সূচনা
হল্যান্ডবাসীদের বা ডাচদের উপনিবেশ ছিল ইন্দোনেশিয়া। জাভা, সুমাত্রা, দক্ষিণ বোর্নিয়ো, সেলিবিস, বালি, লাম্বাক, ফ্লওরএস, মালাক্কা দ্বীপপুঞ্জ ও পশ্চিম ইউনিয়ন এবং তিমোর দ্বীপের অংশবিশেষ নিয়ে ইন্দোনেশিয়া গঠিত। ভৌগোলিক বৈচিত্র্যপূর্ণ ক্রান্তীয় জলবায়ু দেশ ইন্দোনেশিয়া প্রধান জীবিকা হল কৃষিকাজ। ধান, নারকেল, রবার, আখ, চা বিভিন্ন মসলা প্রভৃতি হল এখানকার প্রধান কৃষি দ্রব্য। ইন্দোনেশিয়ায় বিভিন্ন কৃষিজ পণ্য, প্রাকৃতিক সম্পদ, খনিজ সম্পদ, গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্র ইউরোপীয় শক্তিগুলির দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছিল। খ্রিস্টীয় সৌরশ শতকের শেষ দিক থেকে এই স্থানগুলিতে হল্যান্ড বা ডাচদের কর্তত্ব গড়ে ওঠে। পরবর্তী ২০০ বছরের বেশি সময় কাল ধরে এখানে ডাচ উপনিবেশিক শাসন বজায় থাকে।
ইন্দোনেশিয়া ইউরোপীয় উপনিবেশের পরিবর্তিত প্রাথমিক পরিস্থিতি
ইন্দোনেশিয়ার ঔপনিবেশিক পরিস্থিতি
১. পোর্তুগিজ শক্তি
(১) অনুপ্রবেশ : ষোড়শ শতক থেকে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার গুরুত্ব বাড়তে থাকে। ইউরোপীয় বণিক গোষ্ঠীগুলি সমুদ্র বাণিজ্যের প্রধান গন্তব্যস্থলেও হয়ে ওঠে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। মূলত মসলা বাণিজ্যের তাগিদেই দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ইন্দোনেশিয়ায় একের পর এক ইউরোপীয় শক্তির আগমন ঘটে। এক্ষেত্রে সবার আগে পর্তুগিজদের অনুপ্রবেশ ঘটে।
(২) মালাক্কা অধিগ্রহন : মসলা বাণিজ্যের লক্ষ্যে পর্তুগিজরা ইন্দ্রোনেশিয়াতে আসে। বাণিজ্যিক সুবিধার লক্ষ্যে তারা প্রথম বন্দর গুলির ওপর নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। সমকালীন বিশ্ব বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র মালাক্কা দ্বীপ তারা অধিগ্রহণ করে ১৫১১ খ্রিস্টাব্দে।
(৩) স্থানীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ : ইন্দোনেশিয়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপ রাজ্যের অধিকাংশে মুসলিম শাসকদের আধিপত্য বজায় ছিল। আছে রাজ্যের সুলতান পর্তুগিজদের বিরোধিতা করলেও টারনেট ও টিডোর সহ একাধিক দীপ রাজ্যের সুলতান গণ পর্তুগিজদের সাহায্য করে। এই সমস্ত সাহায্যকারী সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় লবঙ্গ বাণিজ্য পর্তুগিজদের একাধিকপত্য কায়েম হয়। এই সমস্ত পৃষ্ঠপোষকতা কারি রাজাদের সম্মতি নিয়ে পর্তুগিজরা একটি কারখানা গড়ে তোলে।
(৪) আধিপত্যের অবস্থান : পর্তুগিজ উপনিবেশ অবশ্য জাভায় বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। আসলে পর্তুগিজদের তরফে ইন্দোনেশিয়া অধিকারবাসী এদের ওপর জোর করে খ্রিস্টধর্ম চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টায় মুসলিম শাসক ও প্রজাদের মনে সন্দেহ তৈরি করে। এই সন্দেহের বসে টারনেট এর সুলতান খ্রিস্টানদের হত্যা করতে শুরু করেন।
২. ওলন্দাজ বা ডাচ শক্তি
(১) অনুপ্রবেশ : ইন্দ্রোনেশিয়ায় পর্তুগিজদের আধিপত্য শেষ হওয়ার আগেই সেখানে সন্তর্পণে ওলন্দাজ শক্তির অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছিল। যদিও ওলন্দাজদের সঙ্গে ইংরেজরা ও এখানে প্রবেশ করে। কিন্তু না না কারণে ইংরেজি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ইন্দোনেশিয়া বিশেষ সাফল্য লাভ করেনি। তাই ইংরেজরা মলয় দ্বীপের দিকে সরে যায়। সপ্তদশ শতকের শেষ দিকে পর্তুগিজ ও ইংরেজদের বিতাড়িত করে ওলন্দাজ বা ডাচরা এককভাবে ইন্দোনেশিয়াতে অবিসংবাদিক উপনিবেশিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
(২) আধিপত্য প্রতিষ্ঠা : ইন্দোনেশিয়ায় আধিপদ প্রতিষ্ঠা কে কেন্দ্র করে প্রথমদিকে পড়তো বিশ্লেষের সঙ্গে ওলন্দাজদের লড়াই বাঁধে। পরে ওলন্দাজদের সঙ্গে ইংরেজদের দ্বন্দ্ব বাঁধে। কিন্তু ইংরেজরাই দ্বন্দ্বকে দীর্ঘ স্থানীয় না করে অন্যত্র সরে যায়। ফলে ওলন্দাজরা বিনা বাধা ইন্দ্রোনেশিয়ায় নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সুযোগ পায়।
(৩) কোম্পানি প্রতিষ্ঠা : পর্তুগিজদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব কালে ওলন্দাজ বাণিজ্য ব্যাহত হতে থাকে। তাছাড়া যুদ্ধকালে মূল্য বৃদ্ধির ও চরমে পৌঁছয়। এই পরিস্থিতিতে ওলন্দাজদরা গঠন করে ‘ওলন্দাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’।
(৪) ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা : ভারতে যেভাবে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের গোরা পতন ঘটেছিল ঠিক একই রকম ভাবে ইন্দোনেশিয়াতে ও ডাচ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা ঘটে। অর্থাৎ বণিকের মানবদণ্ড দেখা দেয় রাজদণ্ড রূপে। ক্রমে ইন্দোনেশিয়ায় ডাচ উপনিবেশ দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়ে উঠতে থাকে। পর্তুগিজরা অবশ্য পরে তাকে গোপনে হত্যা করে। পরবর্তী সুলতান বাবুল্লাহর নেতৃত্বে পর্তুগিজ বিরোধিতা চরমে পৌঁছই। শেষ পর্যন্ত পর্তুগিজদের প্রভাব কমতে থাকে এবং পর্তুগিজ আধিপত্যের অবসান ঘটে।
(৫) কোম্পানি শাসনের অবসান : ইউরোপীয় রাজনীতিতে ডাচ-রা ব্রিটিশ এর কাছে পর্যুদস্ত হয়। এর জেরে ইন্দোনেশিয়ায় বাণিজ্যের ডাচদের একাধিক পত্রের অবসান ঘটে ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে। বাণিজ্য হ্রাসের ফলে কোম্পানি ঋণের পরিমাণ বাড়তে থাকে। ফলের ডাচ বা ওলন্দাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অবসান ঘটে।
ইন্দ্রোনেশিয়ায় জাতীয়তাবাদ
১. উন্মেষ
দীর্ঘ দুই শতক জুড়ে ইন্দোনেশিয়াতে উপনিবেশ বিস্তারের বিরুদ্ধে একাধিক বিলুপ্ত প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। বেশ অর্থ উপার্জনের জন্য ডাচরা কৃষকদের বাণিজ্যিক পণ্য উৎপাদন করতে বাধ্য করে। বিংশ শতকের শুরুতে ইন্দ্রোনেশিয়ায় ওলন্দাজ-বিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তীব্রতর হয়। তবে ইন্দোনেশিয়ায় উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে প্রথম জাতীয়তাবাদী জাগরণ ঘটে বুদি উতোমা নামে এক সংস্কার ধর্মী ও শিক্ষামূলক সংগঠন প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে।
বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত প্রতিনিধি এবং জা ভাই শিক্ষা গ্রহণ ছাত্র গোষ্ঠীর উদ্যোগে এই সংগঠনটি গড়ে ওঠে। প্রাথমিক স্তরে এটি একটি সমাজ কল্যাণমূলক সংগঠন হিসেবে গড়ে উঠলে অধি ধীরে ধীরে এটি গণসচেতনতা গড়ে তোলার চেষ্টা হয়। একই সময়ে স্থানীয় শাসকগোষ্ঠী বা ভূপতি দের উদ্যোগে গড়ে ওঠে শশাঙ্ক পূর্নামা একটি সূচনা নামে আরো একটি সংগঠন। দুই সংগঠন মিলে ইন্দোনেশিয়াতে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটায়।
২. প্রসার
পূর্ব জাভার অধিবাসী জওয়েস বেকার নামে এক সাংবাদিক এক গাছ বিরোধী সংঘবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে তোলেন। তিনি ডেকার ইন্ডিয়ান পার্টি (ইন্দশএ পারতিজ) নামে এক দল গঠন করেন। এই দলের লক্ষ্য ছিল -(১) আইনের চোখে সমস্ত জাতির সমতার স্বীকৃতি; (২) সমান শ্রমের ক্ষেত্রে সমান বেতন দান; (৩) হল্যান্ডের হাতে থেকে মুক্তি লাভ।
পরবর্তীকালে জাতীয়তা বাড়ীর আন্দোলন জাভা থেকে ধীরে ধীরে ইন্দোনেশিয়া অন্যান্য দীপগুলি তে ছড়িয়ে পড়ে। মাতৃভাষায় মুদ্রণ ব্যবস্থা প্রচলন, বেতন ব্যবস্থা প্রবর্তন, পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি ইন্দোনেশিয়ায় জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রসার ঘটাতে সাহায্য করে।