প্রেমবৈচিত্র্য প্রেমাবিষ্ট হৃদয়ের একটি বিচিত্র ভাব। প্রেমিক নিকটে আছেন তথাপি প্রগাঢ় প্রেমব্যাকুলতায় প্রেমিকার মনে হয়, এই বুঝি প্রেমিকাকে তিনি হারিয়ে ফেলেছেন। এর ফলে হৃদয়ে যে বিরহবোধ জনিত বেদনার সৃষ্টি হয়, তাকে বলা হয় প্রেমবৈচিত্র্য। উজ্জ্বল নীলমণি’ গ্রন্থে প্ৰেমবৈচিত্র্যের সংজ্ঞা সম্পর্কে বলা হয়েছে-
“প্রিয়স্য সন্নিকর্ষে হপি প্রেমোৎকর্ষ স্বভাবতঃ
যা বিশ্লেষ ধিয়াতিঃ স্যাৎ প্রেমবৈচিত্র্য মিয্যতে।।’
বৈষ্ণব পদকতাগণ প্রেমবৈচিত্র্য অবলম্বন ক’রে অনেক উৎকৃষ্ট পদ রচনা করেছেন। রাধা কৃষ্ণকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালবাসেন। কৃষ্ণের প্রতি তাঁর অনুযোগের শেষ নেই—
বধু কি আর বলিব তোরে,
অলপ বয়সে পিরীতি করিয়া
রহিতে না দিলি ঘরে।
প্রেমের জ্বালা বড় কঠিন। এই জ্বালায় দগ্ধ হয়ে রাধা বলেন—
কামনা করিয়া সাগরে মরিব
সাধিব মনের সাধা
মরিয়া হইব শ্রীনন্দের নন্দন
তোমারে করিব রাধা।
আক্ষেপানুরাগ প্রেমবৈচিত্র্যেরই একটি অবস্থাভেদ। প্রেমিকের প্রতি তীব্র অনুরাগবশতঃ আক্ষেপ বা খেদোক্তি—এই হচ্ছে আক্ষেপানুরাগ। কৃষ্ণকে রাধা প্রাণাধিক ভালবাসেন। তার উদ্দেশ্যে তিনি দেহ মন প্রাণ দিয়ে উৎসর্গ করেছেন— তথাপি রাধার মনে অনেক আক্ষেপ ও অনুযোগ। শুধু কৃষ্ণের প্রতি নয়, কৃষ্ণের মুরলীর প্রতি, কালো রঙের প্রতি, সখীগণের প্রতি, গুরুজনের প্রতি, বিধাতার প্রতি, কন্দর্পের প্রতি এমন কি নিজের প্রতিও তাঁর আক্ষেপ।
এই শ্রেণীর পদে চণ্ডীদাসের শ্রেষ্ঠত্ব অনস্বীকার্য। রাধা কৃষ্ণঅস্ত প্রাণ। কৃষ্ণের বাইরে তার জীবনের অস্তিত্ব নেই। কৃষ্ণও যে রাধাঅন্ত প্রাণ তা তিনি ভাল করেই জানেন। এবং জেনেও আক্ষেপ করেন—
“কি মোহিনী জান বঁধু কি মোহিনী জান।
অবলার প্রাণ নিতে নাহি তোমা হেন৷৷
ঘর কৈনু বাহির, বাহির কৈনু ঘর।
পর কৈনু আপন, আপন কৈনু পর।।
কোন বিধি সিরজিল সোতের শেওঁলি।
এমন ব্যথিত নাই ডাকি বন্ধু বলি।।”
কৃষ্ণপ্রেমের সুতীব্র যন্ত্রণা ফুটে উঠেছে রাধার আক্ষেপোক্তির মধ্যে। কৃষ্ণকে তিনি সর্ব সুখের আশ্রয় বলে মনে করেছিলেন। কিন্তু কৃষ্ণপ্রেমের গভীর দহনজ্বালা তাকে যেন বেদনার সমুদ্রে নিক্ষেপ করেছে—
সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু
অনলে পুড়িয়া গেল।
অমিয়া সাগরে সিনান করিতে
সকলেই গরল ভেল৷৷
সেই প্রেমের দহন জ্বালা যেন রাধার জীবনের অলঙ্ঘ্য নিয়তি—
সখি, কি মোর করমে লেখি।
শীতল বলিয়া ও চাঁদ সেবিনু
ভানুর কিরণ দেখি।।
রাধা ভেবেছিলেন যে কৃষ্ণপ্রেমের মধ্যে বোধহয় সর্ব প্রাপ্তির আনন্দ। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখলেন যে তা সুতীব্র বেদনা মাত্র। তাতে পিপাসার শাস্তি হয় না বরং পিপাসা বর্ধিত হয়।
পিয়াস লাগিয়া জলদ সেবিনু
বজর পড়িয়া গেল।
জ্ঞানদাস কহে কানুর পিরীতি
মরণ অধিক শেল।
প্রেমবৈচিত্র্য হচ্ছে প্রেমের বিচিত্রতা; এর মধ্যে একটি বিরহের সুর আছে। প্রিয়তমের দর্শন না পেলে ক্ষণমাত্রকে যুগ বলে মনে হয়। আবার মিলন হলে সন্দেহ হয়—পেয়েছি তো? অভাগীর অদৃষ্টে এ সুখ স্থায়ী হবে তো? হয়ত এখনই হারাতে হবে। মিলনের দীর্ঘ সময়কে পল বলে মনে হয়। বোধ হয় এই তো এখনই ফুরিয়ে গেল। সংসারে কেউ পরের ভাল দেখতে পারে না। বিধাতাও বিরূপ। অন্য সবকিছু ত্যাগ ক’রে যাকে আপনার বলে রাধা ভেবেছিলেন তাকেই পর বলে মনে হচ্ছে। আর তাই রাধিকার মনে আক্ষেপ জাগছে। বাঁশীর ধ্বনি শুনে নিজেকে হারিয়ে সংসারের সকল কিছু হারালেন। অথচ সেই রসিক চূড়ামণির আদি-অন্ত পাওয়া গেল না। প্রেমের প্রগাঢ়তা তার মনে নানা আশঙ্কার সৃষ্টি করে। প্রেমের স্বভাবই এই।
চণ্ডীদাস আক্ষেপানুরাগ ও প্রেমবৈচিত্তের পদে অসাধারণ কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। এখানে কবির তথা রাধার ভাবতন্ময়তা পূর্বরাগ অপেক্ষাও গভীর। চণ্ডীদাসের রাধিকার মধ্যে অহং সম্পূর্ণরূপে বিসর্জিত। তাই এখানে রাধার মধ্যে কেবল আক্ষেপ, অনুযোগ নেই,—অভিযোগ নেই,—তিনি যে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সমর্পণ করে দিয়েছেন। তিনি শুধু অধীর প্রতীক্ষায় মগ্ন। কিন্তু তারপর তিনি যখন দেখেন ‘আমার বধুয়া আন বাড়ি যায় আমারি আঙ্গিনা দিয়া’ তখন বলেন “আমার পরাণ যেমতি করিছে তেমতি হউক সে।” কখনও বলেন—
“সে হেন বঁধুরে মোর যে জন ভাঙায়।
হাম নারী অবলার বধ লাগে তায়।।”
কৃষ্ণপ্রেমের জন্য সকল অসাধ্য সাধন রাধা করেছেন তবুও তিনি কৃষ্ণপ্রেমের রীতি প্রকৃতি বুঝতে পারেন নি—
“বুঝিতে নারিনু বন্ধু তোমার পিরীতি।’
কখনো রাধিকা নিজেকে এত অসহায় মনে করেন যে এই সংসারে তার আর কোনও বন্ধু নেই—এই দুঃসময়েও যদি প্রেমিক না আসে তবে আর কখন তিনি আসবেন!—
বঁধু যদি তুমি মোরে নিদারুণ হও।
মরিব তোমার আগে দাঁড়াইয়া রও।।
মৃত্যু বরণ করতে তিনি দ্বিধা করবেন না যদি কৃষ্ণ সম্মুখে দন্ডায়মান থাকেন। ব্যক্তিসত্তার এমন বিলোপ চণ্ডীদাসের আক্ষেপানুরাগের পদ ছাড়া অন্যত্র কোথাও দেখা যায় না।
বৈষ্ণব পদসাহিত্যে চণ্ডীদাস ও জ্ঞানদাস প্রেমবৈচিত্র্য ও আক্ষেপানুরাগের পদে শ্রেষ্ঠ। এদের দুজনের মধ্যে আবার চণ্ডীদাসের ভাবতন্ময়তা সর্বাধিক। চণ্ডীদাসের রাধার ভাবব্যাকুলতা এবং প্রেমের গাঢ়তা প্রকৃতপক্ষে সাধনার উচ্চতর সোপান। রাধার অবস্থান সাধনার যে স্তরে সেই স্তরে কোনও গৌড়ীয় বৈষ্ণবের পৌঁছবার কথা ভাবাই বিড়ম্বনা। তারা কেবল যোগীদের রাগানুরাগ ভক্তির সাধনা করতে পারেন মাত্র। মধুর তথা উজ্জ্বল বা শৃঙ্গার রসের সাধনার উচ্চতম সোপানে রাধার অধিষ্ঠান। রাধা আসলে কৃষ্ণেরই হ্লাদিনী শক্তি। শক্তিমানের সঙ্গে শক্তির যে লীলা তারই লৌকিক পরম্পরা নির্দেশ করেছেন বৈষ্ণব দার্শনিক ও কবিগণ। চরিতামৃতকার কবিরাজ গোস্বামীর ভাষায়—
“রাধা পূর্ণ শক্তি কৃষ্ণ পূর্ণ শক্তিমান।
দুই বস্তু ভেদ নাহি শাস্ত্র পরমাণ।”
চৈতন্যপরবর্তীকালে এই দর্শন প্রাধান্য লাভ করলেও চৈতন্যপূর্ব গে রাধাকৃষ্ণের মধুরলীলাকে অবলম্বন করে যে সকল পদ রচিত হয়েছিল তাতে পাথিব মানবমানবীর অন্তরের আকুলতা গভীর রসব্যঞ্জনা লাভ করেছে। এই ভাব বিশ্বের শ্রেষ্ঠ প্রেমকাব্যের বিষয়ীভূত হতে পারে। পরবর্তীকালে গৌড়ীয় বৈষ্ণবদর্শনের ছায়ায় রচিত বি ভন্ন রসপর্যায়ের পদে দার্শনিক প্রভাব পড়েছে। সুতরাং চণ্ডীদাসের পদে যে সহজ ভাবতন্ময়তা ও সুনিবিড় আর্তি দেখা যায় পরবর্তীযুগের কবিদের পদে তা ততখানি দেখা যায় না।