নেহেরুর পঞ্চশীল নীতি
ভূমিকা
ভারতের পররাষ্ট্রনীতির এক প্রধান অঙ্গ ছিল শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। এই নীতি মেনে ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন-লাই দ্বিতীয়বার ভারতে এলে ভারত ও চীনের মধ্যে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে যে পাঁচটি নীতি স্থির হয় তা পঞ্চশীল নীতির নামে পরিচিত।
« পঞ্চশীল নীতি সমূহ
প্রধানমন্ত্রী নেহেরু বিশ্ব শান্তি রক্ষার্থে সম্রাট অশোকের আদর্শ ঐতিহ্য অনুচ্ছেদের যে পাঁচটি নীতি ঘোষণা করেছিল সেগুলি পঞ্চশীল নামে পরিচিত। এই নীতিগুলি ছিল –
(১) দুটি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় খন্ডতা ও সর্বভৌমত্বের প্রতি পারস্পরিক মর্যাদা জ্ঞাপন।
(২) একে অপরকে আক্রমণ না করা।
(৩) একে অপরের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করা।
(৪) পরস্পরকে সম মর্যাদা ও পারস্পরিক সহযোগিতা প্রদান।
(৫) গণতন্ত্র সাম্যবাদ নির্বিশেষে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান।
« পটভূমি
চীন গণপ্রজাতন্ত্র আত্মপ্রকাশ করার পর থেকে ভারত ও চীনের মধ্যে এক সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ গড়ে উঠেছিল। দালাই লামা এবং পাঞ্চেন লামার সাথে ভারতের চুক্তি অনুসারে ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে চীন তিব্বতের উপর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে ভারত চীনের মধ্যে সম্পর্ক সামাজিক তো হয়ে ওঠে। চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন-লাই ভারত সফরে ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে এলে ভারত চীনের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। যার পরিণতি পঞ্চশীল নীতি।
উপসংহার
পঞ্চসার নীতিকে পর্যালোচনা করে আচার্য জে.বি. কৃপালিন বলেছিলেন-এই নীতি হলো পাপগ্রস্ত। তবুও সমালোচনার ঊর্ধ্বে উঠে বলা যায় ভারত চীন সম্পর্কে উন্নতির লক্ষ্যে স্বাক্ষরিত এই নীতিগুলি প্রকৃত অর্থে দ্বিতীয় বিশ্বের জোট নিরপেক্ষ রাজনীতিকে মজবুত করেছিল। পঞ্চশীল নীতির অর্থ ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে জহরলাল নেহেরু বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। পঞ্চশীল ধারণার অর্থ হলো দৃষ্টিভঙ্গির বিভিন্ন হতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেগুলির উদ্দেশ্যে হবে একই।
বান্দুং সম্মেলন
১. সম্মেলনের উদ্দেশ্য
বান্দুং সম্মেলন ছিল সোভিয়েত মার্কিন ঠান্ডা লড়াই এর প্রভাব মুক্ত দেশগুলি স্বাধীন সত্তা ঘোষণার প্রথম যৌথ প্রয়াস। তাই বলা হয় বাগধুম সম্মেলন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন সূচনা হয়। উল্লেখ্য যে পশ্চিম জোট ভুক্ত ছয়টি দেশ পাকিস্তান, ইরাক, ইরান, তুরস্ক, ফিলিপিশন ও থাইল্যান্ড এই সম্মেলনে যোগদান করে।
২. এই সম্মেলনের মূল উদ্যোক্তা ছিল ইন্দোনেশিয়া, বার্মা, পাকিস্তান, সিলন, ভারত। এই সম্মেলনে কার্যনির্বাহক ছিলেন রাসেল আব্দুলগানি। এই সম্মেলনের উদ্যোক্তা ও মধ্যমণি ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু এবং ইন্দোনেশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আলি শস্ত্রও মিদযোযো।
৩. দশশীল নীতি
বান্দুং সম্মেলনে জহরলাল নেহরু পঞ্চশীল নীতির দশ শীল নীতিতে পরিণত হয়। মনে করা হয় যেখানে গৃহীত এই দশটি নীতি বিশ্বের জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিল। ওই দশটি নীতি হলো –
(১) ভারতীয় অখন্ডতা ও সর্বভৌমত্বের প্রতি পারস্পরিক মর্যাদা জ্ঞাপন।
(২) কোন দেশের ভূখণ্ডগত অখন্ডতা বা রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে আগ্রাসন মূলক ক্রিয়া-কলাপ বা আগ্রাসনের ভীতি প্রদর্শন বা বল প্রয়োগ না করা।
(৩) কোন দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করা।
(৪) সমমর্যাদা ও পারস্পরিক সহযোগিতা প্রদান করা।
(৫) গণতন্ত্র ও সাম্যবাদ নির্বিশেষে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান- আপস, আলাপ-আলোচনা বা মধ্যস্থতার মাধ্যমে সমস্ত বিরোধের মীমাংসা করা।
(৬) মানবাধিকার ও জাতিপুঞ্জের সনদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শন।
(৭) সমস্ত বর্ণ ও জাতির সমান অধিকারের স্বীকৃতি।
(৮) সমস্ত জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রতি মর্যাদা প্রদর্শন।
(৯) কোন বৃহৎ শক্তির সাময়িক স্বার্থ রক্ষা করা থেকে বিরত হওয়া।
(১০) ন্যায় নীতি ও আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন।
৪. বান্দুং সম্মেলনের সাফল্য
বান্দুং সম্মেলনের সাফল্য প্রসঙ্গে বলা হয় –
(১) এই সম্মেলনে যোগদানকারী ২৯ টি দেশের পরস্পরের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পায়।
(২) এই সম্মেলনে আফ্রো-এসইও দেশগুলি নিজেদের মতো একে অপরকে জানানোর বোঝানোর সুযোগ পায়।
(৩) এই সম্মেলনের জওহরলালের গৌরব জনক ভূমিকা, মিশরের গামাল আবদেল নাসেরের ভূমিকা এবং ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণের ইতিবাচক ভূমিকার ফলে জাতীয় নেতা রূপে তাদের মর্যাদা বাড়ে।
(৪) এই সম্মেলনে যোগদানকারী সদস্য রাষ্ট্রগুলি জাতিপুঞ্জের উদ্দেশ্য নীতি প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানানো।
(৫) এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া দেশগুলি একে অপরকে সহযোগিতা করার সুযোগ পায়।
৫. বান্দুং সম্মেলনের ব্যর্থতা
বান্দুং সম্মেলনের সাফল্যের পাশাপাশি কয়েকটি ব্যর্থতা ও দেখা যায়-
(১) বিশ্ব শান্তি নিয়ে এই সম্মেলনে আলোচনা হলেও এ ব্যাপারে কোন নতুন পথের সন্ধান মিলেনি।
(২) বিশ্ব রাজনীতির সমস্যা গুলি কোন স্থায়ী সমাধান হয়নি।
(৩) এই সম্মেলন থেকে কোন আন্তর্জাতিক স্থায়ী সংগঠন প্রতিষ্ঠার আভাস মিলেনি।
উপসংহার
বান্দুং সম্মেলনে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন প্রতিষ্ঠানের ভিত্তিকে সুদৃঢ করতে ব্যর্থ হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যেভাবে বান্দুং সম্মেলনে দশটি নীতি ঐক্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠার সাহায্য করেছিল তা প্রশংসনীয়। সর্বোপরি এই সম্মেলন থেকেই কম্বোডিয়া, শ্রীলংকা,জর্ডন, লিবিয়া, নেপাল ও জাপান সহ বিভিন্ন দেশে জাতিপুঞ্জের সদস্যপদ লাভের দাবিকে সমর্থন করা হয়েছিল।