁসির রানী ব্রিগেড। সুভাষচন্দ্র সেনাদের সামনে ধবনি দেন দিল্লি চলো। জাপানি নেতৃবৃন্দের সহযোগিতায়, নেতাজির বলিষ্ঠ নেতৃত্বের এবং উজ্জীবনী মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে আজাদ হিন্দ বাহিনী প্রবল বিক্রমে যুদ্ধ চালায়।

তারা মণিপুরে কহিমা শহরটি দখল করে ৬ই এপ্রিল ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে এবং রাজধানী ইম্ফল দখলের জন্য অগ্রসর হয়। সুভাষ ব্রিগেডের সেনাপতি শাহনওয়াজ খান বলেছেন -“এই অভিযানে আমরা ভারতের অভ্যন্তরের ১৫০ মাইল অগ্রসর হয়েছিলাম। কোন রক্ষণক্ষেত্রেই আমরা পরাজিত হইনি। এই অভিযানের আজাদ হিন্দ ফৌজে প্রায় চার হাজার সৈন্য মৃত্যুবরণ করেছিলেন। যাইহোক বিশ্বযুদ্ধে জাপান তথা অক্ষশক্তির পরাজয় আসন্ন হয়ে পড়লে আজাদ হিন্দ সেনাদল দিল্লি পর্যন্ত পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়।

৮. সমালোচনা

ভারতের মুক্তি সংগ্রাম বিষয়ে সুভাষচন্দ্রের পরিকল্পনা ও তার যৌক্তিকতা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছে। এর প্রত্যুত্তর মেলে সিঙ্গাপুরের এক জনসভায় নেতাজি ভাষন ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে ৯ই জুলাই থেকে -“ভারতবর্ষে যে সংগ্রাম চলেছে, বাইরে থেকে তার শক্তি বৃদ্ধি করাই আমাদের দেশত্যাগের প্রধান কারণ।” ইতালি, চীন প্রভৃতি দেশের মুক্তি সংগ্রামে বিদেশে রাষ্ট্রের সাহায্য গ্রহণের সুস্পষ্ট নজির আছে। আর এক্ষেত্রে ৭০ শত্রু আমরা মিত্র -এই প্রাচীন সূত্র অনুসারে সুভাষচন্দ্র অক্ষর শক্তি সাহাজ্য নিয়েছিলেন মাত্র। এর পিছনে তার একটাই মাত্র উদ্দেশ্য ছিল ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা।

মূল্যায়ন

সুভাষচন্দ্র ও তার আজাদ হিন্দ ফৌজের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ ও সংগ্রাম তৎক্ষণিক বিচারে ভারত কে স্বাধীন করতে পারেননি সত্য, কিন্তু তার পরিকল্পনা, দেশ প্রেম, আদর্শ ও আত্মত্যাগ স্বাধীনতা অর্জনের পথকে যে প্রশস্ত ও সুগম করেছিল আসামুদ্রহিমাচল ভারতবর্ষকে যে নব প্রেরণা উদ্বুদ্ধ করে তুলেছিল তা বলাই বাহুল্য। সেই সঙ্গে ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নকে বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে পৌঁছে দিয়ে তিনি তাকে আন্তর্জাতিক প্রশ্নের রূপান্তরিত করেছিলেন।

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বইয়ের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর

Leave a Comment