বেশি ঠান্ডা লড়াইয়ের ট্রুম্যান নীতি ও মার্শাল পরিকল্পনার ভূমিকা কি ছিল?

Table of Contents

সূচনা

ইউরোপের শহীদ রাশিয়ার আধিপত্য ও সাম্যবাদী আদর্শের বিস্তার রোধ করার জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট যে নীতি ঘোষণা করেন ১৯৪৭ বারো মার্চ তার ট্রুম্যান ডকট্রিন নামে এবং তৎকালীন বিদেশ মন্ত্রী জর্জ মার্শাল যে নীতি ঘোষণা করেন ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে পাঁচজন তাম মার্শাল পরিকল্পনা নামে পরিচিত।

ট্রুম্যান নীতি ও ঠান্ডা লড়াই

মূল বক্তব্য

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ১২ মার্চ মার্কিন সংসদের এক যৌথ অধিবেশনের ট্রুম্যান বলেন যে এখন থেকে পৃথিবীর যে কোন স্থানে স্বাধীন জনগণ যদি সশস্ত্র সংখ্যা লঘু অথবা বাইরের শক্তির আধিপত্য বিস্তারে প্রচেষ্টাকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে, সেক্ষেত্রে তাদের সাহায্য করাই হবে আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্রের নীতি। এই ঘোষণায় ট্রুমার নীতি নামে পরিচিত। বলা বাহুল্য, ট্রুম্যান সশস্ত্র সংখ্যালঘু বলতে সাম্যবাদী বিদ্রোহীদের এবং বাইরের শক্তি বলতে সোভিয়েত ইউনিয়নকে বুঝিয়েছিলেন।

পটভূমি

১. চার্চিলের ফালটন বক্তৃতা

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্গত মৌসূরী প্রদেশের ফালটন শহরে এক বক্তৃতায় পূর্ব ইউরোপের রুশোপ্রভা বৃদ্ধির বিপদ সম্পর্কে এক ভাষণ দেন। এই ভার্সনে তিনি সাম্যবাদের প্রসার রোধ করার লক্ষ্যে ইঙ্গ মার্কিন যৌথ প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান।

২. কেন্নান বেস্টনী নীতি

মার্কিন বিদেশনীতির উপদেষ্টা জর্জ এফ. কেন্নান সোভিয়েত সম্প্রসারণ প্রতিহত করার লক্ষ্যে এক প্রবন্ধ লিখিয়ে জানান, যুদ্ধবিধ্বস্ত সোভিয়েত রাশিয়ার দিক থেকে কোন আগ্রাসনের আশঙ্কা নেই। রুশো সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অহিত কোন যুদ্ধ না গিয়ে আমেরিকার উচিত হবে যে অঞ্চলে সোভিয়েত প্রভাব রয়েছে তাকে সীমাবদ্ধ রাখা। কেন্নানের এই নীতি ট্রুম্যানকে তার নীতি ঘোষণা উদ্বুদ্ধ হয়।

উদ্দেশ্য

১. রাজনৈতিক

যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে ইউরোপে ক্রমবর্ধমান সোভিয়েত বা সাম্যবাদী প্রভাব প্রতিহত করার জন্য প্রতিরোধমূলক কৌশল গ্রহণ।

২. অর্থনৈতিক

ট্রুম্যান নীতি ঘোষণার অন্যতম লক্ষ্য ছিল অর্থ সাহায্যের নামে অন্যান্য দেশকে অস্ত্র ও শিল্পচর দ্রব্য বিক্রি করে বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটানো।

গুরুত্ব

১. তুরস্ককে আর্থিক সাহায্যের ঘোষণা

ট্রুম্যান নীতি ঘোষণার পর অ্যামেরিকা যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে সোভিয়েত প্রভাব মুক্ত করার জন্য কয়েকশত মিলিয়ন ডলার অর্থ সাহায্যের কথা ঘোষণা করে। ফলে তুরস্ক তার স্বাধীন অস্তিত্ব ধরে রাখতে সক্ষম হয়।

২. গ্রিসে কমিউনিস্ট তৎপরতা প্রশমন

রাশিয়ায় সাম্যবাদ থেকে দূরে থাকার পুরস্কার রূপে আমেরিকা গ্রিসের রাজতন্ত্রী সরকারকে ৪০০ মিলিয়ন ডলার অর্থ মনজুর করে। গ্রীসে কমিউনিস্ট তৎপরতা প্রাশমিত হয়।

৩. ইরানের সঙ্গে চুক্তি

ইরানকে সোভিয়েতের প্রভাব মুক্ত করার জন্য আমেরিকায় ইরানের সঙ্গে এক চুক্তি করে। আসলে ইরানের তেলের খনি গুলি দখল করাই ছিল আমেরিকার লক্ষ্য।

৪. ঠান্ডা লড়াইয়ের সূচনা

ট্রুম্যান নীতির বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এক ঠান্ডা লড়াই পরিবেশ তৈরি করে। এই ঘোষণার পর সোভিয়েতের নেতৃত্বাধীন সাম্যবাদী জোটের সঙ্গে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী জোটের ঠান্ডা লড়াই শুরু করে।

৫. আন্তর্জাতিক সংকট

ডি. এফ. ফ্লেমিং বলেছেন, ট্রুম্যান ঘোষণা ফলে এমন ধারণা সৃষ্টি হয় যে এখান থেকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের চাপ ও পাল্টা চাপ ছাড়া কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হবে না। তিনি এই পরিস্থিতিতে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল বলে অবহিত করেছে।

মার্শাল পরিকল্পনা ও ঠান্ডা লড়াই

পরিচিতি

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ৫ জুন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় এক বক্তৃতায় আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জজ সি. মার্শাল তুমের নীতির উদ্দেশ্যকে সফল করতে একটি পরিকল্পনা পেশ করেন। এই পরিকল্পনায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত সমগ্র ইউরোপের আর্থিক পুনরুজ্জীবনের কথা বলা হয়। এই উদ্দেশ্যে তিনিই তার বক্তৃতায় ERP নামে এক কর্মসূচির কথা ঘোষণা করেন। এই মার্শাল পরিকল্পনা নামেই খ্যাত। মার্শাল তার ভাষণে বলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরোপের বিভিন্ন দেশে দারিদ্র, ক্ষুধা, হতাশা ও বেকারত্বসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক সংকটমোচনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র অর্থ সাহায্য দেবে।

পাঠভূমি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়কালে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশগুলির অর্থনীতি সম্পন্ন রূপে পুঙ্গ হয়ে পড়েছিল। এই সমস্ত দেশ আমেরিকার কাছ থেকে অর্থ সাহায্য না পেলে স্বাভাবিকভাবে সোভিয়েত রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়বে তখন আর এই সমস্ত দেশকে সাম্যবাদের প্রভাব থেকে মুক্ত করা যাবে না। আমেরিকা পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্শাল এই সত্যের পটভূমিকায় তার পরিকল্পনা নীতি গ্রহণ করেন।

উদ্দেশ্য

মার্শাল পরিকল্পনার উদ্দেশ্য গুলি ছিল –

১. সোভিয়েত প্রভাব মুক্ত ইউরোপ গঠন

যুদ্ধ বিধ্বস্ত ইউরোপের দেশগুলিকে আর্থসাজা দিয়ে তাদের সোভিয়েত প্রভাব থেকে মুক্ত করা।

২. আন্তর্জাতিক বাজার তৈরি

আর তো সাহায্য দিয়ে পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশগুলি অর্থনীতি মজবুত করে এক আন্তর্জাতিক বাজার গড়ে তোলে।

৩. মার্কিন রাষ্ট্র জোটের শক্তি বৃদ্ধি

অর্থ সাহায্য গ্রহণকারী দেশগুলিকে মার্কিন নীতির প্রতি আস্থাশীল করে তুলে মার্কিন রাষ্ট্র জোটের শক্তি বাড়ানো।।

৪. মার্কিন আধিপত্য প্রতিষ্ঠা

আর্থসাঞ্জ গ্রহণকারী দেশগুলির অভ্যন্তরীণ ও বিদেশ নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রেও মার্কিন আধিপত্য কায়েম করা।

প্রয়োগ

১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে জুন মাসের মধ্যে পশ্চিম জার্মানি সহ পশ্চিম ইউরোপের ১৬ টি দেশে মার্শাল পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। এই সমস্ত দেশ মিলিত হয়ে গঠন করেছিল ‘ইউরোপীয় অর্থনৈতিক সহযোগিতা সংস্থা’ । মাশাল্লাহ পরিকল্পনা গ্রহণকারী দেশ গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল পশ্চিমী জার্মানি, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, লক্সেমবুর্গ, ডেনমার্ক, গ্রিস, আইসল্যান্ড, আয়ার্ল্যান্ড, ইতালি, নেদারল্যান্ড, নরওয়ে, পর্তুগাল, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, ইংল্যান্ড ও তুরস্ক।

গুরুত্ব

মার্শাল পরিকল্পনার গুরুত্ব ছিল অত্যন্ত সুদূর প্রসারী –

১. আর্থিক স্বয়ম্ভরতা বৃদ্ধিতে

ইউরোপের ১৬ টি দেশ এই পরিকল্পনা গ্রহণ করে তিন বছরে ১২৫০ কোটি ডলার লাভ করে। এর মধ্যে অবশ্য কোন কমিউনিস্ট দেশ ছিল না। এর ফলে ব্রিটেন, ফ্রান্স, পশ্চিমী জার্মানি আর্থিক স্বয়ম্ভরতা ফিরে পায়। ইউরোপ মোট শিল্পের উদপাদন মেরেছিল শতকরা ২৫ ভাগ এবং কৃষিতে উৎপাদন বেড়েছিল শতকরা দশভাগ।

২. পুঁজিবাদী প্রবণতার

গণতান্ত্রিক দেশগুলির সৌভিক সাম্যবাদ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী জোটের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ফলে বিশেষ এগিয়ে যায় রাশিয়া ও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এই দুই বিরোধী গোষ্ঠীর মধ্যে ঠান্ডা লড়াই সূচনা ঘটে।

৩. কমিউনিস্ট দলের পরাজয়

ইউরোপের বিভিন্ন দেশের গণতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী দলগুলি নির্বাচনী কমিউনিস্ট ও সমাজতান্ত্রিক দলগুলিকে পরাজিত করতে সমর্থন হয়। ফলে সেই সব দেশে ধনতান্ত্রিক ধাঁচের গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।

৪. চেকোশ্লোভাকিয়া কমিউনিস্ট শাসন প্রবর্তন

চেকোশ্লোভাকিয়া নির্বাচিত বৈধ কোয়ালিসন সরকার মার্শাল পরিকল্পনার প্রতি আগ্রহ দেখালে স্টালিনের নির্দেশে সেখানে কমিউনিস্টরা ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে জোর করে বৈধ চেক সরকারের উচ্ছেদ ঘটিয়ে কমিউনিস্ট শাসন কায়েম করে।

উপসংহার

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে ঔদ্ধত্যপূর্ণ মনোভাব আর সোভিয়েতে ইউনিয়নের তাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মানসিকতা বিশ্ব রাজনীতিকে জটিল আবর্তন নিক্ষেপ করে। তবুও মার্শাল পরিকল্পনা ও ট্রুম্যান নীতি তার উদ্দেশ্য পূরণে অনেকটা সফল হয়েছিল বলা চলে। এ প্রসঙ্গে ফিটম্যান বলেছেন -“১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের জো নিয়ে যখন মার্শাল প্লান্ট কর্মসূচি অবসান ঘটে ততদিন প্রত্যাশা মতই সাফল্য অর্জন করেছে”।

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বইয়ের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর

Leave a Comment