“দাঁড়াইয়া নন্দের আগে গোপাল কান্দে অনুরাগে
বুক বাহিয়া পড়ে ধারা।”
উক্তপদটিতে পালকপিতা নন্দের সমীপে দাঁড়িয়ে গোপাল অভিমানে কাঁদছে। তাঁর বুক বেয়ে চোখের জলের ধারা পড়ছে। গোপাল ননীচুরি করেছে। মা তাকে ছাঁদন ডোর দিয়ে বেঁধে রেখেছেন। তাই গোপাল পিতার কাছে গিয়ে কাঁদছে। এখানে গোপাল অর্থাৎ ভগবান বিষ্ণু মর্ত্যে বাল্যলীলা খেলায় অবতীর্ণ। শ্রীকৃষ্ণের কথা প্রসঙ্গে পদটি রচিত হয়েছে।
গোপাল জন্মগ্রহণ করেছিলেন মথুরায় মামা কংসের কারাগারে দেবকীর গর্ভ থেকে। বসুদেব কর্তৃক (দেবকীরে স্বামী) তিনি বৃন্দাবনে প্রেরিত হলেন এবং সেখানে নন্দ-যশোদার পুত্ররূপে পালিত হতে থাকলেন। অতএব নন্দের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক হল পিতা-পুত্রের। উক্ত পদটি বৈষ্ণব পদাবলীর বলরাম রচিত ‘বাল্য লীলার’ পদ।
প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে বিশিষ্ট কবিদের নিয়ে সমস্যার অন্ত নেই। অধিকাংশ বিশিষ্ট কবিদের সমনামে অনেক কবির সন্ধান পাওয়া যায়। বিদ্যাপতি, চন্ডীদাস, গোবিন্দদাস, জ্ঞানদাস— এঁদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই সমনামে একাধিক কবির সন্ধান পাওয়া গেছে। কবি বলরাম দাসকে নিয়েও একই সমস্যা। এ প্রসঙ্গে ড. সুকুমার সেন বলেন— ‘বাংলা বৈষ্ণব গীতি কবিদের মধ্যে বলরাম দাস অতি উচ্চ স্থান অধিকার করেন। ইনি কোন্ বলরাম দাস, কে তাঁর সন্ধান দেবে? ‘গৌর ভক্তিতরঙ্গিনী’র সম্পাদক বলেন— ‘বলরাম দাস লইয়া সাহিত্য জগতে বিষম গোল। আমরা ১৯ জন বলরামের সন্ধান পাইয়াছি।
তবে প্রাচীনতর বলরাম দাসই শ্রেষ্ঠ প্রতিভার অধিকারী। ব্রজবুলি ও বাংলায় রচিত তাঁর পদগুলি কবিত্বের দিক দিয়ে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর জন্ম হয়েছিল কৃষ্ণনগরের নিকট দোগাছিয়া গ্রামে। তিনি নিত্যানন্দের দ্বারা দীক্ষিত হয়েছিলেন। তাঁর বংশধর এখনও বর্তমান আছে-তারাই উদ্যোগ করে কবির পদ সংগ্রহ করেছেন। অবশ্য দুজন বলরাম অর্ধশত বৎসরের ব্যবধানে যে পদ রচনা করেছিলেন তা অস্বীকার করা যায় না। একজন ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে বর্তমান ছিলেন। এঁর বাৎসল্য লীলার পদ বৈষ্ণব সাহিত্যে অতুলনীয়। ইনি কিছু কিছু অন্য ভাবের চমৎকার পদ লিখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ এঁর কোন কোন পদের বিশেষ প্রশংসা করতেন।
“হিয়ার ভিতর হৈতে কে কৈল বাহির।
তেঞিও বলরামের পহুর চিত নহে থির।”
সপ্তদশ শতাব্দীতে আর এক বলরাম দাসের আবির্ভাব হয়েছিল। তিনিও কিছু কিছু ভালো পদ লিখেছিলেন। তবে ষোড়শ শতাব্দীর বলরামই প্রতিভায় শ্রেষ্ঠতর। তাঁর বাৎসল্য রসের পদগুলি সঙ্গে সঙ্গে রাধার আক্ষেপানুরাগের বেদনাদীর্ণ পদগুলিকেও শ্রেষ্ঠ বলে গ্রহণ করা যায়।
যাইহোক প্রাণের গভীর আবেগে যে সুখ দুঃখকে তিনি উদঘাটিত করেছেন বৈষ্ণব সাহিত্যে তার দান অসাধারণ। বলরামদাসের বাৎসল্য ভাবের একটি চমৎকার পদে ফুটে উঠেছে যশোদা মায়ের সন্তান-ব্যাকুলতা—
“বলরাম, তুমি মোর গোপাল লৈয়া যাইছ।
যারে ঘুমে চিরাইয়া দুগ্ধ পিয়াইতে নারি
তারে তুমি গোঠে সাজাইছ।।
বসন ধরিয়ে হাতে ফিরে গোপাল সাথে সাথে
দন্ডে দন্ডে দশবার খায়।
এহেন দুধের বাছা বনেতে বিদায় দিয়া
কেমনে ধরিবে প্রাণ মায়।।
এই স্নেহ ব্যাকুল আর্তি নিবিড় মানবরসে ভরা বলে এর স্বাদু মাধুর্য এখানে উপলব্ধি করা যায়।
এছাড়াও বাৎসল্যভাবের পদাবলীতে বলরাম দাস অনেক বৈষ্ণব কবিকে ছড়িয়ে গিয়েছেন। উদ হরণ স্বরূপ একটি পদ উদ্ধৃত করা যেতে পারে।
শ্রীদাম সুদাম দাস শুন ওরে বলরাম
মিনতি করিয়ে তো সভারে।
বন কত অতিদূর নব-তৃণ-কুশাঙ্কুর
গোপাল লৈয়া না যাইহ দুরে।।
রাধাকৃষ্ণলীলা বর্ণনায় বলরামদাস আপনার হৃদয়াবেগ সঞ্চারিত করতে পেরেছিলেন। এই জন্য পদকর্তাদের মধ্যে তাঁর স্থান সুনির্দিষ্ট রূপানুরাগের ও রসোদগারের বর্ণনায় বলরাম অসংশয়িত কৃতিত্বের অধিকারী। নিম্নে উদ্ধৃত পদটি বাঙ্গালায় লেখা শ্রেষ্ঠ গীতি কবিতার মধ্যে একটি—
কিশোর বয়স কত বৈদগধি ধাম
মূরতি মরকত অভিনব কাম।
প্রীতি-অঙ্গ কোন বিধি নিরমিল কিসে
দেখিতে দেখিতে কত অমিয়া বরিষে।
রসের উদ্ভব হয় এই পদটিতে—
“অরুণ-অধর মৃদু মন্দ-মন্দ হাসে।
চঞ্চল নয়ন কোণে জাতিকুল নাশে।”
এখানে মৌলিকতার প্রকাশ না ঘটলেও অকৃত্রিম সরলতা এবং শুচিশুভ্র পরিবেশ সুপরিস্ফুট হয়েছে।
ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলরামের কাব্যের দোষগুণ বিচার করে বলেছেন—“ছন্দ অলঙ্কার ভাষাভঙ্গিমা, কল্পনার অভিনবত্ব, চিত্র কল্পের সুবিহিত প্রয়োগ প্রভৃতি আলোচনা করিলে তাহার পদগুলিতে বিশেষ কোনও কবিত্ব ও নিপুণতা খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।” কিন্তু যাঁরা সাহিত্যে স্বাভাবিকতা এবং যাঁরা মানবিক অনুভূতির সহজ প্রকাশ বিষয়ে আগ্রহী, তাঁরা বলরামদাসের কাব্যরস থেকে যে বঞ্চিত হবেন না একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।