ভারতীয় অর্থনীতিতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব
১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ব্রিটেনে এই যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে ছড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধে ভারতের বিপুল পরিমাণ অর্থ সম্পদ ও সোনাকে কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার তাদের ভারতীয় উপনিবেশকেও যুদ্ধে শামিল করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অবসানের পর ভারতীয় অর্থনীতিতে যুদ্ধের প্রত্যক্ষ প্রভাব অত্যন্ত প্রকট হয়ে ওঠে। এ সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো-
১. আর্থিক সংকট
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ভারতের বিপুল পরিমাণ অর্থ সম্পদ ব্যায়িত হয়। ফলে যুদ্ধের পর দেশের অর্থনৈতিক সংকট অত্যন্ত প্রকট হয়ে পড়ে। যুদ্ধকালে কৃষি ও শিল্প উৎপাদন দারুন ভাবে কমে যায়। রপ্তানী যথেষ্ট পরিমাণে হ্রাস পায়। এটা ভারতীয়দের দারিদ্র ক্রমশ তীব্রতর হয়। ভারতীয় অর্থনীতির ক্ষেত্রে ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের মূল্য সূচক ১০০ ধারা হলে তা ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে ১৪৭ এ পৌঁছই এবং ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে তা বেড়ে ২২৫ এবং ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে বেড়ে দ্বারাই ১৮১।
২. ঋণ সংগ্রহ
তীব্র আর্থিক দুর্দশার পরিস্থিতির সামাল দেওয়ার উদ্দেশ্যে সরকার তাৎক্ষণিকভাবে বিপুল পরিমাণ ঋণ সংগ্রহ করে। ফলে ভারতের জাতীয় ঋণের পরিমাণ ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানির হাত থেকে ভারতের শাসন ক্ষমতা যখন ব্রিটিশ রাজের কাছে যায় তখন ভারত সরকারের ঋণের পরিমাণ ছিল ৭০ মিলিয়ন পাউন্ড। দিন বেড়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে ২৭৪ মিলিয়ন পাউন্ডের এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে মিলিয়ন পাউন্ডে পৌঁছয়।
৩. মূল বৃদ্ধি
যুদ্ধের প্রভাবে কৃষি ও শিল্পপণ্যের উৎপাদন হ্রাস পায়নি। ফলে এই সময় দ্রব্যমূল্য যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে থেকে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বিভিন্ন দ্রব্যের মূল্য দ্বিগুণ হয়ে যায়। বস্ত্র, চিনি, লবণ ও কেরোসিন প্রভৃতি মূল্য সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পায়।
৪. দরিদ্রদের দুরবস্থা
কৃষি উৎপাদন হ্রাস, রপ্তানি ব্যাহত, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রভৃতির ফলে ভারতের দরিদ্র সাধারণ মানুষের দুরবস্থা তীব্রতর হয়। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অনুপাতে কৃষি মজুর এবং শিল্প শ্রমিকদের মজুরি বিশেষ বাড়েনি। বিভিন্ন দ্রব্যের মূল্য বাড়লেও সে তুলনায় কৃষি পণ্যের মূল্য বাড়েনি। ফলে শ্রমিকরা তাদের উপার্জন দিয়ে এবং কৃষকরা তাদের কৃষি পণ্য বিক্রি করে জীবন জীবিকার ব্যয় নির্বাহ করতে ব্যর্থ হয়। কৃষি পণ্যের মূল্য না বাড়ায় কৃষকরা খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৫. কর বৃদ্ধি
দেশের কৃষক ও শ্রমিকদের এরূপ দুর্দশা পরিস্থিতিতে সরকার আর্থিক সংকটমোচনের উদ্দেশ্যে দরিদ্র কৃষকদের ওপর করের বোঝা যথেষ্ট পরিমাণে বাড়িয়ে দেয় এবং তা জোরপূর্বক আদায় করতে শুরু করে।
কৃষকদের ওপর অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাব
ভারতীয় কৃষকদের ওপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী অর্থনৈতিক সংকটের তীব্র ও প্রত্যক্ষ প্রভাব লক্ষ্য করা যায়, যেমন-
১. খাদ্য উৎপাদন হ্রাস
কৃষকের জীবনধারণের জন্য খাদ্য শস্য উৎপাদন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল। কিন্তু আর্থিক সংকটন নিরসনে সরকার রপ্তানিযোগ ও অর্থকারী ফসল চাষ করতে কৃষকদের বাধ্য করে। ফলে কৃষকদের খাদ্য প্রয়োজনীয় শস্য উৎপাদন যথেষ্ট হ্রাস পায়।
২. খাদ্য সংকট
কৃষক তার জমিতে খাদ্য সরষের পরিবর্তে অর্থকারী ফসল উৎপাদনে বাধ্য হলে কৃষক পরিবার গুলি খাদ্য সংকটের সম্মুখীন হয়। কাদের অভাবে কৃষকের গৃহে হা- অন্ন রব ওঠে। দেশের বহু স্থানে শীঘ্রই দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি তৈরি হয়।
৩. কর বৃদ্ধি
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে ভারতের ব্রিটিশ সরকার অর্থনৈতিক দুর্দশার অবসান ঘটাতে সেসব উপায় বের করেছিল, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল করের পরিমাণ বৃদ্ধি করা। দেশে খাদ্য সংকট ও দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতির মধ্যেও সরকার কৃষকের ঘর না করে বরণ করে বোঝা আরো বাড়িয়ে দেয়। বাড়তি কর আদায় করতে কৃষকের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। ভোর স্বামীরা বিভিন্ন অজুহাতে জমি থেকে কৃষকদের উচ্ছেদ করে নিজেদের আয় বাড়ানোর চেষ্টা শুরু করে। কল বৃদ্ধির ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে কৃষকরা সীমাহীন দুর্দশা শিক্ষার হয়।
উপসংহার
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সারা ভারতেই অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাব অনুভুত হয়। এই পরিস্থিতি ভয়ানক আকার ধারণ করে গুজরাট সহ পশ্চিম ভারতে। সরকার কর্তৃক কৃষকদের ওপর অতিরিক্ত করের বোঝাচাপানোর ঘটনা সবচেয়ে করুন পরিস্থিতি তৈরি হয় গুজরাটে। সেখানে কর বৃদ্ধির প্রতিবাদে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দ এবং ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে দারুণ আলোড়ন সৃষ্টি হয় এবং তীব্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।