দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির সঙ্গে সংযোগ জনিত ধারা বিশ্লেষণ করো?

ভূমিকা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রথম দিকে মিত্রশক্তি জোটের ২ সদস্য ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড অক্ষশক্তি জোটভুক্ত জার্মানি আক্রমে কোন ভাষা হয়ে পড়ে। একদিকে জাপানও এশিয়ায় তার বিস্তার নীতির প্রয়োগ ঘটিয়ে রেঙ্গুনের দখল মিলে বৃটির শাসকবর্গ ভীতি হয়ে পড়ে। এভাবে ইউরোপে জার্মানি এবং প্রাচ্যের জাপান উভয় রাষ্ট্রশক্তির চাপে ব্রিটিশ এক অভাবনীয় পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। এই সময় ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ভারতের বাইরে ও বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ভারতের বাইরে এই আন্দোলনগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল ভারতের বীর দেশপ্রেমিক নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এবং তার নেতৃত্বাধীন আজাদ হিন্দ ফৌজ বা ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির সংগ্রাম। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় এন এন. এ জাপানের সাহায্যে ভারতের মুক্তির ওজনের সচেষ্ট হলে উভয়ের মধ্যে সংযোগ স্থাপিত হয়।

আই. এন. এ. জাপানিদের সংযোগ জনিত ধারা

১. প্রাথমিক ধারা

(১) জাপানিদের দিক থেকে : (i) এশিয়ায় জাপানি বিস্তার নীতি : জাপানি বিদেশমন্ত্রী মাৎসুওকা করতে গৃহীত এশিয়ার বিস্তা নীতি বৃহত্তর পূর্ব এশিয়ার যৌথ অগ্রগতি বলয় নামে পরিচিত। এই পরিকল্পনায় অনুসারে জাপানের দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে নিজের সম্প্রসারণ ঘটাতে শুরু করে। জাপানের সামরিক সাফল্যের উৎসাহী হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারতীয়রা জাপানের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের সচেষ্ট হয়।

(ii) ফুজিওয়ারার উদ্যোগ : জাপানের ইম্পেরিয়াল জেনারেল হেডকোয়ার্টার্সের মেজর ইওয়াইচি ফুজিওয়ারার নেতৃত্বে ব্যাংককে ফুজিওয়ার কিকন মিশন গঠিত হয়। এই মিশন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যোগসূত্র তোলার সচেষ্ট হয়। ফুজিওয়ার যুদ্ধবন্দি ভারতীয়দের নিয়ে মোহন সিং নিয়ে নেতৃত্বে এক সেনাদল গঠনের উদ্যোগ নেন।

(iii) ফায়ার পার্কের সমাবেশ : ক্যাপ্টেন মোহন সিংয়ের নেতৃত্বে জাপানের হাতে বন্দি ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাদের নিয়ে সিঙ্গাপুরের পতনের পরের দিন অর্থাৎ ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ১৭ ফেব্রুয়ারি সিঙ্গাপুরের পাড়ার পার্কে এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ফুজিওয়ার পাড়ার পার্কে এক সমাবেশ যুক্তিবন্ধী ভারতীয়দের উদ্দেশ্যে বলেন, “আমার আশা করি তোমার আই. এন. এ. তে যোগ দেবে। জাপানি সোনারা তোমাদের যুদ্ধ বন্দী হিসেবে নয় বন্ধু বলে মনে করবে। আমরা তোমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে স্বীকৃতি দেবো এবং তোমাদের কাজে সর্বত্রভাবে সহায়তা করব।”

(iv) তোজোর বিবৃতি : সিঙ্গাপুরের পতন ঘটার পর জাপানি প্রধানমন্ত্রী তোজো পার্লামেন্টে এক বিবৃতি দেন। হে বিবৃতিতে তিনি বলেন জাপান কখনো ভারতীয়দের শত্রু বলে ভাবে না এবং ব্রিটিশ শাসনের হাত থেকে মুক্তি অর্জনের লড়াইয়ে জাপান সর্বত্রভাবে ভারতবাসীকে সাহায্য করবে। তোজোর এই বিবৃতি এশিয়ার প্রবাসী বিপ্লবীদের উদ্বুদ্ধ করে। তারা জাপানি সাহায্যে বিদেশ থেকে ভারতীয় মুক্তি সংগ্রাম শুরুর লক্ষ্যে সক্রিয় হয়ে ওঠে।

(২) ভারতীয়দের দিক থেকে :(i) রাসবিহারের উদ্যোগ : লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত হলে ভারতে থাকা নিরাপদ নয় ভেবে রাসবিহারী বসু পি. এন. ঠাকুর ছদ্ম নামে জাহাজে করে জাপানে চলে আসেন। জাপানি সরকার ও তার নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলেন, তিনি সেখানকার ব্ল্যাক ড্রাগন সোসাইটির নেতা এম. টওয়আমআর সহজে আট বছর স্বেচ্ছা নিবাসন দিয়ে থাকেন। পরবর্তীকালে মূলত তারাই উদ্যোগে এশিয়ায় প্রবাসী ভারতীয়রা সংঘবদ্ধ হয়।

(ii) আই. এন. এ. গঠন : টোকিওতে আয়োজিত এক সম্মেলন ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ২৮ মার্চ ভারতীয় স্বাধীনতা সংঘ গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্থির হয় এই সংঘ বা লীগ ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে জাপানের সহযোগিতা লাভে চেষ্টা চালাবে। পরে থাইল্যান্ডের ব্যাংককে আয়োজিত এক সমাবেশ ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ১৫ জুন অনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হয় আজাদ হিন্দ বাহিনী বা আই. এন. এ.।

(iii) কর্ম পরিশোধ গঠন : আই. এন. এ. কার্যপ্রণালী নির্ধারণের জন্য এক কর্ম পরিষদ গঠন করা হয়। এই পরিষদের সদস্য হন রাজবিহারী বসু, জেনারেল মোহন সিং, পি. কে. মেনন এবং জি. কিউ. গিয়ানি। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ভারতীয় স্বাধীনতা সংঘ ও আই. এন. এ. উভয় নেতৃত্বে দানের জন্য সুভাষচন্দ্রের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। সুভাষচন্দ্র বসু যাতে নির্বীনে পূর্ব এসে আসতে পারে সে বিষয়ে জাপানে সরকারি সাহায্য প্রার্থনা করে এই পরিষদ।

২. পরবর্তী ধারা

(১) জার্মানি থেকে নেতাজির জাপানে আগমন : ভারতীয় জাতীয় সংঘ সুভাষচন্দ্রকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নেতৃত্ব গ্রহণের আহ্বান জানালে তিনি সেই আহবানে সাড়া দেন। এক দুঃসাহসিক সামুদ্রিক অভিযান শেষে নেতাজি টোকিও জাপানের রাজধানী শহরে আসেন।

(২) সুভাষ-তোজো সাক্ষাৎ : টোকিওতে এসে সুভাষচন্দ্র জাপানি প্রধানমন্ত্রী হিদেকি তোজোর সঙ্গে দেখা করেন। সাক্ষাতে কয়েক দিন পর ইম্পেরিয়াল ডায়েটের এক সভায় সুভাষের উপস্থিতিতে তোজো ঘোষণা করেন -“ভারতের স্বাধীনতার জন্য যা যা করা সম্ভব সেসব করতে যাপান প্রস্তুত।”

(৩) সুভাষের নেতৃত্ব গ্রহণ : তোজোর কাছ থেকে আশ্বাস পেয়ে সুভাষচন্দ্র আসবে বিহারী বসু ও আবিদ হাসানের সঙ্গে সিঙ্গাপুরে এসে পৌঁছন। সিঙ্গাপুরের ক্যাথে থিয়েটারে ভারতবাসী স্বাধীনতা সংঘের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে রাসবিহারী বসুর হাত থেকে নেতৃত্ব গ্রহণ করেন সুভাষচন্দ্র।

(৪) আজাদ হিন্দ ও জাপানি সেনাদের অভিযান : (i) সুভাষ ও জাপানি সেনাধ্যক্ষেরমিলিত সিদ্ধান্ত : দিল্লি অভিযানের সূচনা কালের শোভা ও জাপানি সেনাধ্যক্ষ কাওরা কিছু সিদ্ধান্ত নিলেন, যেমন- (a) আজাদ হিন্দ বাহিনী জাপানি সেনাবাহিনীর সমান মর্যাদা ভাবে, (b) আজাদ হিন্দ ও জাপানি উভয় সেনাবাহিনী একই নেতৃত্বাধীন থাকবে এবং একই সমর কৌশল মেনে যুদ্ধ করবে। (c) অধিকৃত ভারতীয় অঞ্চলগুলি দায়িত্বভার ও কর্তৃত্ব থাকবে আজাদ হিন্দ সেনাদের হাতে।

(ii) ভারত ভূমিতে পদার্পণ : জাপানিদের সাহায্য ও নেতাজির বলিষ্ঠ নেতৃত্বে উদ্বৃত্ত হয়ে আজাদ হীন সেনারা আরাকান দখল করে। বার্মা সীমা অতিক্রম করে তারা ভারত ভূমিতে পা রাখে এবং মনিপুরের মৈরাং -এ তারা জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের ১৪ই এপ্রিল।

(৫) জাপানের পশ্চাদপসরণ : আজাভিনু জাপানি শুয়েনারা কোহিমা এসে পৌঁছালেও এ সময় ইউরোপে জাপান তথা অক্ষশক্তি জোট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজয় মুখোমুখি হয়। অবস্থার সামাল দিতে ভারতের সীমান্ত থেকে জাপানি বিমান সরিয়ে নেওয়া হলে আজাদহীন ও জাপানি সেনাদের আক্রমণের ধারা কমে যায়। এই সুযোগে ইম্ফল রণাঙ্গনে ব্রিটিশ প্রচুর সেনা সমাবেশ ঘটায়। এদিকে বর্ষা নেমে গেলে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে এবং খাদ্য ও সমরাস্ত্র ব্যাহত হয়। এই পরিস্থিতিতে জাপান কিছু হোটেলে আজাদ হিন্দ সেনারা একাকী লড়াই চালাতে থাকে।

(২) আই. এন. এ. আত্মসমর্পণ : জাপান অবশেষে মিত্র পক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এই পরিস্থিতিতে জাপানের কাছ থেকে সাহায্য পাওয়ার সমস্ত সম্ভাবনা বিনষ্ট হওয়ায় আই. এন. এ. সেনারা অস্ত্র ত্যাগে বাধ্য হন। নতুনভাবে স্বাধীনতা সংগ্রাম গড়ে তোলার স্বপ্ন নিয়ে নেতাজি সায়গণ ঢেকে রওনা কালে ফরমোজা দ্বীপে এক বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজীর মৃত্যু ঘটে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে ১৮ আগস্ট।

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বইয়ের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর

Leave a Comment