ভূমিকা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকারের তীব্র অর্থনৈতিক শোষণ, খাদ্যাভাব প্রভীদের ফলে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে অবিভক্ত বাংলায় এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়ে। সেপ্টেম্বর (ভাদ্র-আশ্বিন) মাসে দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করে। প্রায় এক বছর ধরে সারা বাংলা জুড়ে এই দুর্ভিক্ষের দাপট চলে। খাদ্যাভাব, অপুষ্টি, রোগব্যাধি প্রভৃতির ফলে প্রচুর মানুষের মৃত্যু হয়। ১৩৫০ বঙ্গাব্দে সংঘটিত হয়েছিল বলে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে এই দুর্ভিক্ষ বা মন্বন্তর সাধারণভাবে পঞ্চাশের মন্বন্তর নামে পরিচিত।
পঞ্চাশের মন্বন্তরের ভয়াবহতা
সারা বাংলা জুড়ে পঞ্চাশের মন্বন্তরের গভীর প্রভাব পড়ে। মৃত্যুর মিছিল, অনাহার, আর্ধার, পারিবারিক জীবনে ভাঙ্গন প্রভৃতির ফলে বাংলায় ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। বাংলার এই মন্বন্তরের ভয়াবহতার চিত্র নিচে তুলে ধরা হলো-
১. মৃত্যুর মিছিল
মন্বন্তরের ফলে বাংলায় প্রচুর মানুষ খাদ্যের অভাবে মারা যায়। মন্বন্তর প্রায় এক বছর ধরে সারা বাংলায় দাঁত দিয়ে বেরিয়ে বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করে। খাদেম অভাবে অখাদ্য কু খাদ্য খেয়ে মানুষ শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। অনুমান করা যায় যে, এই দুর্ভিক্ষে বাংলার অন্তত ৪০ লক্ষ থেকে ৭০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পরিমাণ এতই বেড়ে যায় যত্রতত্র মৃতদেহ গুলি পড়ে থাকতে দেখা যায়। সেই মৃত্যুর মিছিলে বেশ কিছু ছবি দেখতে পাওয়া যায় সমকালীন সংবাদপত্রের পাতায়। নিত শিশু কোলে নিয়ে মায়ের কান্না, মহানগরের রাজপথ ও গলিপথের ছড়িয়ে থাকা মৃতদেহ ডিঙিয়ে নাগরিক জীবনের এগিয়ে চলা প্রভৃতির সে সময়কার সাধারণ দৃশ্য হয়ে উঠেছিল।
২. করুণ চিত্র
খাদ্যের অভাবে বাংলার সর্বত্র করুন আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়ে। অসংখ্য মানুষের হাহাকার : “ফ্যান দাও মা ফ্যান দাও।” সে সময় একটি ছবিতে দেখা যায় যে, একটি লরি থেকে রাস্তায় গুড় পড়েছে, আর সে গুড় তুলে চেটেপুটে খাচ্ছে শিশুর দল। অনাহারি মায়ের কঙ্কাল সার দেহের ওপর তার দুধে শিশুটি কখন মারা গেছে, তা মায়ের দেখা শক্তিও নেই। একটু পরে মায়ের ও মৃত্যু হয়। মৃত মানুষের মাংস খেয়ে মাংসাশী শেয়াল, শকুনেরও অরুচি দেখা দেয়।
৩. মধুশ্রী মুখার্জির বিবরণ
কবে শিক্ষা মধুশ্রী মুখার্জি তার ‘Churchill’s Secret War’ -নামক বইটিতে পঞ্চাশের মন্বন্তরের মর্মান্তিক কাহিনীর ভয়াবহতার বিভিন্ন টুকরো চিত্র তুলে ধরেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে –
(১) ফরিদপুরের এক বৃদ্ধ জানিয়েছেন তাদের জেলপটির ৫০ টি পরিবারের মধ্যে সবগুলিই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
(২) খিদের জ্বালায় পাগল হয়ে এক দরিদ্র কৃষক তার বাবা, মা, স্ত্রী ও সন্তানদের হত্যা করে নিজেও আত্মহত্যা করেছে।
(৩) এক ক্ষুদার্থ অসহায় পিতা তার স্কুলের সন্তানকে বিক্রি করার জন্য কোন ক্রেতা না পেয়ে শিশুটিকে একটি কুঁড়ে ছুড়ে ফেলে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছে।
(৪) চট্টগ্রামের এক ব্রিটিশ সেনা জানিয়েছেন একবার তাদের সেনা ছাউনির গার্ড বিমর্ষ হয়ে দেখেছেন যে, একটি শিয়াল কখনো বেঁচে থাকা একটি মেয়ের হাত ছিড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে।
(৫) কলকাতার ফুটপাতে মৃত্যুর ঘটনাগুলি গণমাধ্যমে কিছুটা প্রচার পেলেও গ্রাম বাংলার মৃত্যুগুলি ঘটেছে নিরবে, নিঃশব্দে। শিয়াল কুকুর মৃতদেহ গুলি ছিড়ে ছিড়ে খেয়েছে।
পঞ্চাশের মন্বন্তরের ব্রিটিশ সরকারের ভূমিকা
সরকারি উদাসীনতার ফলে বাংলার পঞ্চাশের মন্বন্তর অত্যন্ত ভয়াবহ হয়ে ওঠে। এ ভয়াবহ পরিস্থিতির প্রকৃত মোকাবিলায় সরকারের সদিচ্ছার যথেষ্ট অভাব ছিল, যেমন –
১. সরকারি মনোভাব
সরকার বাংলার খাদ্য সংকটে তীব্রতা ও সম্ভাব্য ভয়ানক পরিস্থিতি উপলব্ধি করার কোন চেষ্টা করেনি। বাংলার নেতা ফজলুল হক ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে সরকারকে শর্ত করে বলেছেন যে, “বাংলায় চালের দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে।” বিভিন্ন ব্যবসায়ীরা ও আগে থেকে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কার কথা সরকারকে জানিয়েছিল। কিন্তু সরকার তাতে কর্ণপাত করেনি। সরকার মনে করত যে, প্রকৃতপক্ষে বাংলায় খাদ্যের কোনো সংকট নেই। দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধে সরকার খাদ্যের মজুদদারি বন্ধ করারও বিশেষ চেষ্টা করেনি। সারা বাংলায় দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়লে সরকার দুর্গতদের কাছে খাদ্য ও ত্রাণ প্রেরণের ও বিশেষ উদ্যোগ নেয়নি।
২. নজরদারি তত্ত্বের অসাড়তা
সরকার মনে করত যে, অন্য কোন কারণে নয়, একমাত্র খাদ্যের মজুদদারের ফলে বাংলায় খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে। কিন্তু সরকার যতটা ব্যাপক মজুদ দায়ী কল্পনা করতো পুলিশি তদন্তে ততটা ব্যাপকতা প্রমাণ মেলেনি। কিছু মানুষ যেটুকু খাদ্য মজুদ করেছিল তা দুর্ভিক্ষের সময় ফুরিয়ে যায়। দুর্ভিক্ষ যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে তখনও বড়লাট লর্ড ওয়াভেল বাংলার দুর্ভিক্ষের কারণ হিসেবে এই মজুদদারির তত্ত্বকে আঁকড়ে ছিলেন। সচেতন মানুষ আগে থেকে এটুকু খাদ্য শস্য সঞ্চয় না রাখলে দুর্ভিক্ষে অনাহারে মৃত্যুর সংখ্যা আরো বাড়তো। তাছাড়া দুর্ভিক্ষের অবসানের পর মজুদ করা বিপুল পরিমাণ উদ্বৃত্ত খাদ্য বাইরে আসার প্রমাণ সরকার পানি।
৩. ধনীদের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি
নিজেদের দায়িত্বের কথা ভুলে গিয়ে সরকার গুরুত্বহীন বিষয়কে অজুহাত হিসেবে উল্লেখ করে দুর্ভিক্ষের কারণ ব্যাখ্যা চেষ্টা করে। সরকার মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করে যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কালে মুদ্রাস্ফীতির ফলে বাংলার এক থেকে দুই শতাংশ মানুষের হাতে প্রচুর অর্থ জমা হয়েছিল। এই অর্থে তারা প্রচুর খাদ্য কিনে নিলে বাংলার সংকট শুরু হয়।
উপসংহার
পঞ্চাশের মন্বন্তরের বাংলার অন্তত ১/৩ অংশ মানুষকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করেছিল। তবে এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাংলার অন্তত শতাংশ হতদরিদ্র মানুষ। বিদেশ থেকে যেটুকু সহায়তা এসেছিল তা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় এক্কেবারে তুচ্ছ ও নগণ্য। তাছাড়া সেই সহায়তা বাংলার দুর্ভিক্ষ পীড়িত অঞ্চলে এত দেরিতে পৌঁছয় যে, ইতিমধ্যে বহু মানুষ মৃত্যু মুখে পতিত হয়।