ঠান্ডা লড়াইয়ের বিবর্তন(টিকা)?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পটভূমিতে উদ্ভূত ঠান্ডা লড়াই প্রায় চার দশক ধরে বিভিন্ন সময়ে যেভাবে বিবর্তিত হয় তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পন্ডিতরা ঠান্ডা লড়াইয়ের বিবর্তনের এই সময়কালকে কয়েকটি পর্বে বিভক্ত করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৫ থেকে ১৯৯১-এই দীর্ঘ সময়কালে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে ঠান্ডা লড়াই বিবর্তিত হয়েছে।

[1] প্রথম পর্ব (১৯৪৫-১৯৫০): ঠান্ডা লড়াইয়ের বিবর্তনের প্রথম পর্ব হল ১৯৪৫-১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের সময়কাল। এই সময়কালে যেসব ঘটনা ঠান্ডা লড়াইয়ের পরিস্থিতি তৈরিতে সাহায্য করেছিল তার মধ্যে রয়েছে, পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত রাশিয়ার অনুগামী সমাজতান্ত্রিক শিবিরের উদ্ভব, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ট্রুম্যানের সাম্যবাদী ‘প্রতিরোধের নীতি’ (Policy of Containment), পশ্চিম ইউরোপের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে মার্শাল পরিকল্পনা।

[২] দ্বিতীয় পর্ব (১৯৫০-১৯৫৩): ১৯৫০ থেকে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের সময়কালকে ঠান্ডা লড়াইয়ের দ্বিতীয় পর্ব বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই পর্বে ঠান্ডা লড়াই ইউরোপ থেকে এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। ঠান্ডা লড়াইয়ের মূলকেন্দ্র শুরু থেকেই ইউরোপ ও তার নিকটবর্তী অঞ্চলের মধ্যে সীমিত ছিল। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে তা এশিয়ায় সম্প্রসারিত হয়।

[3] তৃতীয় পর্ব (১৯৫৩-১৯৫৯): ঠান্ডা লড়াইয়ের তৃতীয় পর্ব অর্থাৎ ১৯৫৩-১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দের সময়কালে ইন্দোচিন, পশ্চিম এশিয়া ও ইউরোপের সর্বত্র প্রসারিত হয়। ইন্দোচিনে মার্কিন প্রভাব প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ঠান্ডা লড়াই শুরু হয়ে যায়।

[4] চতুর্থ পর্ব (১৯৫৯-১৯৬২): ঠান্ডা লড়াইয়ের চতুর্থ পর্বের সময়সীমা হল ১৯৫৯-১৯৬২ খ্রিস্টাব্দ। এই পর্বের বিশেষত্ব হল এই সময় দুই মহাশক্তিধর রাষ্ট্রের মধ্যে একদিকে বিরোধ, অন্যদিকে উত্তেজনা প্রশমনের নীতি (Detente) গ্রহণ করা হয়। ১৯৬০-এর দশকে ঠান্ডা লড়াই কিউবা সংকটকে কেন্দ্র করে এক গুরুত্বপূর্ণ দিকে মোড় নেয়। কিউবাকে কেন্দ্র করে সোভিয়েত রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যে ভয়াবহ আণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দেয় তা থেকে হঠাৎ নতুন দিকে মোড় নেয় ঠান্ডা লড়াই। সোভিয়েত রাশিয়া কিউবা থেকে যুদ্ধজাহাজ ফিরিয়ে নেওয়ায় দুই মহাশক্তিধর রাষ্ট্রের মধ্যে কূটনীতির এক নতুন যুগের সূচনা হয়। একে বলা হয় ‘উত্তেজনা প্রশমন’ (Detente)-এর যুগ।

[5] পঞ্চম পর্ব (১৯৬৫-১৯৯০): ঠান্ডা লড়াইয়ের পঞ্চম পর্ব হল উত্তেজনা প্রশমনের অর্থাৎ ‘দেতাঁত’ (Detente) পরবর্তী পর্ব। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে যে উত্তেজনা প্রশমনের সুসম্পর্ক দুই মহাশক্তিধর রাষ্ট্রের মধ্যে গড়ে ওঠে তা কিন্তু বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।

[6] অন্তিম পর্ব (১৯৭৮-১৯৮৯): ঠান্ডা লড়াইয়ের অন্তিম পর্বের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল কাম্বোডিয়ায় ভিয়েতনামের হস্তক্ষেপ এবং আফগানিস্তানে সোভিয়েত রাশিয়ার হস্তক্ষেপ। তবে সোভিয়েত রাশিয়া বেশিদিন এই লড়াইয়ে টিকে থাকতে পারেনি। কঠিন অর্থনৈতিক সংকটের

মধ্যে পড়ে একসময় সোভিয়েত রাশিয়া তার বিশাল সেনাবাহিনী আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। আফগান অভিযান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নিয়ে সোভিয়েত রাশিয়া নিজেকে ঠান্ডা লড়াই থেকেও প্রত্যাহার করে নেয়। এভাবে ঠান্ডা লড়াইয়ের বিবর্তনের পরিসমাপ্তি ঘটে। ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দের ২ জুন সোভিয়েত রাষ্ট্রপতি মিখাইল গোবাচেড এবং মার্কিন রাষ্ট্রপতি বুশের যৌথ ঘোষণায় আনুষ্ঠানিকভাবে ঠান্ডা লড়াইয়ের অবসান ঘোষিত হয়।

Leave a Comment