ভারতছাড়ো আন্দোলনের ব্যর্থ হল কেন? ভারত ছাড়ো আন্দোলনের গুরুত্ব আলোচনা করো?

ভালো ছাড়া আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ

ভূমিকা

ভারতছাড়ো আন্দোলন ছিল ভারতবর্ষের স্বাধীনতা প্রাপ্তির আগে সর্বশেষ গণ আন্দোলন। গান্ধীজীর ব্রিটিশ কে চরম হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন – “পূর্ণ স্বাধীনতা অপেক্ষা কম কোন কিছুতেই আমি সন্তুষ্ট হবো না। ……. আমরা করবো অথবা মরব – করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে।” এই আন্দোলন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের পথকে সুগম করলেও শেষ পর্যন্ত তা ব্যর্থ হয়। এই ব্যর্থতার পিছনে ছিল বহুবিধ কারণের সমন্বয়।

১. উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাব

ভারতছাড়ো আন্দোলন সম্পন্ন রূপে গান্ধীজীর নেতৃত্বের উপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু আন্দোলন শুরু হওয়ার আগেই গান্ধীজি-সহ কংগ্রেসের সব শীর্ষ নেতা কে কারারুদ্ধ করা হয়। গান্ধীজীর অবর্তমানে সেই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো নেতার অনুপস্থিতিতে এই আন্দোলন ব্যর্থ হয়।

২. কমিউনিস্ট-সহ অন্যান্য দলের বিরোধিতা

ভারতের কমিউনিস্ট দল পরোক্ষভাবে ভারতছাড়ো আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিল। জাতীয় আন্দোলনের মূল স্রোত থেকে আলাদা হয়ে গিয়ে তারা ব্রিটিশের সহযোগিতা করে। মুসলিম লীগ, অনুন্নত সম্প্রদায়, লিবারেল গোষ্ঠী, হিন্দু মহাসভা, রেডিক্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি এই আন্দোলনে সহযোগিতা করেনি। হরিজন নেতা আম্বেদকর বলেন এই আন্দোলন ছিল অযৌক্তিক ও দায়িত্বজ্ঞানহীন। ফলস্বরূপ আন্দোলন ব্যর্থ হয়।

৩. ব্রিটিশের তীব্র দমন নীতি

ব্রিটিশ সরকার আগে থেকেই আন্দোলন দমনের জন্য নীল নকশা তৈরি করে রেখেছিল। দৈহিক নির্যাতন, গ্রেফতার, ঘর পুড়িয়ে দেওয়া, নারী ধর্ষণ, এমনকি গুলি চালিয়ে ব্রিটিশ এই আন্দোলন কে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল। সারা দেশে পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর তান্ডব শুরু হয়। এ প্রসঙ্গে জহরলাল নেহেরু লিখেছেন – “সৈন্যদল ও এরোপ্লেন এসে গ্রামে আক্রমণ চালিয়ে গ্রামগুলিকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। তারপর তারা নাঙ্গল চালিয়ে সেই গ্রামগুলি অস্তিত্ব সম্পূর্ণভাবে মুছে দেয়। এই নিষ্ঠুর যেমন নীতি কে গান্ধীজি হিংস সুভল হিংসা বলে অবহিত করেছেন।

৪. প্রাকৃতিক দুর্যোগ

১৯৪২ এর অক্টোবরে বাংলায় দুর্গাপূজার সময় ঝড়ো বন্যা হয়। কিন্তু ব্রিটিশ প্রশাসন সে সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ কবলিত মানুষদের জন্য কোনরকম ত্রানের ব্যবস্থা করেনি। ফলে হাজার হাজার লোক অনাহারে মারা যায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য পূর্ব ভারতের ভারত ছাড়ো আন্দোলন অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়ে।

৫. অসময়ের সূচনা

সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি থাকাকালীন এই আন্দোলনের সূচনা করতে চেয়েছিলেন কিন্তু গান্ধীজি অনুগামীরা তখন তা করেননি। সেই আন্দোলন গান্ধীজীর শুরু করেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে, যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রণাঙ্গনে ইংল্যান্ড সহ মিত্রপক্ষ সুবিধা জনক অবস্থায় রয়েছে। ফলে এই বিলম্ব আন্দোলনকে ব্যর্থ করে।

ভারত ছাড়ো বা আগস্ট আন্দোলনের গুরুত্ব

ভূমিকা

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস এক গৌরব জনক অধ্যায় হলো ভারত ছাড়ো আন্দোলন। বলা যায়, ভারতছাড়ো আন্দোলন ছিল ভারতের ব্রিটিশ শাসন অবসানের অন্তিম পদক্ষেপ। ১৯৪২ এর বিদ্রোহ বাস্তবিকই ছিল সৈনিকের যুদ্ধ। সেনাপতি ছিলেন দ্বিধা গ্রস্ত, কিন্তু সৈনিকগণের ভূমিকা ছিল গৌরব জনক। কারণ তারা দেশের স্বাধীনতার জন্য শহীদের ন্যায় জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। ঐতিহাসিক রমেশ চন্দ্র মজুমদারের এই মন্তব্য থেকেই ভারতছাড়ো আন্দোলনের গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়।

যেসব কারণেই আন্দোলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলি হল –

১. স্বাধীনতার অজয়ের সংকল্প

১৯৪২ এর ভারত ছাড়ো আন্দোলন ছিল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে চূড়ান্ত পর্যায়ে। ব্রিটিশ শাসনের প্রতি ভারতবাসীর ঘনীভূত খবর তা থেকে মুক্তির জন্য অজয়ের সংকল্প এই বিদ্রোহে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়। এই আন্দোলনের সমাজের গরীব শ্রেণীর অংশগ্রহণের সুন্দর বিবরণ রয়েছে সতীনাথ ভাদুড়ীর জাগরী এবং ঢোঁড়াই চরিত মানস-এই দুইটি উপন্যাসে।

২. সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা

মুসলিম লীগ এই আন্দোলনে যোগ না দিলে উত্তরপ্রদেশে, বিহার, চট্টগ্রাম, শিলচর প্রভৃতি স্থানে বহু মুসলিম এই আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশ নেয়। আন্দোলনের চলাকালে কোথাও কোন সাম্প্রদায়িক বিরোধ বাধিনি। তাই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও হিন্দু মুসলিম ঐক্য ছিল এই আন্দোলনের এক বিশাল সম্পদ।

৩. জাতীয় বিপ্লব

৪২ এর আন্দোলনের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে জহরলাল নেহেরু বলেছিলেন – “নেতা নেই, সংগঠন নেই, উদ্যোগ আয়োজন কিছুই নেই, কোন মন্ত বল নেই, অথচ একটা অসহায় জাতি স্বতঃস্ফূর্তভাবে কর্ম প্রচেষ্টার আর কোন পথ না পেয়ে বিদ্রোহী হয়ে উঠলো- এ দৃশ্য বাস্তবিক বিস্ময়ের। এ আন্দোলনকে তিনি ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মহাবিদ্রোহের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। বড়লাট লর্ড লিনলিথগো ও এই আন্দোলনকে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের পর সবচেয়ে বড় বিদ্রোহ বলে উল্লেখ করেছেন।

৪. ব্রিটিশ শাসনের মৃত্যু ঘন্টা

অধ্যাপক সুমিত সরকারের মতে বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষকদের অংশগ্রহণের ফলেই আগস্ট বিদ্রোহ এক দুর্দমনীয় আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। এই অতুলনীয় গণ বিদ্রোহ ব্রিটিশ শাসক গোষ্ঠীর মনে এই বোধ সুস্পষ্টভাবেই জাগিয়ে দিয়েছিল যে, ভারতের ব্রিটিশ শাসনের অবসান আর বেশি দূরে নেই। ভারতের স্বাধীনতা লাভের একটি অবধারিত ব্যাপার। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের দ্বারা প্রমাণিত হয়, ভারতবাসী স্বাধীনতা লাভের জন্য এবং তা অর্জনের জন্য সব ধরনের ত্যাগ, তিতিক্ষা, অত্যাচার, লাঞ্ছনা এমনকি মৃত্যুবরণ করতে ও প্রস্তুত। তাই এ কথা বলা হয় যে, ৪২ এর আন্দোলন বা ভারতছাড়ো আন্দোলন ভারতের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মৃত্যু ঘন্টা ধবনি শুনিয়েছিল।

৫. স্বাধীনতা অর্জনের ভিত্তি স্থাপন

৪২ এর আন্দোলনের গভীরতা ও ব্যাপকতা যে ভারতের স্বাধীনতার ভিত্তি ভূমি রচনা করেছিল, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। একদিকে যখন সুভাষ চন্দ্রের সশস্ত্র বিপ্লবী তৎপরতায় ভারতের ব্রিটিশ সরকার আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল, ঠিক তখনই ভারতছাড়ো আন্দোলনে তীব্রতা সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকারের প্রশাসনিক ভিত্তিকে নড়বড়ে করে দিয়েছিল। অরুণ চন্দ্র ভূঁইয়া তার গ্রন্থে বলেছেন যে, এ আন্দোলনের ফলে একটি অভুতপূর্ব জাতীয় জাগরন ও জাতীয় ঐক্যবোধ গড়ে ওঠে। এর ফলে ইংরেজরা ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারত ছাড়তে বাধ্য হয়।

৬. ব্রিটিশদের বোধোদয়

ভারত ছাড়ো আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে ভারতবাসী যে তীব্র স্বাধীনতাকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয়, তা ব্রিটিশের বোধোদয় ঘটনায়। বিজয় সরকার অনুভব করে যে এবার তাদের ভারত ছাড়ার সময় হয়েছে। এ আন্দোলন প্রমাণ করে যে, মুক্তি সংগ্রামে ভারতের জয় অনিবার্য। আন্দোলনের গভীরতা উপলব্ধি করে লিনলিথগোর পরবর্তী বড়লাট লর্ড ওয়াভেল লিখেছিলেন , “যুদ্ধ শেষ হলে ভারতকে স্বাধীনতা দিতে বাধ্য হওয়ার আগেই ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করা উচিত।”

৭. কংগ্রেসের মর্যাদা পূর্ণ প্রতিষ্ঠার

এ আন্দোলন থেকে সবচেয়ে লাভবান হয়েছিল জাতীয় কংগ্রেস। আন্দোলনকালে মহাত্মা গান্ধীর অনশন জাতির হৃদয়ে কংগ্রেসের মর্যাদা কে পুনরায় অধিষ্ঠিত করে। কংগ্রেস নেতাদের দুঃখ বরণ ও আত্মত্যাগ দেখে জাতি আপ্লুত হয়। সাম্রাজ্যবাদী কংগ্রেস নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ Towards Struggle’ গ্রন্থে লেখেন, “The Congress alone is the Country’s salvation.

৮. গণ আন্দোলন হিসেবে

এ আন্দোলনের শ্রমিক ও কৃষক সহ সমাজে বিভিন্ন শ্রেণি স্বতঃস্ফূর্তভাবে শামিল হয়ে একে গণ আন্দোলনে রূপদান করে। নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি ও এই আন্দোলনকে গন যুদ্ধ আখ্যা দিয়েছিল। ডক্টর সুমিত সরকার বলেছেন, বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকদের অংশগ্রহণের ফলে আগস্ট বিদ্রোহ দুর্দমনীয় আন্দোলনের পরিণত হয়। ডক্টর রমেশ সঙ্গে মজুমদার লিখেছেন, “১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের গণ বিদ্রোহ প্রকৃত অর্থ ছিল সৈনিকদের যুদ্ধ। সেনাপতির দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন, কিন্তু সৈনিকদের ভূমিকা ছিল গৌরবময়। কারণ তারা দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করে শহীদ হয়েছিলেন।” সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল এর মতে ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে এ ধরনের ব্যাপক বিদ্রোহ ইতিপূর্বে আর কখনো সংঘটিত হয়নি। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের মন্ত্র মুখর উপন্যাসে আগস্ট বিপ্লব বা ভারত ছাড়া আন্দোলনের গণজাগরণের চিত্র ধরা পড়ে।

৯. নতুন নেতৃত্বের আবির্ভাব

আন্দোলনের শুরুতেই সরকার দেশে প্রথম শাড়ির অধিকাংশ নেতাকে গ্রেফতার করার জনসাধারণ সম্পন্ন ভাবে নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ে। নেতৃত্বের অভাবে আন্দোলনকারীদের পূর্ণ সংগঠন, পরিকল্পনা বা কর্মসূচি কিছুই ছিল না। এই পরিস্থিতিতে আন্দোলনের পরিচালনার প্রয়োজনে নতুন নতুন নেতার আবির্ভাবের মধ্যে দিয়ে ভারতবাসীর সংগ্রামী শক্তি ও স্বাধীনতা লাভের ইচ্ছা যে কত প্রবাল ও প্রচন্ড তাও সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়।

১০ ভারতের স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করন

সর্বোপরি, মহাত্মা গান্ধী নেতৃত্বে এই সংগ্রাম অহিংস্র নীতিকে সম্পূর্ণভাবে মেনে চলতে ব্যর্থ হলেও, ভারতের স্বাধীনতাকে সুনিশ্চিত করেছিল। এই দিকটি বিবেচনা করলে আগস্ট আন্দোলন ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক চির স্মরণীয় অধ্যায়।

উপসংহার

ভারতছাড়ো আন্দোলনের গুরুত্ব এখানেই যে-এই আন্দোলন প্রমাণ করে যে, মুক্তি সংগ্রামে ভারতের জয় অনিবার্য। কখনো ও কি অবস্থায় ক্ষমতা হস্তান্তরিত হবে এবং স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর ভারতে কি ধরনের সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে এরপর কেবলমাত্র ওইটুকুই অমীমাংসিত থাকে। প্রকৃতপক্ষে এই আন্দোলন তীব্রতা কে ভয় পেয়ে ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিল যে, ভারতবাসীকে এবার স্বাধীনতা প্রদান করতে হবে।

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বইয়ের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর

Leave a Comment