দেশীয়রাজ্যগুলির বৈশিষ্ট্য
ব্রিটিশ সরকার ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি হাত থেকে ভারতের প্রত্যক্ষ শাসনভার গ্রহণ করে। এই সময় ভারতে প্রায় ৬০ শতাংশ ভূখণ্ডের প্রত্যক্ষ ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। অবশিষ্ট প্রায় চল্লিশ শতাংশ ভূখণ্ডে বিভিন্ন স্বায়ত্ত শাসিত রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল। এই রাজু বলে সাধারণভাবে দেশের রাজ্য নামে পরিচিত। এইসব রাজ্যে ব্রিটিশদের প্রত্যক্ষ শাসন প্রতিষ্ঠা হয়নি, দেশীয় রাজা বা শাসকরা এইসব রাজ্য শাসন করতেন। এ রাজিবুলের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়, যেমন –
১. স্বৈরশাসন
দেশ ও রাজ্যগুলিতে পাশ্চাত্যের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ছিল না। সেখানকার শাসক গো নিজেদের স্বৈরাশাসন প্রতিষ্ঠা করতেন। রাজু চূড়ান্ত ক্ষমতা ও একাধিক পত্র কেন্দ্রীভূত হতো রাজ্যের সর্বোচ্চ শাসক ও তার নিকট আত্মীয়দের হাতে। বিভিন্ন দেশীয় রাজ্যের স্বৈরাচারী শাসকগণ ওয়াদিয়ার মহীশূরের শাসক, ছত্রপ্রতি মহারাষ্ট্রের ভোঁসলে সম্প্রদায়ের শাসক, নিজাম হায়দ্রাবাদের শাসক, বাদশা, মহারাজ, রাজা, নবাব, ঠাকুর, ওয়ালী, ইনান্দার প্রভৃতি বিভিন্ন ধর্মের মর্যাদা সূচক উপাধি গ্রহণ করতেন। তবে ব্রিটিশ সরকার বিভিন্ন স্তরে দেশীয় শাসকদের সাধারণভাবে রাজকুমার ও প্রিন্স বলে অবহিত করতেন।
২. আয়তন
দেশীয় রাজ্যগুলির বিভিন্ন ধরনের আয়তন ছিল। কোন কোন দেশীয় রাজ্যের আয়তন ইউরোপের অনেক রাষ্ট্রের আয়তনের তুলনায় বড় ছিল। বৃহদায়তন দেশীয় রাজ্যগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল হায়দ্রাবাদ, জম্মু ও কাশ্মীর, মহীশূর, বারোদা প্রভৃতি। সর্ববৃহৎ দেশীয় রাজ্য হায়দ্রাবাদের আয়তন ছিল ৮২, ৬৯৮ বর্গ কিলোমিটার। বড় রাজ্য গুলি ছাড়াও অধিকাংশ দেশীয় রাজ্যের আয়তন ছিল খুবই ছোট ও মাঝারি ধরণের। তাদের জনসংখ্যায় ছিল খুবই কম।
৩. তোপধ্বনি
দেশীয় রাজ্যের শাসন ব্রিটিশ সামরিক বিভাগের বিভিন্ন স্তরে নিযুক্ত হওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হতেন। কোন শাসক ভারতের রাজধানীতে এলে ব্রিটিশ সামরিক বিভাগ তোপধ্বনি বা গান স্যালুট এর মাধ্যমে তাদের সম্মান দিত। বিভিন্ন স্তরে দেশীয় শাসকের জন্য তিন থেকে ২১ বার পর্যন্ত তোপধ্বনি ব্যবস্থা ছিল। তোপধ্বনি সংখ্যা নির্দিষ্ট হতে দেশীয় রাজ্যের রাজকোষের সমৃদ্ধি, শাসকের বংশ কল্যালীন্য, ব্রিটিশ রাজ এর প্রতি অনুগত ইত্যাদি বিচারের মাধ্যমে। মিশিস মর্যাদা সম্পন্ন শাসকের জন্য বেশি তোপধ্বনি করা হতো। অবশ্য মাত্র একশো কুড়িটি দেশীয় রাজ্যের অন্য তোপধ্বনি ব্যবস্থা ছিল।
৪. প্রজাদের দুরবস্থা
দেশীয় রাজ্যের প্রজাদের অবস্থানের মোটেই ভাল ছিল না। ব্রিটিশ শাসনের অধীনস্থ প্রজাদের তুলনায় দেশীয় রাজ্যের প্রজাদের ওপরে করের বোঝা সাধারণভাবে বেশি ছিল। তোদের কাছ থেকে শোষণ করা অর্থ শাসকরা নিজেদের বিলাস বসনে অকাতরে ব্যয় করতো। এসব রাজ্যের নাগরিক ব্রিটিশ ভারতের তুলনায় কম নাগরিক অধিকার বা আইনের শাসন ভোগ করতো।
৫. অনগ্রসরতা
বেশিরভাগ দেশীয় রাজ্য ব্রিটিশ ভারতের তুলনায় প্রায় সবদিক থেকে অনগ্রসর ছিল। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সামরিক, শিক্ষাগত প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশীয় রাজ্য গুলি ছিল প্রশ্চাতপদ। নিজেরা আত্মরক্ষা পর্যাপ্ত অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি তাদের ছিল না।
৬. অধীনতামূলক মিত্রতা নীতির প্রয়োগ
দেশীয় রাজ্যগুলিত বিটি স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে বড়লাট লর্ড ওয়েলেসলির 1798 খ্রিস্টাব্দে অধীনতামূলক মিত্রতা নীতির প্রবর্তন করে। হায়রাবাদ, সুরাট, তাঞ্জোর, কর্ণাটক ও অযথা প্রভৃতি বিভিন্ন দেশীয় রাজ্য বাধ্য হয়ে এক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে ব্রিটিশ শাসনের প্রতি পূর্ণ অনুগত্ত জানান। এভাবে ব্রিটিশ সরকার হাতে নিজেদের সর্বভৌম ক্ষমতা তুলে দিয়ে দেশীয় রাজারা নিজেদের হাতে শাসন ক্ষমতা ধরে রাখতে সক্ষম হয়।
৭.স্বত্ববিলোপ নীতির প্রয়োগ
ভারতের ব্রিটিশ শাসন বড়লাট লর্ড ডালহৌসি স্বত্ববিলোপ নীতির প্রয়োগ করে সাতারা, জয়েৎপুর, সম্বলপুর, উদয়পুর, ঝাসি, নাগপুর প্রভৃতি বিভিন্ন দেশীয় রাজ্য নিজ সাম্রাজ্যের ভুক্ত করেন।
৮. স্বাধীনতা রক্ষার প্রয়াস
সরকারি হিসেবে অনুসারে স্বাধীনতা লাভের প্রাক মুহূর্তে ভারতে অন্তত ৫৬৫ দেশে রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ১৪ই জুলাই ভারতের স্বাধীনতা আইনি দেশীয় রাজ্যগুলিকে নিজেদের ইচ্ছা অনুসারে স্বাধীন অস্তিত্ব বজ ায় অথবা ভারত বা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অধিকার দেয়া হয়।
উপসংহার
স্বাধীনতা লাভের পর ভারতীয় ভৌগোলিক সীমার মধ্যে অবস্থিত হায়দ্রাবাদ, ভূপাল, ত্রিবাঙ্কুর সহ বহু দেশের রাজ্য নিজেদের স্বাধীনতা বজায় রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। ফলের প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু ঘোষণা করেন যে, ভারতের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে কোন স্বাধীনতাব্বে দেশীয় রাজ্যের অস্তিত্ব শিকার করা হবে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল দৃঢ়তার সঙ্গে বেশ কয়েকটি দেশীয় রাজ্য সামরিক অভিযান চালায় সেগুলি ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের যোগ দিতে বাধ্য করেন।