ভারতের বিদেশনীতির মূল উপাদানসমূহ ?

বিদেশনীতি কোনো একটিমাত্র উপাদান নিয়ে গড়ে ওঠে না। ভারতের বিদেশনীতির অনেকগুলি উপাদান রয়েছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-

 [1] পঞ্চশীল ও জোটনিরপেক্ষতার নীতি: স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর পঞ্চশীল ও জোটনিরপেক্ষতা ছিল ভারতের বিদেশনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। ঠান্ডা লড়াইয়ের সেই যুগে ভারতের এই দুটি উপাদানের

গুরুত্ব আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে স্বীকৃতি অর্জন করেছিল। যে-কোনো দেশের বিদেশনীতি সময় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির বদলের সঙ্গে বদলে যায়। ভারতও সেদিক থেকে কোনো ব্যতিক্রম নয়। তবুও আধুনিক ভারতের বিদেশনীতির মূল ভিত্তি হিসেবে পঞ্চশীল ও জোটনিরপেক্ষতার নীতির অবদানকে একেবারে উপেক্ষা করা যায় না।

 [2] জাতীয় যুক্তি আন্দোলনের সমর্থন এবং উপনিবেশবাদ ও নয়া উপনিবেশবাদের বিরোধিতা: ভারতের বিদেশনীতির অন্যতম মূল উপাদান হল জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে সমর্থন এবং উপনিবেশবাদ ও নয়া 2. উপনিবেশবাদের বিরোধিতা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলিতে স্বাধীনতার জন্য যে মুক্তি আন্দোলন an গড়ে ওঠে ভারত তাতে অকুণ্ঠ সমর্থন জানায়। এর পাশাপাশি বৃহৎ he শক্তিগুলির উপনিবেশবাদী ও নয়া উপনিবেশবাদী পদক্ষেপের কড়া বিরোধিতা করে ভারত।

 (3) পান্তিপূর্ণ উপায়ে বিরোধ মীমাংসা ও যুদ্ধ পরিহার: ভারত বরাবরই যে-কোনো ধরনের বিরোধ শান্তিপূর্ণ উপায়ে মিটিয়ে ফেলার পক্ষপাতী। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের মধ্যে যেসব সংকট দেখা দিয়েছে ভারত তার শান্তিপূর্ণ মীমাংসার পক্ষে সওয়াল করেছে।

[4] প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে সম্ভার ও সম্প্রীতি রক্ষা: ভারত বরাবর প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে সম্ভাব ও সম্প্রীতি বজায় রেখে চলতে চেয়েছে। এটি ভারতের বিদেশনীতির একটি অন্যতম মৌলিক উপাদান।

[5] সামরিক হস্তক্ষেপ ও সামরিক আগ্রাসনের বিরোধিতা: আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখা ভারতের একটি ঘোষিত নীতি। এই নীতির প্রশ্নে ভারত কখনও আপস করেনি। তাই বৃহৎ শক্তিধর রাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপ বা সামরিক আগ্রাসনকে ভারত মেনে নেয়নি। ঠান্ডা লড়াই পরবর্তী যুগে একবিংশ শতাব্দীতে ইরাকের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের যৌথ বাহিনীর সামরিক আগ্রাসনকেও অনুমোদন করেনি ভারত। ভারতীয় সংসদ এই ব্যাপারে নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণ করে তার স্পষ্ট অভিমত সারা বিশ্বের কাছে ঘোষণা করে দিয়েছিল।

[6] পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহার-সম্পর্কিত মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি: পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহার সম্পর্কে ভারতের একটি মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। এটি তার সাম্প্রতিককালের বিদেশনীতির অন্যতম একটি মূল উপাদান। ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে ভারত পরীক্ষামূলক পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সারা বিশ্বের দরবারে নিজেকে এক পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরে। সেই সময় এই বিষয়টিকে অনেকে ভালো চোখে দেখেননি। কিন্তু ভারত নিজের দৃষ্টিভঙ্গিতে অবিচল থেকে তার পরমাণু সম্পর্কিত বিদেশনীতি সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছিল। তার ফলে পরবর্তীকালে যাবতীয় বিরূপ প্রতিক্রিয়াকে অপসারণ করতে সে সক্ষম হয়েছে। পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার পর ভারত অতান্ত দৃঢ়ভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে সে কখনও কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের ভূখন্ডে আগ্রাসন চালানোর জন্য পরমাণু অশ্বের ব্যবহার করবে না। ভারতের পরমাণু নীতির মূল কথা হল ‘No First Strike’ অর্থাৎ আগ বাড়িয়ে একতরফাভাবে কোনো দেশের ওপর প্রথম আঘাত হানা নয়। তবে যদি কেউ পরমাণু অস্ত্র প্রয়োগ করে ভারতের মাটিতে আক্রমণ চালায় তাহলে আত্মরক্ষার তাগিদে ভারত পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহারে দ্বিধা বোধ করবে না।

স্পষ্ট অভিমত বন্ধু আগেই জানিয়ে দিয়েছে। এজন্য ভারত সার্বিক পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষা নিষিদ্ধকরণ চুক্তি (CTBT)-তে সই করেনি। ভারতের নীতি হল পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা বন্ধ করতে হলে সবার ক্ষেত্রেই তা করতে হবে।

[7] আন্তর্জাতিক সংগঠন ও আঞ্চলিক সংগঠনে সদর্থক ভূমিকা: বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার ক্ষেত্রে ভারত বহু আগেই সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের মতো আন্তর্জাতিক সংগঠনে তার ভূমিকা স্পষ্ট করে দিয়েছে। বর্তমানে সন্ত্রাসবাদসহ নানান ইস্যুতে ভারত আন্তর্জাতিক মহলে সব দেশকে একজোট হয়ে এর মোকাবিলা করার জন্য আবেদন জানিয়েছে। এর পাশাপাশি জাতিপুঞ্জের সাবেকি কাঠামোর সংস্কার সাধন করে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শক্তি হিসেবে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যপদের দাবিও ভারত জানিয়েছে। অর্থনৈতিক সহযোগিতার প্রশ্নে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যে বৈষম্য হ্রাস, বিশ্ব উন্নায়ণ রোধে পরিবেশের সুরক্ষা ইত্যাদি বিষয়েও ভারত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মঞ্চে তার সদর্থক দৃষ্টিভঙ্গির কথা জানিয়ে দিয়েছে।

আঞ্চলিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিকে নিয়ে সার্ক (SAARC) এবং আসিয়ান (ASEAN)-এর মতো সংগঠন গড়ে তোলার পিছনেও ভারতের অবদান কম নয়। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে যাবতীয় বিভেদ ভুলে গিয়ে কীভাবে দক্ষিণ ও দক্ষিস-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি আরও এগিয়ে আসবে ভারত সেজন্যেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করে চলেছে।

Leave a Comment