বর্তমান যুগে বিশ্বায়নের প্রভাব বা ফলাফল পর্যালোচনা করো।

বিশ্বায়ণের প্রভাব বা ফলাফলসমূহ

বিশ্বায়ন (Globalisation) একটি আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া। জোশেফ স্টিগলিংস-এর মতে, বিশ্বায়ন বলতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ডের দেশ ও জনগণের মধ্যে এক নিবিড় সংযোগসাধনের প্রক্রিয়াকে বোঝায়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বায়নের প্রভাব বা ফলাফল পর্যালোচনায় উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলি হল-

[ 1] উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের মধ্যে বৈষম্য বৃদ্ধি: বিশ্বায়নের ফলে উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের মধ্যে বৈষম্য প্রকট হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক  অর্থভাণ্ডার, বিশ্বব্যাংক এবং বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা কর্তৃক গৃহীত বৈষম্যমূলক নীতির ফলে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি উন্নত দেশগুলির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এডওয়ার্ড এস হারমানের মতে বিশ্বে সবচেয়ে ধনী ও দরিদ্র দেশে বসবাসকারী মানুষের আয়ের ফারাক ১৯৬০ সালে ৩০:১ থেকে বেড়ে ১৯৯৫ সালে ৮২:১-এ দাঁড়িয়েছে।

[2] বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধাসম্পদ অধিকারের (TRIPS) প্রয়োগ: বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা বাণিজ্যিক বিশ্বায়নের নীতিকে কার্যকরী করার জন্য বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধাসম্পদ অধিকারের যে চুক্তি বলবৎ করেছে তার ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলি এই অধিকার অনুযায়ী পেটেন্ট, কপিরাইট, ট্রেডমার্ক, ব্যাবসায়িক গোপনীয়তার সুরক্ষা প্রভৃতি বিষয় কতটা নিজেদের এক্তিয়ারে সংরক্ষিত রাখতে পারবে তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। তা ছাড়া এসব ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতাতেও তারা টিকে থাকতে পারছে না।

[3] বহুজাতিক সংস্থার আধিপত্য বিস্তার: বিশ্বায়নের ফলে বাণিজ্য সম্পর্কিত বিনিয়োগ ব্যবস্থা (Trade Related Investment Measures orTRIMS) গৃহীত হওয়ায় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহুজাতিক সংস্থা বা কর্পোরেট বিশ্বের আধিপত্য বিস্তৃত হয়েছে। সারা বিশ্ব জুড়ে বৃহৎ বহুজাতিক সংস্থাগুলি উন্নয়নশীল দেশগুলির ক্ষুদ্র সংস্থাগুলিকে অধিগ্রহণ বা সংযুক্তির মাধ্যমে দখল করে নিয়ে তাদের ওপর আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হয়েছে। কোনো কোনো বহুজাতিক সংস্থার বার্ষিক আয় একটি রাষ্ট্রের জাতীয় আয়কেও ছাড়িয়ে গেছে। যেমন, মার্কিনি বহুজাতিক সংস্থা জেনারেল মোটরসের বার্ষিক আয় নরওয়ের জাতীয় আয়কে অতিক্রম করেছে। আবার মার্কিনি তেল সংস্থা এক্সনের বার্ষিক আয় ভেনেজুয়েলার জাতীয় আয়ের চেয়ে অনেক বেশি।

[4] নয়া ঔপনিবেশিক অর্থনীতির এবং উত্তর-দক্ষিণ সংঘাত: বিশ্বায়নের ফলে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা উন্নত ও ধনী দেশগুলির কুক্ষিগত হওয়ায় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নয়া ঔপনিবেশিক অর্থনীতি এবং ‘উত্তর-দক্ষিশ’ সংঘাতের উদ্ভব ঘটেছে। উন্নত দেশগুলি উন্নয়নশীল বিশ্বের বাণিজ্যিক সম্প্রসারণে সম্পূর্ণ নেতিবাচক অবস্থান গ্রহণ করেছে। উন্নত দেশগুলির কর্তৃত্বাধীন বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা যেভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলির ওপর শ্রমখরচ (Labour Cost) সংক্রান্ত বিধান, অভিন্ন শ্রমিক স্বার্থ সম্পর্কিত নীতিগ্রহণকৃষিক্ষেত্রে ভরতুকি কমানো প্রভৃতি বিষয়ে চাপ সৃষ্টি করে চলেছে, তার ফলে উত্তর (উন্নত) বনাম দক্ষিণ (উন্নয়নশীল) সংঘাত তীব্রতর হয়ে দেখা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ যোগেনস বুখ হানসেনের মতে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার নির্দেশিত উদার অর্থনৈতিক পথে চলতে গিয়ে ধনী বিশ্ব আরও ধনী হচ্ছে, অন্যদিকে দরিদ্র বিশ্ব দরিদ্রতর হচ্ছে।

[5] সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা বৃদ্ধি: আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার, বিশ্বব্যাংক এবং বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার নির্দেশে উন্নয়নশীল দেশগুলি যে কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস (Structural Adjustment) এ হাত দিয়েছে তার ফলে ব্যাপকভাবে কর্মী সংকোচন, ছাঁটাই, লে অফ, লক আউট, রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের বিলগ্নিকরণ, জাতীয় ব্যয়ের সংকোচন ইত্যাদি পন্থা অনুসৃত হচ্ছে। কাঠামোগত এই পুনর্বিন্যাসের ফলে বেকারত্ব, দারিদ্র্য প্রভৃতি বৃদ্ধি পেয়েছে। আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সংকট দেখা দিয়েছে।

[6] সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সংকট: বিশ্বায়নের ফলে সারা বিশ্বজুড়ে সাংস্কৃতিক সমতা তৈরির চেষ্টা চলেছে। ইনটারনেট-সহ অত্যাধুনিক গণমাধ্যমের সহায়তায় এক পণ্যমুগ্ধ ভোগবাদী সংস্কৃতির নিরন্তর প্রচারের ফলে আঞ্চলিক ও জাতীয় সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য কুক্স হতে বসেছে। বিশ্বায়ন বৈচিত্র্যপূর্ণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যসমূহকে এক ছাঁচে ঢেলে এক ধরনের সাংস্কৃতিক সমতা চাপিয়ে দিতে চায়। অনেকে একে মার্কিনি ম্যাকডোনাল্ড সংস্কৃতির আখ্যা দিয়েছেন। এর ফলে তৃতীয় বিশ্বের বহুমুখী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এক সংকটের সম্মুখীন হয়েছে।

[7] জাতি-রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের সংকট: বিশ্বায়নের প্রভাবে জাতি-রাষ্ট্রের (Nation State) সংকট সৃষ্টি হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব তার নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মধ্যে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ ও নাগরিকবৃন্দের ওপর চূড়ান্তভাবে প্রযোজ্য হয়। বিশ্বায়ন জাতি-রাষ্ট্রের এই ভূখণ্ডকেন্দ্রিক সর্বব্যাপী ক্ষমতাকে খর্ব করে রাষ্ট্রকে একটি ‘বাজারকেন্দ্রিক সংগঠনে পরিণত করেছে। এর ফলে সার্বভৌমত্বের ধারণার বদল ঘটেছে।

[৪] পরিবেশদূষণ: বিশ্বায়নের ফলে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। বহুজাতিক সংস্থাগুলি এই সমস্ত এলাকায় যেসব শিল্প গড়ে তুলছে, সেগুলির কারণে যথেচ্ছভাবে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। বস্তুত, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে পরিবেশের ব্যাপারে উন্নত বিশ্বের মতো কোনো কঠোর আইন এখানে না থাকায় বহুজাতিক সংস্থাগুলি খুব সহজেই এখানে পরিবেশদূষণকারী শিল্প গড়ে তুলতে পারছে। তা ছাড়া বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার অবাধ বাণিজ্যনীতির সুযোগে উন্নত দেশগুলির উৎপাদন কেন্দ্রের বর্জ্য পদার্থ উন্নয়নশীল দেশে পরিত্যক্ত হওয়ার ফলে সেখানকার পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।

উপসংহার: একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্বায়ন এক অবশ্যম্ভাবী আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া। সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় বিশ্বায়ন সমগ্র বিশ্বকে এক ‘ভুবন গ্রাম’-এ (Global Village) রূপান্তরিত করেছে। এর ফলে রাষ্ট্রগুলির পারস্পরিক সম্পর্ক আরও নিবিড়ভাবে গড়ে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষত, বহির্বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের মুক্ত বাণিজ্য নীতি (Free Trade Policy) উন্নয়নশীল দেশগুলির কাছে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করেছে। বিদেশি পুঁজি লগ্নি, বিদেশি বিনিয়োগ, তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ আদানপ্রদান, রফতানি বাণিজ্যের উদারীকরণ ইত্যাদি বিষয়কে কাজে লাগিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের কাছে বিশ্ববাণিজ্যকে আরও সমৃদ্ধ করার সুযোগ এনে দিয়েছে বিশ্বায়ন। অবশ্য এই পরিপ্রেক্ষিতে উন্নয়নশীল দেশগুলির নিজেদের স্বার্থরক্ষায় বিশ্বায়নকে কাজে লাগানোর ব্যাপারে আরও ঐক্যবদ্ধ তৎপরতার পরিচয় দেওয়া দরকার।

Leave a Comment