সূচনা : মানুষের লিখতে শেখার হাজার হাজার বছর আগে থেকে লোকমুখে বিশ্বের বিভিন্ন সভ্যতা পৌরাণিক কাহিনীগুলির প্রচলন ছিল। ভারত, রোম, গ্রীস, মিশর, চীন, ব্যাবিলন, মেসোপোটিয়াম ইত্যাদি দেশের পৌরাণিক কাহিনীগুলির মধ্যে বেশ কিছু বিষয়গত সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়, যথা- বিশ্ব সৃষ্টির রহস্য, মানবদৃষ্টি তত্ত্ব, মহাপ্লাবন প্রভৃতি।
পৌরাণিক কাহিনী গুলির মধ্যেকার সাদৃশ্য সমূহ
(১) বিশ্বসৃষ্টির রহস্য
বিশ্বের বেশ কিছু দেশের পৌরাণিক কাহিনীতে বিশ্ব সৃষ্টি রহস্যের উল্লেখ মেলে-
(১) ব্যাবিলন সুমের : ব্যাবলনীয় সৃষ্টি তত্ত্বের পৌরাণিক কাহিনী গড়ে উঠেছিল সুমেরীয় সৃষ্টি তত্ত্ব থেকে, যার নাম ছিল এনুমা এলিশ। এই নমুনা এলিশ থেকে জানা যায়- ব্যাবিলনের দেবতা ছিল মার্দুক। এই মার্দুক তৈরি করেন স্বর্গ ও মর্ত।
(২) মিশর : মিশরের পৌরাণিক ধারণা অনুযায়ী সৃষ্টি আদি পর্বে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ছিল কালো জলের পূর্ণ। এই জল থেকেই আবির্ভূত হয় আদি দেবতা রে-আতুম। তিনি থুতু ছেটালে, তা থেকে জন্ম নেয় সু (বাতাসের দেবতা) এবং তেফোনাত (বাষ্পের দেবতা) । সু এবং তেফনাত জন্ম দেয় দুই সন্তানের, এরা হলেন- নুত (আকাশ) এবং গেব (মর্ত) এদের প্রজন্মের পরে সৃষ্টি হয় পৃথিবী।
(৩) চীন : চীন দেশের পুরান কথা থেকে জানা যায়, আদিতে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ছিল একটা প্রকাণ্ড ডিম, যার ভিতরে চির কেবল সীমাহীন শূন্যতা। সেই ডিম ফুটে বেরিয়ে আসে বামনাকৃতির প্রথম জীবন পানকু। তার দেহ থেকে তৈরি হয় গাছপালা, মাটি, নদ নদী, বাতাস।
(৪) ভারত : হিন্দুদের প্রধান তিন দেবতা হলেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর। এদের মধ্যে ব্রহ্মা হলেন সৃষ্টির দেবতা, বিষ্ণু হলেন স্থিতির দেবতার মহেশ্বর বা শিব হলেন প্রলয়ের দেবতা। হিন্দু ধারণা অনুযায়ী প্রতি হাজার বছরে মহাযুগের শেষের শিব আগুন ও দ্বারা পৃথিবী ধ্বংস করেন। তিনি একটি সোনার ডিমের ভেতরে সচ্ছল জীবনের বীজ সঞ্চিত রাখেন। সেই দিন ভেঙ্গেই ভগবান ব্রহ্মা নতুন পৃথিবীর সৃষ্টি করেন।
(২) মানবসৃষ্টি তত্ত্ব
(১) ব্যাবিলন : ব্যাবিলনের দুই দেবতা ছিলেন কিংগু ও মার্দুক। কিংগু তার রক্ত দিয়ে তৈরি করলেন মানুষ। আর মারদুক সেই মানুষকে দিয়ে ব্যাবিলনের মন্দির তৈরি করালেন।
(২) মিশর : প্রাচীন মিশরীয়দের দেবতা ছিলেন সু (বাতাসের দেবতা), তেফনাত (বাস্পের দেবতা) ও রে আতুম (আদি দেবতা)। অন্ধকার শুনে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে সু ও তেফনাত হারিয়ে যান না। রে-আতুম তাদের ফিরিয়ে আনতে সফল হন। শু ও তেফোনাত ফিরে যাওয়ার পর রে-আতুমের আনন্দাশ্রু তৈরি করেন।
(৩) গ্রীক ও রোম : জিৎ ও রোমান পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী টাইটানার হলেন ১২ জন অমর বীর। এদের মধ্যে সর্বাধিক বুদ্ধিমান টাইটান ছিলেন প্রমএথইউস। তিনি মাটিয়ার জল দিয়ে প্রথম মানুষ তৈরি করেন।
(৪) আমেরিকা : আমেরিকার আদিম না ভাজো উপজাতির মানুষেরা বিশ্বাস করতে চারজন দেবতা মিলে বাতাসকে দুটি শষ্যের শিষে প্রাণ সঞ্চারণ করতে বলেন। এই শিষ্য থেকে সৃষ্টি হয় প্রথম মানব আর মানবীর।
(৩) মহাপ্লাবন
(১) ওল্ড টেস্টামেন্ট : ওল টেস্টারমেন্ট নোহ জলপ্লাবনের কাহিনী হয়েছে। কাহিনী অনুযায়ী অত্যাধিক বৃষ্টিতে পৃথিবীর জলপ্লাবন দেখা দিলে ধার্মিক ও সিদ্ধ পুরুষ নোহ ঈশ্বরের উপদেশ মতো সুদীর্ঘ জাহাজ নির্মাণ করেন। সে জাহাজে উঠে নোহর আত্মীয়রা বেঁচে যান, আর ভ্রষ্ট দুরাত্মার মারা যায়।
(২) মেসোপটেমীয় পুরান : মেসোপটেমীয় পুরান কথা অনুযায়ী, দুষ্ট মানুষদের দৌরাত্ম বেড়ে যাওয়ায় দেবতারা পৃথিবীকে প্লাবিত করে মনুষ্য জাতিকে ধ্বংস করার উদ্যোগ নেয়। দেবতাদের এই সিদ্ধান্ত জলের দেবতা নলখাগড়া বনের কাছে ফাঁস করে দেন। নলখাগড়া দিয়ে কুঁড়ে তৈরি করা এক ব্যক্তি এই কথা নলকা গড়া গুলোর কাছ থেকে জানতে পেরে এক বিরাট নৌকা তৈরি করে নিজেদের পরিবার-পরিজনকে নিয়ে তাতে বাস করতে লাগলেন। নির্দিষ্ট দিনে মহাপ্লাবন সারা পৃথিবী জলে ডুবে গেলেও কেবলমাত্র যারা এই নৌকা আশ্রয় নিয়েছিলেন তাঁরাই বেছে রইলেন।
(৩) ভারতীয় পুরান : ভারতীয় মহাকাব্য মহাভারতের বন পর্বে, মৎস্য পুরাণে এই পৌরাণিক সাহিত্য শত পথ ব্রহ্মাণে মহাপ্লাবন বিবরণ মেলে। এই মহাপ্লাবন মৎস্য নদী তীরে এসে বৈবস্বত মনুকে বলে, বলবান মৎস্যদের হাত থেকে আমাকে রক্ষা করুন। মৎসের আঁকা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকায় মনু টাকে প্রথমে ঘটি, পরে যথাক্রমে জলাশয়, পুকুরে, নদীতে ও সাগরে রাখেন। সাগরব্যাপী মৎসের বিশাল রূপ দেখে মনোবৃত হয়ে পরলে মৎস্য আত্মপরিচয় দিয়ে জানালেন তিনি প্রজাপতি ব্রহ্মা। তিনি মনুকে আরো জানালেন অচিরেই পৃথিবী জলমগ্ন হবে। যাবতীয় জীবনের প্রাণ রক্ষায় উপায়ে হিসেবে ব্রহ্মা মনুকে একটি নৌকা দান করলেন এবং জানিয়ে রাখলেন প্রলয় কালে মনু যেন ওই মৎসের শৃঙ্গের সঙ্গে নৌকাটিকে বেঁধে রাখেন। মহাপ্লাবন শেষে মনু প্রজা সৃষ্টি করলেন। মনুসৃষ্ট বলে মানুষের নাম মানব।
পৌরাণিক কাহিনী গুলির গুরুত্ব
(১) ঈশ্বরের ভাবনায় : পৌরাণিক কাহিনীগুলি মানুষের ঈশ্বর ভাবনাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। পৌরাণিক কাহিনী গুলি পাঠের মাধ্যমে পাঠকের মনে ঈশ্বর মুখী হয়ে ওঠে। পৌরাণিক কাহিনী গুলি আপাতভাবে কাল্পনিক ও ভিত্তিহীন বলে মনে হলেও পাঠক মনে তা ঐশ্বরিক বিশ্বাসের জন্ম দেয়।
(২) বিজ্ঞান-পূর্ব যুগের ঘটনার অনুসন্ধান : বিজ্ঞান পূর্বযুগের ঘটনার অনুসন্ধানী পৌরাণিক কাহিনীগুলিতে গুরুত্ব কম নয়। অতীতে সমাজের পরিবেশে চারদিকে, আকাশে, মাটিতে যে সমস্ত প্রাকৃতিক ঘটনা ঘটেছে তার উত্তর খোঁজার তাগিদে এই প্রথম সৃষ্টি বিষয়ক পৌরাণিক কাহিনী গুলি গড়ে ওঠে। তাই ব্রিটেনের ফোকলো সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা পত্র তত্ত্ববিদ জর্জ লরেন্স বোম বলেছেন, পৌরাণিক কাহিনী হল বিজ্ঞান পূর্বযুগের বিজ্ঞান।
(৩) ঐতিহাসিক উপাদানের সূত্র হিসেবে : পৌরাণিক কাহিনীগুলিতে অনেক সময় প্রচ্ছন্নভাবে ঐতিহাসিক উপাদানের সূত্র মিলতে পারে। প্রাচীন গ্রিসের পৌরাণিক কাহিনী গুলোকে তাদের দেবতা, পূর্বপুরুষ এবং বীরপুরুষদের গল্প বলে ধরা হয়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে গ্রীষ্মের কাহিনী সূত্র আধুনিক গ্রিসে ট্রয় নাগরিক ও ট্রয়ের যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থান জানা গেছে। তাই জে. এফ. রিয়ারলেইন বলেছেন পৌরাণিক কাহিনীগুলি (Myth) গল্পের আকারে মানব সংস্কৃতির সত্য ঘটনা প্রকাশ।
(৪) আনুমানিক সময়কাল ও বংশতালিকা নির্ণয় : পৌরাণিক কাহিনীগুলির সঙ্গে তুলনামূলক পদ্ধতিতে যাচাই এর মাধ্যমে ইতিহাসের বহু সাল তারিখ নির্ণয় করা যায়। এছাড়াও পুরাণে বর্ণিত বিভিন্ন রাজার কাহিনী থেকে রাজ বংশের পরিচয় ও বংশ তালিকা জানা যায়। প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন পুরানে বহু প্রাচীন রাজবংশের নাম ও পরিচয় মেলে। পুরানে উল্লেখিত সমস্ত ঘটনার সত্যতা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ডঃ রণবীর চক্রবর্তী তার ভারত ইতিহাসের আদি পর্ব (প্রথম খন্ড) গ্রন্থে লিখেছেন- “পুরাণে বর্ণিত রাজবংশ গুলির অস্তিত্বের বেশিরভাগই স্বীকৃত সত্য।”
(৫) অর্থ সামাজিক ইতিহাস রচনা : অর্থ সামাজিক ইতিহাস রচনায় পৌরাণিক কাহিনীগুলি ভূমিকা কম নয়। বস্তুত পৌরাণিক কাহিনীগুলি বেশিরভাগই রচিত হয়েছিল সমকালীন অর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে। সমাজ ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির ওপর ভিত্তি করে অনেক সময় বিভিন্ন দেশের পৌরাণিক কাহিনীগুলি রচিত হয়েছিল। ভারতের প্রেক্ষাপটে পুরাণে বর্ণিত কলি যুগের সূত্র ধরে প্রাচীন ও আদি মধ্যযুগের ভারতবর্ষের সামন্ততান্ত্রিক কাঠামো বিশ্লেষণ উদ্যোগী হয়েছেন রামসরণ শর্মা সহ বেশ কিছু ঐতিহাসিক ও গবেষকগণ।