নয়া বিশ্বব্যবস্থা
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনায় বিশ্বব্যবস্থা সম্পর্কিত বিষয়টি কোনে নতুন ধারণা নয়। বিশ্বব্যবস্থা সম্পর্কে একটি বিখ্যাত তত্ত্ব রয়েছে। ইমানুয়েল ওয়ালারস্টাইন, আন্দ্রে গুন্ডার ফ্রাঙ্ক, রউল প্রেবিশ প্রমুখ লেখকরা এই তার গড়ে তোলেন। তাঁরা মার্কসীয় মতবাদের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এধরনের একটি তত্ত্বের অবতারণা করেন। নয়া বিশ্বব্যবস্থা সেদিক থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী। মূলত, ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে ঠান্ডা লড়াইমুক্ত দুনিয়ায় বিশ্বায়নের প্রভাবে যে নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়ে ওঠে, তাকেই নয়া বিশ্বব্যবসা বলা হয়। বিশ্বব্যবস্থাকে রাষ্ট্রসমূহের ব্যবস্থা (System of States) বলেও অভিহিত করা হয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের লেখকরা নয়া বিশ্বব্যবস্থাকে বিশ্বায়ন প্রভাবিত আধুনিক বিশ্বের পরস্পর নির্ভরশীল রাষ্ট্রগুলির একষ্ট মডেল বলে আখ্যায়িত করেছেন। রোল্যান্ড রবার্টসনের মতে, বিশ্বায়ন এক নয়া বিশ্বব্যবস্থা সম্প্রসারণের ধারণার সঙ্গে জড়িত। এককথায় বলতে গেলে, বিশ্বায়ন হল বিশ্বব্যবস্থা সম্প্রসারণের এমন এক প্রক্রিয়া যা রাষ্ট্রসংক্রান্ত যাবতীয় সংকীর্ণ ধারণার অবসান ঘটিয়ে এক নতুন অত ব্যবস্থা গড়ে তোলার পক্ষপাতী।
বিশ্বায়ন ও শয়া বিশ্বব্যবস্থা
বিশ্বায়নের সঙ্গে নয়া বিশ্বব্যবস্থার সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়ভাবে যুক্ত। বিশ্বায়ন যেসব দিক থেকে নয়া বিশ্বব্যবস্থাকে গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-
[1] বিশ্ববাণিজ্য ও নয়া বিশ্বব্যবস্থা: বিশ্বায়নের যুগে বিশ্ববাণিজ্য সংশা (WTO) গঠিত হওয়ার পরে সারা দুনিয়া জুড়ে বিশ্ববাণিজ্যের যে নতুন কাঠামো তৈরি হয়, তা নয়া বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলতে প্রধান সহায়ক হিসেবে কাজ করে। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা সারা বিশ্বে যেভাবে একটি অখণ্ড বাণিজ বাবস্থা গড়ে তোলার কাজ শুরু করে তা নয়া বিশ্বব্যবস্থাকে বাস্তবের চেহারা দিতে সক্ষম হয়। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ, নির্বিশেষে ছোটো-বড়ো সব ধরনের দেশ বিশ্বায়নের বাধ্যবাধ্যকতায় বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার সদস্যপদ নিতে বাধ্য হয়। বর্তমানে ১৬০টি দেশ এই সংস্থার সদস্য। প্রভাবে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা সারা পৃথিবীতে একটি অভিন্ন বাণিজ্য নীতির মাধ্যমে বিশ্ববাণিজ্যের মাধ্যমে নয়া বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলতে সফল হয়েছে।
[2] মুক্তবাজার অর্থনীতি ও নয়া বিশ্বব্যবস্থা: বিশ্বায়নের ফলে সমগ্র পৃথিবীতে যে মুক্তবাজার অর্থনীতি (Free Market Economy) গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়, তা নয়া বিশ্বব্যবস্থাকে বাস্তবায়িত করার প্রধান উপাদান হিসেবে কাজ করে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের লেখকরা মনে করেণ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মুক্তবাজার অর্থনীতির যে চল শুরু হয় তা বাণিজ্যিকও আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের সাবেকি আমদানি-রপ্তানি নীতির বদল ঘটিয়ে সমগ্র বিশ্বকে একটি অখন্ড ব্যবস্থায় পরিণত করতে সক্ষম হয়। অনেকের মতে, নয়া বিশ্বব্যবস্থাকে মজবুত করার কাজে বাজার অর্থনীতি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। আজকের দুনিয়ায় এক দেশের অর্থনীতি বিশ্বের অন্যান্য দেশের অর্থনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে টিকে থাকতে পারে না। সারা দুনিয়াতে মুক্তবাজার অর্থনীতি আজ এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে, আমেরিকার শেয়ার বাজারে মন্দা দেখা দিলে বা কোনো কারণে ডলারের দাম পড়ে গেলে মুহূর্তের মধ্যে তার অন্যান্য দেশের অর্থনীতিকে বিশালভাবে প্রভাবিত করে।
[3] সাংস্কৃতিক সমজাতীয়তা ও নয়া বিশ্বব্যবস্থা: বিশ্বায়ন সারা পৃথিবী জুড়ে যেভাবে একই ধরনের সংস্কৃতি গড়ে তুলে সাংস্কৃতিক সমজাতীয়তার পত্তন করতে উদ্যোগী হয়েছে তার ফলে নয়া বিশ্ব্যব্যবস্থা আরও সুদৃঢ় হয়েছে। ইনটারনেট প্রযুক্তির মাধ্যমে বহুজাতিক সংস্থাগুলি একাজে অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করে চলেছে। এভাবে বিশ্বায়ন সারা বিশ্বের সংস্কৃতিকে এক ছাঁচে ঢেলে এক নয়া বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলায় উদ্যোগী হয়েছে।
[4] জাতি-রাষ্ট্রের পরিবর্তিত সার্বভৌমিকতা ও নয়া বিশ্বব্যবস্থা: বিশ্বায়নের প্রভাবে রাষ্ট্রের চিরাচরিত সার্বভৌমিকতার ধারণার বদল ঘটেছে। সার্বভৌমিকতা হল রাষ্ট্রের চরম বা অসীম ক্ষমতা। এই ক্ষমতা অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক দুটি ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বাহ্যিক ক্ষেত্রে আজকের দিনে কোনো রাষ্ট্রই অসীম ক্ষমতার অধিকারী নয়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ, বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা-সহ আরও নানান ধরনের সংস্থার নিয়মকানুন রাষ্ট্রকে মেনে চলতে হয়। যেমন অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের ফলে জাতি-রাষ্ট্রের স্বাধীন অর্থনৈতিক নীতি বিপন্নতার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। এর প্রভাবে তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলি কাঠামোগত সংস্কার, সরকারি ক্ষেত্রে বেসরকারিকরণ ও বিলগ্নিকরণ, ভরতুকি প্রত্যাহার, কর্মী সংকোচন প্রভৃতি নীতির রূপায়ণ করতে বাধ্য হচ্ছে। এভাবে জাতি-রাষ্ট্রের সাবেকি সার্বভৌমিকতার ধারণা বদলে যাওয়ায় সারা বিশ্বজুড়ে এক নয়া বিশ্বব্যবস্থা গড়ে উঠেছে।
[5] বহুজাতিক সংস্থার আধিপত্য ও নয়া বিশ্বব্যবস্থা: বিশ্বায়নের ফলে বহুজাতিক সংস্থা বা কর্পোরেট বিশ্বের যে আধিপত্য সারা পৃথিবীতে কাজ করে চলেছে তা নয়া বিশ্বব্যবস্থাকে যথেষ্ট মজবুত করেছে বলে মনে করা হয়। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার সদস্য হিসেবে রাষ্ট্রসমূহকে এই ব্যবস্থা অনুযায়ী এমন কতকগুলি বিধান পালন করতে হয়, যার ফলে বহুজাতিক সংস্থাগুলি তাদের কর্তৃত্ব বিস্তারের সুযোগ লাভ করেছে। এই বহুজাতিক সংস্থাগুলি সারা বিশ্বজুড়ে একটি অখন্ড বাজার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চায়। এর ফলে নয়া বিশ্বব্যবস্থা গড়ে ওঠার পথ সুগম হয়।