নবম জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন থেকে শুরু করে পরবর্তী জোট নিরপেক্ষ সম্মেলন গুলির ওপর আলোকপাত করো? অথবা, বেলগ্রেড সম্মেলন ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে থেকে পরবর্তী জোট নিরপেক্ষ সম্মেলন গুলির প্রসার আলোচনা করো?

Table of Contents

সূচনা

বিশ্বের শতাধিক রাষ্ট্রের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন বিগত কয়েক দশক ধরে বিশ্ব রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। নির্জন আন্দোলনকারী দেশগুলি একদিকে যেমন তৃতীয় বিশ্বের ধারণাকে স্পষ্ট করেছে অপরদিকে তেমন পরিবর্তনশীল আধুনিক বিশ্ব ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। বেলগেট আয়োজিত নবম নির্জন সম্মেলন ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে থেকে শুরু করে ২০১১ খ্রিস্টাব্দে আয়োজিত বিশেষ বেলগ্রেড সম্মেলন পর্যন্ত নির্জন আন্দোলন ধারা বজায় ঢুকেছে।

নবম জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের থেকে পরবর্তী সম্মেলন সমূহ

« বেলগ্রেট সম্মেলন ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দ

১. আয়োজন

১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে ৪ সেপ্টেম্বর যুগোশ্লাভিয়া রাজধানী বেলগ্রেড নবম নির্জন সম্মেলন বসে। এই সম্মেলন চলে ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। সম্মেলন শুরু হওয়ার আগে বিভিন্ন দেশের বিদেশ মন্ত্রীদের মধ্যে এক খসড়া প্রস্তাব আলোচিত হয়। এই আলোচনায় সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশিকতাবাদ, জাতিবিদ্বেষ এবং বর্ণ বৈষম্যর বিরোধিতা আব আহত রাখার কথা বলা হয়।

২. অংশগ্রহণকারী দেশ ও নেতৃবৃন্দ

নবম নির্জন সম্মেলনে ১২০ টি সদস্য রাষ্ট্র অংশগ্রহণ করে। এছাড়াও অতিথি রাষ্ট্র হিসেবে এই সম্মেলনে যোগ দেয় পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, কানাডা, বুলগেরিয়া, জার্মানি, চেকোশ্লোভাকিয়া, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে প্রভৃতি দেশ। এই সম্মেলনের বিস্ময়কর ভাবে কিউবার রাষ্ট্রপ্রধান ফিদেল কাস্ত্রো, পাক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুটো এবং শ্রীলংকা রাষ্ট্রপতি রাম সিংহের প্রেমদাসা অনুপস্থিতি থাকেন। ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রমন্ত্রী রাজীব গান্ধী এবং সম্মেলনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। তিনিই নির্জটভুক্ত দেশগুলোর সামনে জাতিপুঞ্জের নেতৃত্ব এক পরিবেশ রক্ষার বিষয়ক তহবি ল প্ল্যানেট প্রটেকশন ফ্রন্ট গঠনের প্রস্তাব রাখেন। তিনি আরো বলেন যে উপনিবেশিকতাবাদের অবসানের লোকের জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের উদ্ভব ঘটেছিল। বর্তমানে বিশ্বের উপনিবেশিকতাবাদের অবসান ঘটেছে কিন্তু শুরু হয়েছে অর্থনৈতিক সংগ্রাম। এই আর্থিক সংগ্রামের মোকাবিলার জন্য প্রত্যেককে প্রস্তুত থাকতে হবে।

৩. আলোচিত বিষয়

এই সম্মেলনের সদস্য রাষ্ট্রগুলির অর্থনৈতিক সমস্যা এবং সেগুলি সমাধানের উপায় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। মানবাধিকার রক্ষা পরিবেশের সংরক্ষণ নিরস্তীয়করণ প্রভৃতি বিষয়ের উপর আলোচনা করা হয়। এই প্রথম নির্জট আন্দোলনকে মতাদর্শগত বিরোধ করা যায়। সম্মেলনের উদ্বোধক যুগোশ্লাভিয়া রাষ্ট্রপতির জানেজ দ্রনওভসএক নির্জট আন্দোলনের আধুনিক কি ও করনে প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে বলে উল্লেখ করেন। তিনি বিশ্বের অসম অর্থনৈতিক বিকাশের পরিবর্তে আর্থিক সমতা প্রতিষ্ঠার দাবি করেন।

« জাকার্তা সম্মেলন

১. আয়োজন

ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে ১ সেপ্টেম্বর দশম নির্জন সম্মেলন বসে। এই সম্মেলন চলে ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। এই সম্মেলন শুরু হওয়ার আগে ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে ১২-১৫ মে ইন্দোনেশিয়ায় বালিতে কওঅর্ডইনএটইং ব্যুরোর সভা বসে।

২. অংশগ্রহণকারী দেশ ও নেতৃবর্গ

এই সম্মেলনে মোট ১০৮ টি দেশের প্রতিনিধি যোগ দেয়। সম্মেলনে অতিথি দেশ হিসেবে উপস্থিত থাকে, বোশনিয়া হার্জেগোভিনা এবং স্লোভিনিয়া। এছাড়াও মায়ানমার কে পূর্ণ নির্জন সদস্য রাষ্ট্রের মর্যাদা দেওয়ার হয়।

৩. আলোচিত বিষয়

এই সম্মেলনে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মার্কিন একাধিকপত্য প্রতিষ্ঠা, উপসাগরীয় যুদ্ধ, আন্তর্জাতিক স্তরের সন্ত্রাসবাদের প্রসার, গ্যাট চুক্তিতে স্বাক্ষর দান, অনাবিক মারণাস্তের সম্প্রসারণ রোদে চুক্তি প্রভৃতি বিষয়ের উপর আলোচনা করা হয়। পাশাপাশি এই সম্মেলনের উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা আর ওপর জোর দেওয়া হয়। এছাড়াও রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য বাড়ানোর মাধ্যমে গণতান্ত্রীকরন এর দাবী জানানো হয়।

« কার্টাজেনা সম্মেলন

১. আয়োজন

একাদশ নির্জন সম্মেলনে আয়োজিত হয় কলম্বিয়ার রাজধানী কার্টাজেনা ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে ১৮-২০ অক্টোবর।

২. অংশগ্রহণকারী দেশ ও নেতৃবর্গ

এই সম্মেলনে ১০৬ টি দেশ যোগদান করে। এই সম্মেলনের উদ্বোধন করে কলম্বিয়া প্রজাতন্ত্রের সভাপতি এইচ.ই.আর্নেস্তো স্যাম্পার পিজানো।

৩. আলোচিত বিষয়

এই সম্মেলনে আলোচনার মূল বিষয় ছিল ঠান্ডা যুদ্ধের পরবর্তী পর্যায়ে জোট নিরপেক্ষতার প্রাসঙ্গিকতা এই প্রথম নিরপেক্ষ সম্মেলনে দারিদ্র দূরীকরণের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ এবং সেগুলো রূপায়ণের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হয়। এছাড়াও সম্মেলনটি জীবন বৈচিত্র্যে সর্বপ্রথম আলোচিত হয়।

« ভারবান সম্মেলন

১. আয়োজন

জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের দ্বাদশ সম্মেলনটি বয়সে দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবান শহরে ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দের ২ থেকে ৩ সেপ্টেম্বর।

২. অংশগ্রহণকারী দেশ ও নেতৃবর্গ

এই সম্মেলনে ১০৪ টি দেশ যোগদান। এই সম্মেলনের উদ্বোধন করেন নীলসন ম্যান্ডেলা।

৩. আলোচিত বিষয়

এই সম্মেলনের নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা, জাতীয় মারন ব্যাধির প্রসার রোধ, আন্তর্জাতিক মাদকদ্রব্য চালানো, সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলা প্রভৃতি বিষয়ের উপর আলোচনা করা। সম্মেলনে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী সর্বাত্মক নিরস্তীয়করণের উপর গুরুত্ব দেয়ার কথা বলেন। তিনি নির্জন সদস্য রাষ্ট্রগুলির কাছে সন্ত্রাস বা দমনের জন্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠা গ্রহণের আবেদন রাখেন।

« কুয়ালালামপুর সম্মেলন

১. আয়োজন

মালেশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে শহরে নির্জট আন্দোলনের ত্রয়ওদশ সম্মেলন দিবসে ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে ২৪-২৫ ফেব্রুয়ারি।

২. অংশগ্রহণকারী দেশ

এই সম্মেলনের ১০৭টি দেশ যোগ দেয়।

৩. আলোচিত বিষয়

সম্মেলনের সন্ত্রাসবাদের প্রসার, ইরাক সম্পর্কে মার্কিন নীতি, বিশ্ব বাণিজ্যের বৈষম্য প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা করা হয়। এছাড়াও সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যপ্রাচ্যে এক গণধ্বংসী পরমাণবিক অস্ত্র মুক্ত অঞ্চল গঠনের উপর জোর দেয়। সদস্য রাষ্ট্রগুলো রাষ্ট্রসঙ্ঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদকে আরো সক্রিয় ভূমিকা নেওয়ার অনুরোধ করে। এই সম্মেলনে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি পারভেজ মুসারফ কাশ্মীর সমসাকে প্যালেস্তাইনের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে এক আসন বসানোর চেষ্টা করেন যদিও তার এই চেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি।

« হাভানা সম্মেলন

১. আয়োজন

কিউবার হাভানাতে চতুর্দশ নির্জন সম্মেলন দিবসে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে ১১ থেকে ১৬ সেপ্টেম্বর।

২. অংশগ্রহণকারী দেশ ও নেতৃবর্গ

এই সম্মেলনে ১১৮ টি দেশ যোগ দেয়।

৩. আলোচিত বিষয়

এই সম্মেলনে ইরানের সঙ্গে আমেরিকার পরমাণু সম্পর্কিত সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হয়। পাশাপাশি সদস্য রাষ্ট্রগুলি লেবাননের খবর হিজড়ায়লের আক্রমণের নিন্দা করে এবং রাষ্ট্রসঙ্ঘের পূর্ণ বিনাশের দাবি জানাই। এই সম্মেলনের প্যালেস্তাইন সংকটের ওপর বিশদ আলোচনা হয়। সামগ্রিকভাবে এই সম্মেলনে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করা হয় এবং উন্নয়নশীল দেশগুলির আর্থসামাজিক সংকটে দ্রুত সমাধানের উপর জোর দেয়া হয়।

« শারম-এল-শেখ সম্মেলন

১. আয়োজন

মিশরের শারম-এল-শেখ শহরের ১৫তম নির্জন সম্মেলন দিবসে ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে ১১ থেকে ১৬ জুলাই।

২. অংশগ্রহণকারী দেশ ও নেতৃবর্গ

এই সম্মেলনে ১১৮ টি দেশ যোগ দেয়। সম্মেলনের মিশরের প্রাক্তন রাষ্ট্রপ্রধান হোসনি মুবারক নিয়েছো আন্দোলনকে সজীব ও প্রাণবন্ত আখ্যা দেন। এই সম্মেলনে উপস্থিত একমাত্র ইউরোপীয় সদস্য দেশটি ছিল বেলারুশ।

৩. আলোচিত বিষয়

এই সম্মেলনে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের উপর আলোচনা ও বিতর্ক হয়। বলা হয়, কোন ধর্ম, গোষ্ঠী, সম্প্রদায় বা সভ্যতার সঙ্গে সন্ত্রাসবাদের দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্ক নেই। সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ডক্টর মনমোহন সিং এক সর্বণাত্মক সহযোগিতার চুক্তি তৈরি ও তা কার্যকর করার প্রস্তাব রাখেন।

উপসংহার

ভূতপূর্ব যুগোশ্লাভিয়া রাজধানী বেলগ্রেড ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে আয়োজিত হয়েছিল প্রথম নির্জট সম্মেলনটি। তারপর থেকে একের পর আর নির্জট সম্মেলন আয়োজিত হয়। এই সম্মেলনগুলির পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে অধুনা সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেড সদস্য দেশ গুলি প্রতিনিধিবর্গ মিলিত হন। এই বিশ্বের সম্মেলনে প্রথম থেকে পঞ্চদশ সম্মেলন পর্যন্ত নির্জট আন্দোলনের মূল্যায়ন করা হয়। পাশাপাশি বর্তমান বিশ্বে নির্জট আন্দোলনের ভূমিকার পরিবর্তন অর্থাৎ পূর্বেকার লোকের প্রাসঙ্গিকতার উপর আলোচনা করা হয়।

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বইয়ের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর

Leave a Comment