বাংলা সাহিত্যে স্বামী বিবেকানন্দের অবদান ও কৃতিত্ব
বীর সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ ভারতবাসীর জীবন যুদ্ধের চিরসারথী জীবনের উপল বন্ধুর দুর্গম পথে বিবেকানন্দ সাহিত্য দুঃসাহসী মানবাত্মার জয়গান। তাঁর সমুদ্র স্তমিত বন্ধু-কণ্ঠে শুনি উপনিষদের সেই আশ্চর্য জাগরণের বাণী : “উত্তিষ্ঠিত—জাগ্রত প্রাপ্য বরাণ নিবোধত।” সংসার পাশ মুক্ত এই দৃপ্ত বেদান্ত কেশরী জড়তা ও অজ্ঞানতার বিরুদ্ধেও ছিলেন সংগ্রামী সৈনিক। তিনি বলেন— ‘yes, the more everything seems to me to lie in manliness”. বাংলা সাহিত্যে এবং জাতির জীবনে এই manliness’ বা পৌরুষের আদর্শ সঞ্চার সম্ভবত তাঁর সবচেয়ে স্মরণ সুন্দর অবদান। তামাসিকতা ও জড়তায় সমাচ্ছন্ন, পাপবোধে ন্যুব্যু মানুষের মধ্যে যেখানে তিনি দেখেছেন—পুরুষত্বের অনুপস্থিতি, সেখানেই তাঁর মসি অসি হয়ে দেখা দিয়েছে। ঝিমিয়ে পড়া, সংকীর্ণ সংস্কারে বাঁধা হিসেবী মনগুলো যেন তাঁর কলমের অপ্রত্যাশিত চাবুকের আঘাতে চমকে উঠছে, দশ হাজার বছরের মমির মধ্যে জেগেছে প্রাণের স্পন্দন।
স্বামী বিবেকানন্দের রচনাসমূহঃ
তাঁর রচনাসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য : প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য (১৯০২), পরিব্রাজক (১৯০৫), বর্তমান ভারত (১৯০৫), ভাববার কথা (১৯০৭), এবং পত্রাবলী, তিনি কিছু কবিতাও লিখেছিলেন ইংরেজী, বাংলা সংস্কৃতেও। তার কবিতা ‘Kali the Mother’ ভাব ও ভাষা সম্পদের জন্য বিখ্যাত হয়। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ‘নাচুক তাহাতে শ্যামা’ নামে তার অনুবাদও করেন।
বিবেকানন্দের প্রথম চারটি গদ্যগ্রন্থ ‘উদ্বোধন’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। প্রথম গ্রন্থে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সভ্যতার তুলনামূলক আলোচনা আছে। ইতিহাসের আলোকে উভয় সভ্যতার স্বরূপ বিশ্লেষণ করে সনাতন ভারতের রূপটি উদঘাটিত হয়েছে। ‘পরিব্রাজক মূলত ভ্রমণ কাহিনীর লঘু চালে লেখা। ব্যক্তিগত চিন্তা ও মননের দ্বারা সমৃদ্ধ। ‘বর্তমান ভারতে’ যুগসন্ধির প্রেক্ষাপটে ভারতের সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক অবস্থার পরিচয়টি বিশ্লেষিত সেইসঙ্গে আছে জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে ভারতবাসীকে নব ভারত গঠনের পথনির্দেশ। ‘ভাববার কথা’ গ্রন্থে ধর্মী প্রসঙ্গ কৌতুকরসের দ্বারা ব্যাখ্যাত। আর ‘পত্রাবলীতে’ আছে শিষ্যকে বা সুহৃৎকে লেখা তাঁর অন্তরঙ্গ মনের পরিচয়।
স্বামী বিবেকানন্দের পূর্ববর্তী গদ্য লেখকদের থেকে স্বাতন্ত্র্যঃ
হৃদয়াবেগ মূলক ভক্তিতন্ময়তা থেকে যুক্তিনিষ্ঠ জ্ঞান সাধনার দিকে বাঙালী মনকে আকৃষ্ট করার প্রথম সাধুবাদ ভারতপথিক রামমোহনেরই প্রাপ্য। প্রাক বিদ্যাসাগরী ভাষা ছিল নীরস। ‘পণ্ডিতীবাংলা’ পরবর্তী যুগে বিদ্যাসাগরের লেখনীর স্পর্শেই সেই গদ্যের বুকে প্রাণ সঞ্চার হয় তার বিতর্কমূলক রচনাবলীর মধ্যে শোনা যায় স্বামীজীর ক্ষীণ পদধ্বনি। আবার ভাষাকে ঐরাবতের গজেন্দ্রগমন থেকে অনেকটা মুক্তি দিলেন কালীপ্রসন্ন সিংহ ও প্যারীচাদ মিত্র। ভাঙ্গাচোরা চলতি মুখের কথা সাহিত্যে পেল প্রবেশের অধিকার। ‘আলালী ও বিদ্যাসাগরী’ ভাষার মধ্যে সমন্ব্য সাধন করে সাধুভাষার ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্র করলেন এক নতুন পথ নির্দেশ। এরপর চলতি গদ্যের মধ্যে গতিবেগের সাইক্লোন আনায় যিনি জনগণমন অধিনায়ক রূপে বাঙালী হৃদয়ে হলেন চির প্রতিষ্ঠিত। তিনি স্বামী বিবেকানন্দ কোলকাতার মার্জিত কথ্যবুলির উপরেই চলতি গদ্যকে তিনি দাঁড় করালেন। ভাষাকে পোষা পাখির মতো খেলানোর সার্থকতায় বিবেকানন্দ–সাহিত্য বিকশিত। এই ভাষাটি কখনো তাঁর হাতে শাণিত তলোয়ার, কখনো কিছুটা তৎসম শব্দযোগে গম্ভীরনাদী তুর্থ। কোমলে কবোরে তা যেন পার্বতী পরমেশ্বরের মিলন।
সাহিত্যিক হিসাবে এই যুগন্ধর চরম আদর্শবাদী। শুধুমাত্র ‘হঠাৎ আলোর ঝলকানিতেই তাঁর প্রবন্ধের আদিদিগন্ত আলোকিত হননি, বাস্তববাদী জীবন জিজ্ঞাসা যেখানে মানুষের অন্নবস্ত্র ও বুদ্ধি হৃদয়ের সামঞ্জস্য বিধানে ব্যস্ত। এই মহামানব ধর্মের উন্মাতা সেখানে আত্মার আলোকে জীবনের পরম সত্যটিকে সাহিত্যের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করতে দৃঢ় সংকল্প। মানুষে মানুষে যে ভেদের অচলায়তন গড়ে উঠেছে তার এই নব ভারতের ঋত্বিককে ব্যথিত করত। তাঁর অন্তরতম আকাঙ্ক্ষা “নতুন ভারত বেরুক। বেরুক লাঙ্গল ধরে, চাষার কুটির ভেদ করে, জেলে, মুচি, মেথরের ঝুপড়ীর মধ্য হতে। বেরুক মুদির দোকান থেকে ভুনা ও মালা উনুনের পাশ থেকে। বেরুক কারখানা থেকে, হাট থেকে বাজার থেকে, বেরুক ঝোপ জঙ্গল পাহাড় পর্বত থেকে।’ বিবেকানন্দ-সাহিত্যে সেই অবহেলিত জাতি আর অবদমিত মানবাত্মার জীবনবেদ। এই অগ্নিবাণী বাংলা সাহিত্যের চিরন্তন সম্পদ।
স্বামী বিবেকানন্দের গদ্যরীতির দৃষ্টান্ত :
বিবেকানন্দের সংস্কৃত ও ফরাসী মিশ্রিত শব্দ ব্যবহারের উজ্জ্বল চলিত গদ্য‘লক্ষ্ণৌ শহরে মহরমের ভারি ধূম। বড় মসজিদ ইমামাবাড়ায় জাঁকজমক রোশনির ব্যবহার দেখে কে! বেসুমার লোকের সমাবেশ । এ দর্শকবৃন্দের ভিড়ের মধ্যে দূর গ্রাম হতে দুই ভদ্র রাজপুত তামাসা দেখতে হাজির। (প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য)
স্বামী বিবেকানন্দের চিত্রধর্ম গদ্যরীতি:
‘সে নীল নীল আকাশ, তার কোলে কোলে মেঘ’ তার কোলে সাদাটে মেঘে, সোনালী কিনারাদার, তার নীচে ঝোপ ঝোপ, তার নারিকেল খেজুরের মাথা বাতাসে যেন লক্ষ লক্ষ চামরের মত হেলচে।” (পরিব্রাজক)
স্বামী বিবেকানন্দের ব্যঙ্গধর্মী ভাষারীতি:
“ঐ যে একদল দেশে উঠছে, মেয়ে মানুষের মতো বেশভূষা, নরম নরম বুলি কাটেন, এঁকে বেঁকে চলেন, কারুর চোখের উপর চোখ রেখে কথা কইতে পারেন না। আর ভূমিষ্ঠ হয়ে অবাধ পিরীতের কবিতা লেখেন। আর বিরহের জ্বালায় হাঁসে হোঁসেন করেন।”
স্বামী বিবেকানন্দের সাধুভাষার গদ্যরীতিঃ
হে ভারত ভুলিও না–তোমার নারীজাতির আদর্শ ‘সীতা, সাবিত্রী, দময়ন্তী; ভুলিও না তোমার উপাস্য উমানাথ সর্বত্যাগী শংকর। বলমূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, ব্রাহ্মণ ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী আমার ভাই।”
সবশেষে বলতে হয়, চলিত ভাষাকে গভীর মননের উপযোগী করতে হলে সংস্কৃত থেকে উপযুক্ত পরসন্ধান করতেই হবে, পাশ্চাত্য ভাষাকেও ল্যাটিনের দ্বারস্থ হতে হয়েছে। সংস্কৃতের সাহায্যে বাংলা ভাষা হবে ওজস্বিনী এবং সংহত গভীর। কোন শব্দ কুহেলীর সৃষ্টি না করে জনসঙ্ঘের জাগতির জন্য উপনিষদের অগ্নিবর্ণ অক্ষরের সাহায্য নিয়েছিলেন বিবেকানন্দ। বৈষ্ণব ভক্তপদের তিনি রুদ্রবীণার ঝংকারে উচ্চারণ করেছেন : “দেশে দেশে গাঁয়ে গাঁয়ে যেখানেই দেখবি খোল করতালই বাজছে, ঢাক ঢোল কি দেশে তৈরী হয়না। কীর্তন শুনে শুনে দেশটা যে মেয়েদের দেশ হয়ে গেল।’ অর্থাৎ জাতির জীবনেও বাংলা সাহিত্য এইবার ও রৌদ্র রসের স্পষ্ট বক্তা সন্ন্যাসী বৈদিক ছন্দের মেঘমন্ত্রে প্রাণ সঞ্চার করতে চেয়েছিলেন। জ্ঞান, ভক্তি, ধর্ম, কর্ম, আত্মস্থ সমাধিও বিগলিত মানবপ্রেমের যুক্ত বেণীরূপে বিবেকানন্দ-সাহিত্য দোসরহীন।