বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্য সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলােচনা করাে
বড় চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ রাধাকৃষ্ণের প্রণয়লীলা অবলম্বন করে লেখা একটি আখ্যানকাব্য। এর বিন্যাসে আছে নাটকীয়তা, অন্তরে গীতিকাব্যের ধর্ম। সমগ্র কাব্যটি তেরােটি খণ্ডে বিন্যস্ত। খণ্ডগুলি হল-
- জন্ম খণ্ড,
- তাম্বুল খণ্ড,
- দান খণ্ড,
- নৌকা খণ্ড,
- ভার খণ্ড,
- ছত্র খণ্ড,
- বৃন্দাবন খণ্ড,
- কালীয়দমন খণ্ড,
- যমুনা খণ্ড,
- হার খণ্ড,
- বাণ খণ্ড,
- বংশী খণ্ড এবং
- রাধাবিরহ।
শেষ খণ্ডটির নামে ‘খণ্ড’ শব্দের উল্লেখ না থাকায় অনেকে এটিকে প্রক্ষিপ্ত বলে মনে করেন। কৃয়ের জন্ম থেকে মথুরা প্রবাস পর্যন্ত কাহিনি বর্ণিত হয়েছে এই খণ্ডগুলিতে। মানুষের মঙ্গলসাধন ও কংসবধের জন্য বিয়ু ও লক্ষ্মীদেবীর যথাক্রমে কৃয় ও রাধারূপে মর্তে আবির্ভাব ঘটে। তাদের লীলা কাহিনিই শ্রীকৃষ্ণকীর্তন।
সংস্কৃত ভাষায় পণ্ডিত কবি বড়ু চণ্ডীদাস ভাগবত পুরাণ এবং জয়দেবের গীতগােবিন্দম্ কাব্য থেকে যেমন রসদ সংগ্রহ করেছেন, তেমনি লােকজীবন-নির্ভর কাহিনিরও সহায়তা গ্রহণ করেছেন।
রাধা, কৃষ্ণ ও বড়াই—এই তিনটি চরিত্রের উক্তি-প্রত্যুক্তির মধ্য দিয়ে কাহিনির যেমন অগ্রগতি ঘটেছে, তেমনি বিকশিত হয়ে উঠেছে। চরিত্রগুলিও। সেখানে কবির মর্ত-জীবনভাবনাই প্রাধান্য পেয়েছে।
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে পয়ার ও ত্রিপদী ছন্দের প্রয়ােগে এবং উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক প্রভৃতি অলংকার প্রয়ােগে কবি দক্ষতা দেখিয়েছেন। সামগ্রিকভাবে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য শুধুমাত্র আদি মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম নিদর্শন নয়, সাহিত্যমূল্যের দিক থেকেও এটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের কাব্যবৈশিষ্ট্য আলােচনা করাে
বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের কাব্য বৈশিষ্ট্য গুলি হল-
- তেরােটি খণ্ডে রচিত ‘শ্ৰীকৃষ্ণকীর্তন’ বাংলা সাহিত্যে রাধা কৃষ্ণকথার প্রথম লৌকিক আখ্যানকাব্য। জন্মখণ্ডে দেবতাদের প্রার্থনায় বিশ্বকে ভারমুক্ত করতে রাধাকৃষ্ণের আবির্ভাব দিয়ে এই কাব্যের শুরু আর কংসবধের জন্য কৃষ্ণের মথুরাগমনে রাধার আক্ষেপ যন্ত্রণায় আখ্যানকাব্যটির কাহিনি সমাপ্ত হয়েছে।
- গীতি নাট্য-বিবৃতির মিশেলে রচিত “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের শেষে রাধার হৃদয়ের আর্তিতে গীতিময়তা, বংশীখণ্ডে কেনা বাঁশি বাএ বড়ায়ি-তে গীতিরসের উচ্ছসিত প্রবাহ আবার রাধাকৃষ্ণ বড়ায়ির উক্তি-প্রত্যুক্তিতে নাটকীয় চরিত্র লক্ষণ প্রকাশ পায়।
- তুর্কি-আক্রমণের প্রভাবজাত লৌকিকতার আভাস রয়েছে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে। তাই বড়ু চণ্ডীদাসের কৃয় হয়ে ওঠে এক আভীর (গােয়ালা) যুবক, যে অনায়াসে বলতে পারে- “রাধাক না পাআঁ মাের বেআকুল মনে।” রাধাও ক্রমশ হয়ে ওঠে পরকীয়া প্রেমে অভ্যস্ত এক রমণী। আর বড়াই রাধা কৃয়ের পরকীয়া প্রেমে দূতিয়ালি করা এক গ্রাম্য কুটিল চরিত্র।
- আদিমধ্যযুগের সমাজচিত্রের। বিশ্বস্ত দলিল হল ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য। বালিকা রাধার সংসার করার মধ্যে বাল্যবিবাহের নজির আছে। বিভিন্ন পেশার মানুষের পরিচয় শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে যেমন আছে, তেমনি জনজীবনের অজস্র সংস্কারের নিদর্শনও এই কাব্যে লভ্য।
- আদিমধ্যযুগে সৃষ্ট নব্যবাংলা ভাষার বিশিষ্ট লক্ষণগুলাে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনেই পাওয়া যায়। যেমন সর্বনামে কর্তৃকারকে ‘রা’ বিভক্তি যােগ, ভবিষ্যতের কর্তৃবাচ্যে ইব অন্ত ক্রিয়ার ব্যবহার ইত্যাদি।
এইভাবে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ আদিমধ্যযুগের সাহিত্য নিদর্শন হিসেবে বিষয়, আঙ্গিক ও ভাষাগত অজস্র বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল হয়ে আছে।
‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যটির বিষয় ও আঙ্গিকগত বৈশিষ্ট্যের পরিচয় দাও
আদিমধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যের একমাত্র নিদর্শন ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’। কাব্যটির বিষয় ও আঙ্গিকগত মূল বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
- বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ রাধা কৃয়ের প্রণয়লীলাকে অবলম্বন করে লেখা আখ্যানকাব্য, যার বিন্যাসে আছে নাটকীয়তা, অন্তরে আছে গীতিময়তা।
- শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের ভাষা প্রথমযুগের বাংলা ভাষা হলেও চর্যাপদের ভাষার আড়ষ্টভাব অনেকখানিই অতিক্রম করতে পেরেছিল এই ভাষা।
- ভাগবত পুরাণ এবং গীতগােবিন্দম্ কাব্যের বহু শ্লোকের ভাবানুবাদ বড় চণ্ডীদাস ব্যবহার করেছেন তাঁর ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’।
- আদিমধ্যযুগে সৃষ্টি হওয়া নব্যবাংলা ভাষার বিশিষ্ট লক্ষণগুলাে (সর্বনামে কর্তৃকারকে ‘রা’ বিভক্তি যােগ, ভবিষ্যতের কর্তৃবাচ্যে ‘ইব’ অন্ত ক্রিয়ার ব্যবহার ইত্যাদি) এই গ্রন্থেই আমরা পাই।
- সংস্কৃত অলংকার শাস্ত্রের অনুসরণে বড় চণ্ডীদাস তাঁর কাব্যে উৎপ্রেক্ষা, উপমা, রূপক প্রভৃতি অলংকারের প্রয়ােগ ঘটিয়েছেন।
- ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যটি ছন্দ ব্যবহারেও প্রশংসার যােগ্য। সাত প্রকার পয়ার ও তিন প্রকার ত্রিপদীর ব্যবহার লক্ষ করা যায় ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’—
হইএ আয়ে গােপ জাতী। পতি ছাড়ী নাহি গতী
ঘৃতে দুধে সাজি-এ পসারে। (ত্রিপদী)
সুতরাং রচনাবৈশিষ্ট্যের দিক থেকে বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্য যথেষ্ট প্রশংসার দাবি রাখে।
বাংলা ভাষায় ‘রামায়ণ’-এর প্রথম অনুবাদকের জীবনকথা উল্লেখ করাে
বাংলা ভাষায় ‘রামায়ণ’-এর প্রথম অনুবাদক কবি কৃত্তিবাস ওঝা।
কৃত্তিবাসের জীবনকথা: কৃত্তিবাসের ‘শ্রীরাম পাঁচালি’ গ্রন্থের যে ‘আত্মবিবরণী অংশ পাওয়া যায়, তাতে কৃত্তিবাসের ব্যক্তি-পরিচয় সংক্রান্ত কিছু কিছু তথ্য লিপিবদ্ধ আছে। কবির পূর্বপুরুষ নরসিংহ ওঝা ছিলেন ত্রয়ােদশ শতকের রাজা দনুজমর্দন দেবের সভাসদ।
নরসিংহ পূর্ববঙ্গ ত্যাগ করে নদিয়া জেলার গঙ্গা-তীরবর্তী ফুলিয়া গ্রামে এসে বসবাস শুরু করেন। নরসিংহের পুত্র গর্ভেশ্বর এবং গর্ভেশ্বরের পুত্র ছিলেন মুরারি। মুরারির সাত পুত্রের একজনের নাম বনমালী, বনমালীর পুত্র কৃত্তিবাস। কৃত্তিবাস লিখেছেন, “মালিনী নামেতে মাতা পিতা বনমালী।” বনমালীর জ্যেষ্ঠ সন্তান কৃত্তিবাসের আরও পাঁচ ভাই এবং এক বৈমাত্রেয় বােন ছিল। তাদের বংশের পদবি মুখটি বা মুখােপাধ্যায় হলেও তারা ওঝা (উপাধ্যায়) পদবিতেই পরিচিত।
এই শ্লোকের সূত্রে অনেকে কৃত্তিবাসের আবির্ভাবকাল নির্ণয়ের চেষ্টা করেছেন। যােগেশচন্দ্র রায়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কৃত্তিবাসের জন্ম হয়েছিল ১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দে। বারাে বছর বয়সে কবি উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য উত্তরবঙ্গের দিকে রওনা হন এবং অধ্যয়ন শেষ করার পর তিনি গৌড়েশ্বরের সভায় উপস্থিত হন। এই রাজসভার হিন্দুরীতি থেকে মনে হয় যে, এই গৌড়েশ্বর হলেন পঞ্চদশ শতকের হিন্দুরাজা গণেশ।