নিয়ে এস হৃদয়ের বাণী। প্রাণকে প্রাণ দিয়ে জাগিয়ে দিয়ে যাও | তুচ্ছ মানুষের প্রাণ আজ আছে কাল নেই, কিন্তু সনাতন ধর্মবিধি তাে চিরকালের | তােমার জয়জয়কার হবে সুভদ্র। তিনশাে পঁয়তাল্লিশ বছরের আগল তুমি ঘুচিয়েছ

“তােমার জয়জয়কার হবে সুভদ্র। তিনশাে পঁয়তাল্লিশ বছরের আগল তুমি ঘুচিয়েছ।”- এই কথার মধ্যে দিয়ে বক্তা কী বােঝাতে চেয়েছেন?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গুরু’ নাটকে অচলায়তনের বালক সুভদ্র তার কিশাের বয়সের কৌতূহলে আয়তনের উত্তর দিকের জানলা খুলে দেয়। কিন্তু আয়তনের শিক্ষায় বড়াে হয়ে ওঠা সুভদ্র এ ঘটনায় নিজে থেকেই শঙ্কিত হয়ে ওঠে। কারণ আয়তনের ধারণা অনুসারে এই ঘটনা ছিল ভয়ংকর পাপ। সুভদ্রের এই ধারণার স্বীকৃতি পাওয়া যায় উপাধ্যায়ের কথায়। তিনশাে পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে বন্ধ থাকা জানলা খােলাকে তাই তিনি সর্বনাশ বলে উল্লেখ করেন। উত্তরের অধিষ্ঠাত্রী একজটা দেবীর অভিশাপে বালকের দু-চোখ কেন মুহূর্তের মধ্যে পাথর হয়ে গেল না, তাও তাকে ভাবিয়ে তােলে। কিন্তু মুক্ত প্রাণের সমর্থক পঞ্চক স্বাগত জানায় সুভদ্রকে। শাস্ত্রাচারের বিরােধী পঞ্চক একজটা দেবীর সংস্কারকে দূরে সরিয়ে আলিঙ্গন করে সুভদ্রকে। তাঁর কথায় এ হল শাস্ত্রীয় সংকীর্ণতা ভাঙার সূচনা, অসামান্য সাহসের প্রকাশ।

পঞ্চক অচলায়তনের অন্ধ সংস্কারের প্রাচীর ভাঙার কাজে সুভদ্রকে সঙ্গে চায় এবং শেষপর্যন্ত যখন সেই প্রাচীর সত্যিই ভেঙে পড়ে তখনও সুভদ্রের প্রায়শ্চিত্ত সম্পূর্ণ হয় না। পরিবর্তে পঞ্চ তাকে ডাক দেয় চারদিকের সব দরজাজানালা খুলে ফেলার কাজে তার সঙ্গী হতে। নিছক কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে যে কাজ সুভদ্র শুরু করেছিল, নাটকের শেষে এভাবেই তা প্রতীকী জয় পেয়ে যায়।

“তুচ্ছ মানুষের প্রাণ আজ আছে কাল নেই, কিন্তু সনাতন ধর্মবিধি তাে চিরকালের।”- এই মন্তব্যের মধ্যে দিয়ে বক্তা কী বােঝাতে চেয়েছেন?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গুরু’ নাটকে উপাধ্যায় চরিত্রটি প্রধানত অচলায়তনের শাস্ত্রীয় আচার এবং সংস্কারের প্রতিনিধিত্ব করেছে। তাই আয়তনের উত্তর দিকে যে একজটা দেবীর বাস এবং সেদিকের জানলা খুললে দু-চোখ যে মুহূর্তেই পাথর হয়ে যাবে- এমনটা তিনি বিশ্বাস করেন। তার মনে হয় যে, এর ফলে আয়তনের মন্ত্রপূত রুদ্ধ বাতাসকে বাইরের হাওয়া আক্রমণ করতে পারে। তিনশাে পঁয়তাল্লিশ বছর পর নিছক বালকসুলভ কৌতূহলে সুভদ্র আয়তনের উত্তর দিকের জানলা মাত্র এক মুহূর্তের জন্য খুলে ফেললেও উপাধ্যায় মহাশয় তাই সুভদ্রকে হিঙ্গুমর্দনকুণ্ডে স্নান করানাের কথা বলেন। মহাপক চান, ভগবান জ্বলনানন্ডের আধিকমিক বর্ষায়ণ অনুযায়ী সুভদ্রের ছয়মাস মহাতামস ব্রতসাধন। কিন্তু সুভদ্রকে শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে আচার্যের দুর্বলতা উপাধ্যায়কে বিস্মিত করে। কেবল আশীর্বাদের দ্বারা সুভদ্রের অপরাধকে ক্ষমা করার কথা আচার্য অদীনপুণ্য ঘােষণা করলে উপাধ্যায় আচার্যের এই শাস্ত্রবিরুদ্ধ সিদ্ধান্তে অবাক হয়ে যান। মানুষের জীবনকে খণ্ড সময়ের সম্পদ বলে মনে করলেও, সনাতন ধর্মবিধিকে উপাধ্যায় চিরকালের বলে মনে করেন। আসলে শাস্ত্রাচার আর সংকীর্ণতার শাসনে আয়তনকে অচলায়তন বানিয়ে তুলেছিল যে মহাপঞ্চক, উপাচার্য প্রমুখ তাদের সঙ্গে একই শ্রেণিতে অবস্থান উপাধ্যায়েরও। সেই বিশ্বাস থেকেই প্রাণের থেকে সনাতন ধর্মবিধিকে উপাধ্যায় বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।

“…নিয়ে এস হৃদয়ের বাণী। প্রাণকে প্রাণ দিয়ে জাগিয়ে দিয়ে যাও।”- মন্তব্যটির প্রসঙ্গ ও তাৎপর্য আলােচনা করাে।

রবীন্দ্রনাথের ‘গুরু’ নাটকে গুরুর আগমনের সংবাদ আচার্যের মনােজগতে রূপান্তরের সূচনা করে। উত্তর দিকের জানলা খােলায় অচলায়তনে সুভদ্রের প্রায়শ্চিত্তের বিধান দেওয়া হলে আচার্য সেই সিদ্ধান্তের বিরােধিতা করেন। এ নিয়ে মহাপঞ্চক, উপাধ্যায় প্রমুখের সঙ্গে তাঁর বিরােধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। স্পষ্টতই সেই সংঘাতে আচার্যের মনে তীব্র হয়েছে। অচলায়তনের শাস্ত্রাচারের অর্থহীনতার বােধ এবং আত্মােপলদ্ধি। আয়তনের আচার্য হিসেবে তাঁর নিজের ভূমিকা তাঁকে গ্লানিদগ্ধ করেছে। এই প্রসঙ্গেই গুরুকে উদ্দেশ করে প্রার্থনাস্বরূপ আচার্য মন্তব্যটি করেছেন।

গুরুর আগমনের সম্ভাবনাতেই আচার্যের মনােজগতে যেন স্পষ্ট রূপান্তর ঘটে যায়। একদা অষ্টাঙ্গশুদ্ধি উপবাসের তৃতীয় রাতে জলের জন্য কাতর প্রার্থনা করে বালক কুশলশীল প্রাণত্যাগ করলেও আচার্য তা সহ্য করেছেন। কিন্তু এবার তাকেই দেখা যায় সুভদ্রকে প্রায়শ্চিত্ত করা থেকে রক্ষা করতে। এ যেন সম্পূর্ণ নতুন এক আচার্য। অচলায়তনের শাস্ত্রীয় সংস্কারের কাছে। আত্মসমর্পণকে তার অপরাধ’ বলে মনে হয়। তিনি তার প্রায়শ্চিত্ত করতে চান। জীর্ণপুথির ভাণ্ডার নিয়ে তিনি যে এতদিন ধরে তরুণ প্রাণে কোনাে অমৃতবাণীরই সঞ্চার করতে পারেননি, তা দ্বিধাহীনভাবে স্বীকার করেন। তাই গুরুর কাছে তিনি প্রার্থনা করেছেন হৃদয়ের বাণী নিয়ে আসার জন্য। প্রাণের স্পর্শে প্রাণ জেগে উঠুক—এটাই ছিল আচার্যের প্রার্থনা।

“তােমাদের হাতে দিয়ে আমার যে শান্তি আরম্ভ হল তাতেই বুঝতে পারছি গুরুর আবির্ভাব হয়েছে।” -মন্তব্যটির মাধ্যমে বক্তা কী বােঝাতে চেয়েছেন?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গুরু নাটকে গুরুর আগমনের সংবাদে আচার্যের সঙ্গে অচলায়তনের অন্য নিয়মতান্ত্রিকদের সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। সুভদ্র উত্তর দিকের তিনশাে পঁয়তাল্লিশ বছরের বন্ধ জানলা খুলে ফেলায় উপাধ্যায়, মহাপঞ্চক সকলেই যখন তাকে প্রায়শ্চিত্ত করানাের কথা বলছেন, তখন আচার্য সেই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেন। মহাপক শাস্ত্রীয় রীতি লঙ্ঘনের এই ঘটনাকে আচার্যের বুদ্ধিবিকার’ বলে বর্ণনা করেন। মহাপঞ্চক আচার্যকে সংযত রাখতে তাকে বন্ধ করে রাখার কথাও বলেন। প্রয়ােজনে বলপ্রয়ােগের কথা ভাবে জয়ােত্তম। কিন্তু এই ঘটনায় শঙ্কিত হওয়ার বদলে আচার্য প্রফুল্ল হয়ে ওঠেন। গুরুর আগমনে শাস্ত্র ও সংস্কার নির্দিষ্ট ব্যবস্থার যে বদল অবশ্যম্ভাবী—আচার্যের বিধানকে লঙ্ঘন করার মধ্য দিয়েই তার সূচনা হচ্ছে বলে আচার্য মনে করেছেন।

আচার্য অদীনপুণ্য ছিলেন অচলায়তনের প্রধান। কিন্তু আয়তনের অন্ধ সংস্কারসর্বস্বতা ধীরে ধীরে তাকে সেখানকার আচারবিচারের প্রতি বিরূপ করে তােলে। গুরুর আগমন সংবাদে আচার্যের মনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব স্পষ্ট হয়। উপাচার্য যখন বলেন যে প্রসন্ন হয়েছেন বলে গুরু আসছেন, আচার্যের মন্তব্য ছিল— “প্রসন্ন হয়েছেন? তা হবে। হয়তাে প্রসন্নই হয়েছেন।” প্রথমে প্রশ্ন এবং পরে সংশয় স্পষ্ট করে দেয় আচার্যের মনের দ্বিধা। রাজা যখন আচার্য অদীনপুণ্যকে তার পদ থেকে সরিয়ে মহাপককে ওই পদে নিয়ােগের কথা ঘােষণা করেন, তখনই স্পষ্ট হয়ে যায় আচার্য অদীনপুণ্যের রূপান্তর অচলায়তনের চোখেও ধরা পড়েছে।

বাংলা সব প্রশ্ন উত্তর (একাদশ শ্রেণি)

Leave a Comment