ভূমিকা
জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রসারে বেলগ্রেড সম্মেলন এবং তার পরবর্তী কায়রো, লুসাকা, আলজিয়ার্স প্রভৃতি জোট নিরপেক্ষ সম্মেলন গুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। বেলগ্রেড পরবর্তী জোট নিরপেক্ষ সম্মেলন গুলিতে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার লোককে বর্ণ বৈষম্য এবং সাম্রাজ্যবাদী শোষণের বিরুদ্ধে সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
বেলগ্রেড ও পরবর্তী জোট নিরপেক্ষ সম্মেলন সমূহ
« বেলগ্রেড সম্মেলন
আগের প্রশ্নের আলোচনার আয়োজন, অংশগ্রহণকারী দেশ ও নেতৃবৃন্দ, গৃহীত সিদ্ধান্ত ও গুরুত্ব অংশ দেখো।
« কায়রো সম্মেলন
১. প্রস্তুতি
কায়রো সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে কলম্বোতে তার একটি প্রস্তুতি শিবির বসে। এই প্রস্তুতি শিবিরে সোমালিয়ার প্রতিনিধি একটি প্রস্তাব রাখেন। এই প্রস্তাবে তিনি বলেন যে যাবতীয় মতপার্থক্য শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে সাবধান করতে হবে। এই প্রস্তাবের ভিত্তিতে প্রস্তুতি শিবিরের সিদ্ধান্ত হয় যে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সনদ অনুযায়ী বিশেষত আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার কে গুরুত্ব দিয়ে যাবতীয় দ্বন্দ্বের মীমাংসা করা হবে।
২. আয়োজন
১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে পাঁচ অক্টোবর কায়রো সম্মেলনের অনুষ্ঠিত হয় যা চলে ১০ অক্টোবর পর্যন্ত।।
৩. অংশগ্রহণকারী দেশ ও নেতৃবৃন্দ
এই সম্মেলনে বিশ্বের ৪৭ টি দেশ অংশ নেয়। এই কায়রো সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন ইজি পট বা সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি গামাল আবদেল নাসের।
৪. গৃহীত ও সিদ্ধান্ত
কায়রো সম্মেলনে বেশকিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, যেমন-
(১) শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং জোড় নিরপেক্ষ আদর্শে বিশ্বাসী দেশগুলির স্বাধীনভাবে বিদেশ নীতি পরিচালনা করবে।
(২) জোট নিরপেক্ষ দেশ গুলি বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলির স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সমর্থন জানাবে।
(৩) ঠান্ডা যদি প্রভাবে গড়ে ওঠা কোন ধরনের সামরিক জোটেই জোটনিরপেক্ষ কোন দেশ অংশ নেবে না।
(৪) বৃহৎ শক্তিধর আষ্টের মধ্যেকার সংঘাদেরিয়ে অন্য কোন দ্বিপাক্ষিক সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়া যাবে না, তবে সেগুলি যেন ঠান্ডা যুদ্ধ প্রসূত উত্তেজনাকে ত্বরান্বিত না করে তা সুনিশ্চিত করতে হবে।
(৫) জোট নিরপেক্ষ কোন দেশ অন্য কোন দেশকে সামরিক ঘাঁটির সংস্থানের অনুমতি দিতে পারে সেক্ষেত্রে দেখতে হবে যে ওই ঘাঁটি কোন বৃহৎ শক্তিধর রাষ্ট্র যেন নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে না পারে।
৫. গুরুত্ব
কায়রো সম্মেলনে আন্তর্জাতিক সমস্যা গুলিকে, বিশেষত সাম্রাজ্যবাদ, বর্ণ বিদ্বেষ মূলক নীতি, আণবিক অস্ত্র ব্যবহারের প্রকৃতি। বিষয়গুলির আকর্ষণের উপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল।
« লুসাকা সম্মেলন
১. প্রস্তুতি
লুসাকা শীর্ষ সম্মেলনের আগে কিছু দেশের বিদেশ মন্ত্রী এক প্রস্তুতি সম্মেলনে মিলিত হন। এই প্রস্তুতি সম্মেলনে, লুসাকা সম্মেলনের আলোচিত বিষয়ে কিছু বিষয় স্থির করা হয়, যেমন –
(১) শান্তি, স্বাধীনতা, উন্নয়ন, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা গড়ে তোলার লোককে একটি সনদ গঠন।
(২) জোট নিরপেক্ষ দেশগুলি স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং ভৌগোলিক অখন্ডতা রক্ষার লক্ষ্যে কিছু নিয়ম নীতি নির্ধারণ।
(৩) আর্থিক সহযোগিতা ও উন্নয়নের রূপরেখা তৈরি।
২. আয়োজন
১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে ৮ সেপ্টেম্বর আফ্রিকার শর্ত স্বাধীনতা প্রাপ্তদের জাম্বিয়ার রাজধানীর লুসাকা তৃতীয় নিরপেক্ষ সম্মেলন বসে, যা শেষ হয় ১০ সেপ্টেম্বর।
৩. অংশগ্রহণকারী দেশ ও নেতৃবৃন্দ
এই সম্মেলনে যোগ দেয় ৫৪ টি দেশ। সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন জাম্বিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান কেনেথ কাউন্ডা।
৪. গৃহীত সিদ্ধান্ত
লুসাকা সম্মেলনে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সংবাদ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। যেমন –
(১) এই সম্মেলনে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণ পরিশ্রমের বিরোধিতা করে অত্যাচারীদের প্রতি সমর্থন জানানো হয়।
(২) ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে শান্তি অঞ্চল হিসেবে ঘোষণার দাবি তোলা হয়। এছাড়া
(৩) বিশ্ব অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তনের আহ্বান জানানো হয়। সম্মেলনে গৃহীত ঘোষণা পত্র টির নাম ছিল ‘Declaration on Non-alignment and Economic Progress’.
৫. গুরুত্ব
এই সম্মেলনে তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলির অর্থনীতির দাবি-দাওয়ার উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়। এছাড়াও এই সমস্ত দেশের সাধারণ মানুষের দারিদ্র্য ও আর্থিক বৈষম্যকে দূরীকরণের ওপরেও অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
« আলজিয়ার্স সম্মেলন
১. প্রস্তুতি
আলজিয়ার্স সম্মেলনে প্রস্তুতি হিসেবে জর্জটাউনে বিভিন্ন জোড়া নিরপেক্ষ দেশের বিদেশ মন্ত্রীরা মিলিত হন। এই প্রস্তুতি সম্মেলনের পরবর্তী আলজিয়ার্স সম্মেলনের আলোচনা করা হবে এমন কিছু বিষয়ে সুজি তৈরি করা হয়, যেমন –
(১) ইউরোপে নিরাপত্তা রক্ষা ও ইউরোপের অন্তর্বর্তী সমস্যা সমাধান পদ্ধতি।
(২) ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল, মধ্যপ্রাচ্য এবং ভারতীয় মহাসাগরের অঞ্চলকে Zone of Peace হিসেবে ঘোষণা।
(৩) নির্জট আন্দোলনভুক্ত দেশগুলো পারস্পরিক আর্থিক সহযোগিতা বৃদ্ধি প্রভৃতি।
২. আয়োজন
চতুর্থ জোড় নিরপেক্ষ সম্মেলনটি আয়োজিত হয় আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্স। এই সম্মেলন শুরু হয় ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে ৫ সেপ্টেম্বর আর শেষ হয় ৯ সেপ্টেম্বর।
৩. অংশগ্রহণকারী দেশ ও নেতৃবৃন্দ
এই সম্মেলনে ৭৬ টি সদস্য রাষ্ট্র যোগ দেয়। সদস্য রাষ্ট্রগুলো ছাড়াও পর্যবেক্ষক হিসেবে নয়টি দেশ এবং অতিথি হিসেবে তিনটি দেশ এই সম্মেলনে যোগদান করেছিল। এছাড়াও এই সম্মেলনে রাষ্ট্রসংঘ, আফ্রিকীয় সংহতি সংস্থা, আরব লিগ এবং বেশ কয়েকটি শ্রমিক সংগঠন অংশগ্রহণ করে।
৪. গৃহীত ও সিদ্ধান্ত
(১) এই সম্মেলনে ভারতীয় মহাসাগরীয় অঞ্চলকে শান্তির অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
(২) নয়া আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা খসড়া তুলে ধরা হয়।
(৩) আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের প্রস্তাব গৃহীত হয়।
৫. গুরুত্ব
এই সম্মেলনের অন্যতমের গুরুত্ব হল যে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ সভা কর্তৃক ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে Zone of Peace হিসেবে ঘোষণা। এছাড়াও এই অর্থনৈতিক প্রস্তাবকে স্বীকৃতি জানানো হয়।