পরমাণু অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার কারণ
নিরস্তীয়করণ বা পরমাণু অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হলেও এ বিষয়ে কাঙ্ক্ষিত সাফল্যে পৌঁছানো আজও সম্ভব হয়নি। বহু চেষ্টা বা উদ্যোগ সত্ত্বেও আজও পর্যন্ত প্রতিযোগিতা বন্ধ করা যায়নি। মুখেতে নিরস্তীয়করণ সংক্রান্ত আলোচনায় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। এই ব্যর্থতার প্রধান কারণ গুলি হল –
১. ঠান্ডা লড়াই
কোন কোন দেশ মুখে নিরক্ষীয় করণ কথা বললেও বাস্তব ক্ষেত্রে যে ভয়ানক আগ্রাসন চালায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরবর্তীকালে আমেরিকা ও রাশিয়া উভয় শক্তি নিরক্ষীয়করণের কথা বললেও এ বিষয়ে তাদের আন্তরিকতা ছিল না। কেননা নিজেদের মধ্যে ঠান্ডা লড়াইয়ের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের পক্ষে অস্ত্র হ্রাস করা সম্ভব ছিল না।
২. যুদ্ধই শান্তির পথ
অনেক রাষ্ট্র নেতাই মনে করেন যে যুদ্ধই শান্তির প্রতিষ্ঠান একমাত্র উপায়। বিভিন্ন রাষ্ট্রে পররাষ্ট্রনীতির দায়িত্বেও ছিলেন সামরিক বিভাগের লোকজন। তারা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হন যে নিরস্তীয়করণের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বৃদ্ধি পেতে পারে। এইজন্য তারা নিজে নিজে দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে অস্ত্র তৈরীর কাজে বিপুল অর্থ ব্যয় করে।
৩. পারস্পরিক বিশ্বাসের অভাব
নিরস্তীয়করণ কর্মসূচি কার্যকর করার জন্য বৃহৎ শক্তিগুলির মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস ও ভরসার বিশেষ প্রয়োজন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরবর্তীকালে তাদের মধ্যে সেই বিশ্বাসে যথেষ্ট অভাব ছিল। রাশিয়ায় ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে গোপনে আণবিক বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটলে আমেরিকার বিশ্বাস ভঙ্গ হয়। আবার ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে মে মাসে আমেরিকা তার U -2 পর্যবেক্ষণ বিমান থেকে রাশিয়ার ওপর গুপ্তচরবৃত্তি চালালে রাশিয়ার অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়। এই ধরনের অবিশ্বাসের ঘটনা নিরস্থীয়করণের ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি হয়।
৪. অস্ত্রের ধরন নিয়ে সমস্যা
কোন দেশের কোন অস্ত্র আক্রমণাত্মক এবং কোন অস্ত্র রক্ষণাত্মক তা নিয়ে বিভিন্ন দেশের মধ্যে মতবিরোধ থাকে। এক দেশে যে অস্ত্র কে আক্রমণাত্মক বলে বিবেচনা করে অন্য দেশ তাকে রক্ষাণাত্মক বলে মনে করতে পারে। এ বিতরকের ফলে কোন মীমাংসায় পৌঁছানো সম্ভব হয়নি এবং নিরস্তীয়করণের বাস্তবায়ন ও অধরা থেকে যায়।
৫. গুণগত নিরস্ত্রীকরণের সমস্যা
নিরস্ত্রকরণ বলতে সাধারণ অস্ত্রের পরিমাণ হ্রাস বাস্তব বিলুপ্তি বোঝানো হয়। কিন্তু বিভিন্ন দেশের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে পরিমাণ কত নিরস্তীয়করন সম্ভব হলেও নিরস্ত্রকরণ গুণগত সম্ভব নয়। এ কারণ হিসেবে ডক্টর কিসিঞ্জার বলেছেন যে প্রকৃত হস্ত প্রতিযোগিতা চললে গবেষণাগারে। তাই কোন দেশে সৈন্য সংখ্যা যতই হ্রাস করা হোক না কেন এর দ্বারা প্রকৃত নিরস্তীয়করণ সম্ভব নয়।
৬. চুক্তি লঙ্ঘন
নিরস্তীয়করণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করার পরও বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সময় চুক্তি লঙ্ঘন করার ফলে এ বিষয়ে যথেষ্ট সমস্যা সৃষ্টি হয়। অনেক ক্ষেত্রেই চুক্তিকে বড় আঙুল দেখিয়ে তারা গোপনে অস্ত্র উৎপাদন ও মজুতের কাজ চালিয়ে যায়।
পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতার ফলাফল
গৃহশক্তি গুলির পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতা মানব সভ্যতা কে নানা সমস্যার জর্জরিত করে চলেছে। এই প্রতিযোগিতার ফলাফল গুলি খুবই মারাত্মক ও ক্ষতিকারক।
১. সভ্যতার বিলুপ্তের আশঙ্কা
পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতা পৃথিবীর মানব সভ্যতার অস্তিত্বকে প্রশ্ন চিহ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। বৃহসন্তিত রাষ্ট্রগুলি ছাড়াও বর্তমানে মাঝারি শক্তি সম্পন্ন বহু দেশের হাতে বিপুল পরিমাণ পরমাণবিক অস্ত্র স্বাস্থ্য রয়েছে যা সমগ্র পৃথিবী ধ্বংস করেও শেষ হবে না।
২. দূষণ
পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতার পৃথিবীর পরিবেশ দূষণের মাত্রা কে বহুগুণ বৃদ্ধি করেছে। জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে যেখানেই পরমাণু অস্ত্রের পরীক্ষা চালানো হোক না কেন পরমাণুর বর্জ্য পদার্থ প্রকৃতিকে মিশে গিয়ে সীমাহীন দূষণ ছাড়াচ্ছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে সম্প্রতি জাপানের পরমাণু কেন্দ্র সুনামির দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হলে পরমাণু বর্জ্য প্রকৃতিতে মিশে জমির ধান, নদীর মাছ সবকিছুতেই প্রবেশ করেছে। মানুষ তার পরোক্ষ প্রভাবে ক্যান্সার সহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু পথযাত্রী হচ্ছে বা হবে।
৩. উত্তেজনাকর পরিস্থিতি
পরস্পর বিরোধী শক্তি বিরুদ্ধে অস্ত্রশস্ত্রের পরিমাণ গত এবং গুণগত প্রাধান্য অর্জনের চেষ্টা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। তাছাড়া পর বানু অস্ত্র উৎপাদনকারী দেশগুলি তাদের অস্ত্রশস্ত্র অন্য দেশে বিক্রি করে সেসব দেশের যদ্ধাকাঙ্ক্ষা বাড়িয়ে দিচ্ছে।
৪. অর্থনৈতিক ক্ষতি
অস্ত্র প্রতিযোগিতা অংশগ্রহণকারী দেশগুলি তাদের পারমাণবিক কর্মসূচির রূপায়ণ করতে গিয়ে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে সেই সব দেশের বিরাট অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে এবং প্রকৃত উন্নয়ন কর্মসূচি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
৫. তৃতীয় বিশ্বের দুর্দশা
রিয়া শক্তি গুলি পরমাণু অস্ত্র তৈরিতে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছে সেই ব্যয় আদায় করার জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভিন্ন দরিদ্র দেশে নানাভাবে শোষণ চালাচ্ছে। ফলে এসব দেশের মানুষ দিন দিন দরিদ্র থেকে দরিদ্রতার হচ্ছে। এসব দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান নিম্নমুখী হতে বাধ্য হচ্ছে।
৬. শক্তির অপব্যবহার
পরমাণু শক্তির মাত্রা খুবই ব্যাপক। এই শক্তিকে মানব কল্যাণে বহু কাজে ব্যবহার করা সম্ভব। বিদ্যুৎ উৎপাদন, চিকিৎসা বি প্রভৃতি বিষয়ে পরমাণু শক্তি গুরুত্ব সীমাহীন। কিন্তু পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতায় নেমে বহু দেশ পরমাণু শক্তির শুভ দিকটিকে কাজে না লাগিয়ে এই শক্তির অপব্যবহার করেছে।।