ভারতীয় মালিকানায় ভারতের শিল্পের বিকাশ
উপনিবেশিক আমলের ভারতীয় মালিকানা এ দেশের শিল্পের বিকাশে নানা প্রতিবন্ধকতা ছিল। তা সত্ত্বেও উপনিবেশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে থেকে ভারতের শিল্প উদ্যোগ ইউরোপীয় মূলধনের। পাশাপাশি ভারতীয় মালিক আমাদের মূলধন ও নিয়োজিত হতে থাকে। ফলে দেশের উদ্যোগে এ দেশের বিভিন্ন শিল্পের বিকাশ ও অগ্রগতি শুরু হয়। দেশে উদ্যোগে ভারতের শিল্পায়ন সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো-
১. বস্ত্র শিল্প
ভারতীয় মালিকানায় ১৯ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে থেকে এদেশের বস্ত্র শিল্পের সর্বাপেক্ষা উন্নতি ঘটে। মূলত মুম্বাইকে কেন্দ্র করে বস্ত্র শিল্প প্রসার ঘটে। ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে পারসী শিল্প প্রতিকার কাউয়াসজি নানাভাই দাভর মুম্বাইতে সর্বপ্রথম একটি কাপড়ের কল প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর একে একে আমেদাবাদ, সোলাপুর, নাগপুর, সুরাট, কানপুর প্রভৃতি স্থানে কাপড়ের কল স্থাপিত হয়। বিশিষ্ট ভারতীয় শিল্পপতি জামশেদজি টাটার উদ্যোগে নাগপুরে ‘এম্প্রেস মিল ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত হয়। ভারতের ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে মোট ৬৫টি সুতি বস্ত্রের কল ছিল। এই সংখ্যা বেড়ে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে ২০৬ টি হয়। এই সময় এই কলগুলিতে কর্মরত শ্রমিকদের সংখ্যা ছিল ১ লক্ষ ৯৬ হাজার। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে বস্ত্র রপ্তানিতে ভারত ছিল ব্রিটেনের পর এই অর্থাৎ বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে। অধ্যাপক মরিস ডি. মরিস বলেন যে, ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে মধ্যে মুম্বাইয়ে ৮৫টি এবং আমেদাবাদের ৪৯ টি কাপড়ের কল স্থাপিত হয়।
২. কয়লা
ভারতীয় মালিকানায় এ দেশে কয়লা শিল্পের প্রসার ঘটে। উনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে দ্বারকানাথ ঠাকুরের ‘কার, টেগোর এন্ড কোম্পানি’ কয়লা খনির উৎপাদকে ফুজি বিনিয়োগ করে। ভারতীয় মালিকানায় বর্ধমান জেলায় রানীগঞ্জ, আসানসোল, বরাকর, অন্ডলা প্রভৃতি স্থানে চল্লিশটি এবং ছোটনাগপুর ও মানভূম জেলায় ৬২টি ছোট ছোট কলা খনি ছিল বলে ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে একটি সরকারি রিপোর্ট থেকে জানা যায়। ভারতের শিল্পপত্নী জামশেদ জি টাটার উদ্যোগে ঝরিয়ায় উন্নত মানের কয়লা সন্ধান পাওয়া যায়। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে এইসব ছোট ছোট কয়লা খনি নিয়ে ইন্ডিয়ান মাইনিং ফেডারেশন গঠিত হয়।
৩. ইঞ্জিনিয়ারিং ও ভারী শিল্প
ইঞ্জিনিয়ারিং ও ভারী শিল্পে ভারতীয় পুচি প্রতিরা কিছু মূলধন বিনিয়োগ করে।
(১) প্রথমদিকের উদ্যোগ : কিশোরী লাল মুখোপাধ্যায় ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে হাওড়া শিবপুর একটি লৌহ কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। ইংরেজ ইঞ্জিনিয়ারিং মার্টিন ও বাঙালি ইঞ্জিনিয়ার রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে যৌথভাবে মার্টিন এন্ড কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে রেলপথ নির্মাণের কাজ শুরু করে। নওয়াল কিশোর নামে জৈনক ব্যবসায়ী লক্ষৌন-এ ‘লক্ষৌন আয়রন এন্ড স্টিল কম্পানি’প্রতিষ্ঠা করে।
(২) টাটার উদ্যোগ : লৌহ ও ইস্পাত শিল্পে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ভূমি পালন করেন শিল্পপতি জামশেদজি টাটা। এই সময় বাঙালির অধ্যাপক প্রথমা নাথ বসু ময়ূরভঞ্জের গোরুমহিষানি অঞ্চলের লৌহ খনির আবিষ্কার ১৯০৩-০৪) করেন এবং এরই ভিত্তিতে জামশেদজি টাটাকে লৌহ ইস্পাত কারখানা স্থাপনে রাজি করান। তিনি 1967 খ্রিস্টাব্দে জামশেদপুর টাটা আইরন এন্ড স্টিল কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে থেকে বিশুদ্ধ ইস্পাতের উৎপাদন শুরু হয়।
(৩) জাহাজ নির্মাণ : মাদ্রাজে জাতীয়তাবাদী নেতা চিদাম্বরম পিল্লাই ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের স্বদেশী জাহাজ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন।
৪. চা শিল্প
দ্বারকা নাথ ঠাকুর, মতিলাল শীল, মির্জা ইস্পাহানি প্রমুখ ভারতীয় চাষ শিল্পে কিছু মূলধন বিনিয়োগ করেন। ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে জয়চাঁদ সান্যাল জলপাইগুড়ি টি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন।
৫. রাসায়নিক শিল্প
বিখ্যাত বিজ্ঞানের প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ওষুধ রাসায়নিক দ্রব্যের কারখানা বেঙ্গল কেমিক্যাল এন্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্ক্স প্রতিষ্ঠা করেন।
৬. অভ্র শিল্প
১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে একটি সরকারি রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, হাজারীবাগ জেলায় কোডারাম অঞ্চলে ৩১১ টি অভ্র ক্ষণির মধ্যে ৬৯ টি ভারতীয় মালিকানাধীন এবং এগুলির মধ্যে ৪৬ টি খনির মালিক ছিল বাঁকুড়া বিষ্ণুপুরের বিখ্যাত সাহান পরিবার।
৭. স্বদেশী আন্দোলনের সময় শিল্প
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কার্জন ব্রিটিশ ভারতের সরকারের অধীনে একটি পৃথক বাণিজ্য ও শিল্প বিভাগ গঠন করে। স্বদেশী আন্দোলনের সময় ১৯০৫-১৯১১ খ্রিস্টাব্দে, ভারতীয় মালিকানায় তাঁত বস্ত্র, সুতি কল, গেঞ্জি, সাবান, চিনি, লবণ, ওষুধ, তেল, চিরুনি, দেশলাই, চামড়া যার সামগ্রিক প্রভৃতি উৎপাদনের জন্য বেশ কিছু কারখানা স্থাপিত হয়। এছাড়া ভারতীয় উদ্যোগে কাগজ, কাঁচ, সিমেন্ট, ধাতব দ্রব্য প্রভৃতি শিল্পের বিকাশ হতে থাকে।
উপসংহার
ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের শিল্পের বিকাশে ভারতীয় পুঁজিপ্রতিরা ইউরোপীয় পুঁজিপ্রতিদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সাফল্য লাভ করে। প্রসঙ্গত উল্লেখ যে, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, ভারতের স্থানীয় এলাকায় চাহিদার উপর নির্ভর করে এদেশে শিল্প কারখানা গড়ে ওঠে। তাই প্রকৃত শিল্পায়ন সম্ভব হয়নি।