সূচনা
জাভা, সুমাত্রা, দক্ষিণ বোর্নিয়ো, বালি, সেলিবিস, ফ্লওরএস, লাম্বাক, পশ্চিম ইরিয়ন, মালাক্কা দ্বীপপুঞ্জ এবং তিমুর দ্বীপের অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত হয় ইন্দ্রোনেশিয়া। প্রাচীন যুগে এখানে হিন্দু ও রাজারা রাজত্ব করতেন। ষোড়শ শতকের শেষ দিকে স্পেনীয়, ইংরেজ এবং ডাচ (ওলান্দাজ) শক্তিবর্গ ইন্দোনেশিয়াতে প্রস্তাব বিস্তারের চেষ্টা করে। শেষ পর্যন্ত ডাচ বনি কোম্পানি ইন্দোনেশিয়াতে নিজেদের উপনিবেশ গড়ে তুলতে সফল হয়।
ইন্দোনেশিয়া : প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে পরিবর্তিত পরিস্থিত
১. ডাচ শাসন
(১) চরিত্রগত পরিবর্তন : ডাচ কোম্পানির শাসনে অবসানের পর ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে ডাচ সরকার প্রত্যক্ষভাবে ইন্দোনেশিয়ার শাসন ভার হাতে নেয়। প্রাথমিকভাবে ডাজ শাসন ইন্দোনেশিয়ার অধিবাসীদের খুশি করতে পারেনি। ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ দূর করার জন্য ডাচ শাসনের চরিত্রগত পরিবর্তন ঘটানো হয়। ঘোষণা করা হয় শুধুমাত্র অর্থনৈতিক শোষণ নয়, ইন্দোনেশিয়াদের ন্যূনতম হিতসাধন করায় ডাচ শাসনের মূল লক্ষ্য। সরকারি তরফেই নতুন শাসন নীতির নাম দেয়া হয় নৈতিকতা পূর্ণ শাসন ব্যবস্থা (১৯০১ খ্রিস্টাব্দে)।
(২) আর্থ-সামাজিক সংস্কার প্রচেষ্টা : ডাচ শাসন ব্যবস্থা সামাজিক অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রতি আগ্রাধিকার দেওয়া হয়। বাস্তবে আবিষ্কৃত তৈল খনি থেকে তেল রপ্তানি করে এবং উৎপাদিত রবার বিক্রয় করে ডাচ সরকার খুলে ভেবে উঠলে ও জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি সরকার খুলে ভেবে উঠলে ও জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি গুলি অবহেলিতই থেকে যায়।
২. ইন্দোনেশিয়া জাতীয়তাবাদ
(১) উন্মেষ : মূলত উনিশশো কুড়ি খ্রিস্টাব্দের পর থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে সাম্রাজ্যবাদী উপনিবেশিক শাসনের বিরোধিতা শুরু হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবে ইন্দোনেশিয়াতেও উপনিবেশবাদ বিরোধিতা শুরু হয়। ডাচ সরকারের সেনাদের সঙ্গে ইন্দোনেশিয়া দ ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কিছু লড়াই বাঁধে, যেমন – জাভার যুদ্ধ, শুধুমাত্রায় সংঘটিত পার্দেরি যুদ্ধ এবং আছে যুদ্ধ প্রভৃতি। এই লড়াই গুলিকে প্রাক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বলা হয়।
(২) রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা : ইতিপূর্বে ইন্দোনেশিয়ায় গড়ে ওঠে বেশ কয়েকটি জাতীয়তাবাদী প্রতিষ্ঠান, যেমন- বুদি উতোমা (বুদ্ধি উত্তম), সারেকত ইসলাম (মুসলিম জাতীয়তাবাদী সংগঠন), কমিউনিস্ট দল প্রভৃতি। এই সমস্ত দলগুলি নেতৃত্বে ডাচ সাম্রাজ্যবাদী বিরোধী লড়াই শুরু হয়। জাতীয়তাবাদী নেতা ডক্টর সুকর্ন এর নেতৃত্বে ইন্দোনেশিয়ায় ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে ৪ জুলাই ইন্দোনেশিয়া জাতীয়তাবাদী দল প্রতিষ্ঠা হয়। এই দলে নেতৃত্বে ওলন্দাজ শাসনের বিরুদ্ধে ইন্দোনেশিয়ায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন জোরদার হয়।
(৩) স্বায়ত্তশাসনের দাবি : এতদিন স্থানীয় অধিবাসীদের ডাচ শাসন ব্যবস্থায় অংশগ্রহণের কোন সুযোগ না থাকায় তারা এই দাবি তোলে। পাশাপাশি মুসলিম জাতীয়তাবাদী সংগঠন সারেকত ইসলাম ইন্দোনেশিয়া স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তনের দাবি জানায়।
৩. কলোনিয়াল কাউন্সিল গঠন
সারেকত ইসলাম দলে নেতৃত্বে ইন্দোনেশিয়া জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের চরণে পৌঁছয়। ডাচ সরকার বাধ্য হয়ে সমাধান সূত্রে খোঁজার চেষ্টা শুরু করে। সারেকত ইসলাম দলের সভাপতি জোক্সোমিনোতো সঙ্গে ডাচ সরকারের দেশীয় উপদেষ্টা জি. এ. জে. হ্যাজেন আলোচনায় বসেন। আলোচনা কালে হ্যাজেন সরকারি তবে বেশ কিছু অধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেন। এতে বলা হয় –
(১) একটি সর্বসম্মত কাউন্সিল গঠিত হবে, যাতে ইন্দ্রোনেশিয়া সদস্য থাকবে।
(২) রাজনৈতিক গঠন গুলির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়া হবে।
(৩) সংবিধানের ১১১ ধারা রদ করা হবে প্রভৃতি। ইন্দোনেশিয়ায় উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনের প্রথম সফলতা ছিল এই কলোনিয়াল কাউন্সিল বা ভোলক্সরাড গঠন ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে।
৪. উপনিবেশ বিরোধী জাতীয় আন্দোলন
উপনিবেশ বিরোধী জাতি আন্দোলনে এক উল্লেখযোগ্য সংগঠন হিসেবে উঠে আসে পেরহিম্পোনান ইন্দোনেশিয়া বা ইন্দোনেশীয় ইউনিয়ন। হল্যান্ড পাঠরত ইন্দোনেশিয়ার প্রবাসী ছাত্ররা এটি প্রতিষ্ঠা করেন। পরে যা ভাই পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ইঞ্জিনিয়ার সুকর্ণ ইন্দোনেশিয়া ইউনিয়নের সদস্যদের নিয়ে গঠন করেন। (১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দ, চার জুলাই) ইন্দোনেশিয়া জাতীয় দল বা PNI (Partai Nasional Indonesia) । এই দল সর্বপ্রথম দেশজুড়ে এক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়। এই দলের নেতারা দেশের অ-কমিউনিস্টদের এই আন্দোলনে সামিল হওয়ায় আহবান জানায়।
জাতীয় দলের শক্তি বৃদ্ধিতে ভীতি হয়ে ডাজ সরকার অন্য তিন শক্তি বৃদ্ধিতে বৃদ্ধি হয়ে ডাচ সরকার সুকর্ণ সহ অন্য তিন নেতাকে কারা রুদ্ধ করে। সেই সময় হল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা প্রাপ্ত মহম্মদ হিত্তা PNI কালকে নেতৃত্ব দেন। সুকর্ণ জেল থেকে ছাড়বে Partail Indonesia নামে এক বৃহৎ গণসংগঠন গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। এই অপরাধে সুকর্ণকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয় ও Flores এ নির্বাচনে পাঠানো হয়। এ সময় উপনিবেশ বিরোধী জাতীয় আন্দোলনের অগ্রগতিতে সার্কের ইসলাম দল ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৫. জাপানি সাম্রাজ্যবাদ কায়েম
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে অক্ষশক্তি জোট জার্মানির কাছে মিত্র শক্তি জোট ভুক্ত ফ্রান্স ও ব্রিটেন কোন ভাষা হয়ে পড়ে। এই সুযোগের অক্ষশক্তি জোটভুক্ত জাপান দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় তার সাম্রাজ্যবাদী বিস্তার নীতি গ্রহণ করে। এই বিস্তার নীতির অঙ্গ হিসেবে জাপান একে একে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় বিভিন্ন দেশ দখল করে। থাইল্যান্ড অধিকার করার পর জাপানি সেনারা ইন্দোনেশিয়ার দখলে নেই ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৯ মার্চ। ফলে ইন্দ্রোনেশিয়ায় জাপানি উপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদ কায়েম হয়। এক্ষেত্রে জাপানের লক্ষ্য ছিল ইন্দ্রোনেশিয়ার তৈল সম্পদের সমৃদ্ধ দীপ গুলির দখল নেওয়া।
৬. জাপানের পতন
জাপানি সাম্রাজ্যবাদ কায়েম হওয়ার পর জাতীয়তাবাদের সামনে দুটি পথ খোলা থাকে, যার একটি হল জাপ-ডাচ দুই শক্তির বিরুধে লড়াই চালিয়ে যাওয়া। আর অপরটি হল জাপানের আক্রমণের গাছ শাসনের অবসান পর্যন্ত অপেক্ষা করা। কিন্তু জাপানি সেনাদের অত্যাচার ও দমনপীড়ন সহ্যের মাত্রা ছাড়ালে জাতীয়তাবাদীরা জাপানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে তোলে। আঞ্চলিক স্তরে জাপানি সৈন্যরা হার মানে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের আত্মসমর্পণ ইন্দোনেশিয়ায় জাপানকে পতনের দিকে ঠেলে দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে জাপানের পরাজয়ের আসন্ন হলে জাপান ইন্দোনেশিয়া ত্যাগ করে। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১৭ আগস্ট ইন্দোনেশিয়া ডক্টর সুকর্ণ এর নেতৃত্বে একটি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় যা রাজধানী হয় জাকার্তা।
৭. ব্রিটিশ সমর বাহিনীর দখলদারি
জাপান সরে দাঁড়ালে পটসডাম চুক্তি অনুযায়ী ব্রিটিশ বাহিনী আপাত ভাবে ইন্দোনেশিয়ার দখলদারি নেয়। জাপানের আত্মসমর্পণ কালে জাতীয় দল ইন্দোনেশিয়া আত্ম নিয়ন্ত্রণের দাবী জানায়। কিন্তু ব্রিটিশের তরফে এই দাবি আগ্রহ করা হয়। ব্রিটিশ সেনাপতি জাপানের হাতে বন্দীর ২ লক্ষ ডাচ সামরিক ও বেসামরিক কর্মীকে মুক্তি দেয়। এই সুযোগে হল্যান্ড থেকে প্রচুর সেনা ও প্রশাসনিক ব্যক্তি ইন্দ্রোনেশিয়াতে উপস্থিত হয়।
৮. ডাচ শাসনের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা
ব্রিটিশ মদতে সুমাত্রা ও জাভা ছাড়া ইন্দোনেশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলগুলিতে ডাচ কর্তৃত্ব পূর্ন প্রতিষ্ঠিত হয়। সুমাত্রা ও যাভাতের সুকর্ণ এর নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী দল নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখে। বৃটিশের মধ্যস্ততায় ডাচ ইন্দোনেশীয় চুক্তি লিঙ্গ জ্যোতি স্বাক্ষরিত হয় ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ১২ ই নভেম্বর। চুক্তি শর্ত অনুযায়ী , (১) ডাচ সরকার সুমাত্রা, জাভার সরকারকে স্বীকৃতি জানায়। (২) ইন্দোনেশিয়া ও ডাচ উভয়ে মিলিত প্রচেষ্টায় গণতান্ত্রিক যুক্তিরা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। (৩) ডাচ সম্রাটের ছত্রছায়ায় নেদারল্যান্ড ইন্দোনেশিয়া ঐক্য গড়ে উঠবে বলে ঘোষণা করা হয়। চুক্তির শেষে ব্রিটিশ সেনাদল ইন্দোনেশিয়ার ত্যাগ করে।
৯. ডাচ শাসনের অবসান
ইন্দোনেশিয়া থেকে ব্রিটিশ শক্তি সরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চুক্তি ভেঙ্গে যায়। ডাচ ও ইন্দোনেশিয়া একে অপরের ওপর চুক্তিভঙ্গের দায় চাপায়। শেষ পর্যন্ত সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের মধ্যস্থতায় উভয় পক্ষের মধ্যে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে একটি সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৭ ডিসেম্বর ডাচরা ইন্দোনেশিয়া ট্যাগ করে। স্বাধীন United States of Indonesia বা USI এর প্রথম রাষ্ট্রপতি হন সুকর্ণ আর প্রধানমন্ত্রী হন হাত্তা।