ঠান্ডা লড়াইয়ের অবসান(টিকা)?

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ঠান্ডা লড়াইয়ের অবসান একটি যুগান্তকারী ঘটনা। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ঠান্ডা লড়াইয়ের অবসান এক নতুন যুগের সূচনা করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তির পরে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১২ মার্চ মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রুম্যানের সাম্যবাদ প্রতিরোধের নীতি’ ঘোষণার মাধ্যমে ঠান্ডা লড়াইয়ের সূত্রপাত হয় এবং ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দের ২ জুন মার্কিন- সোভিয়েত শীর্ষ বৈঠকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঠান্ডা লড়াইয়ের অবসান ঘটে। ঠান্ডা লড়াইয়ের অবসান ঘটে। প্রায় চার দশকের বেশি সময় জুড়ে (১৯৪৭- ১৯৯০) টিকে থাকা ঠান্ডা লড়াইয়ের অবসান স্বতস্ফুর্তভাবে হয়নি। ঠান্ডা লড়াইয়ের অবসানের বিষয়টি আকস্মিকভাবে ঘটেনি। এই লড়াই স্তিমিত হওয়ার প্রক্রিয়া বহুকাল ধরে জারি ছিল। যেসব কারণ ঠান্ডা লড়াইয়ের

অবসানে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-

[ 1] মার্কিন ও সোভিয়েত শিবিরে মতবিরোধ: ঠান্ডা লড়াই পর্বের

সূচনাতে দুই অতিবৃহৎ শক্তিকে নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ক্ষমতার যে মেরুকরণ ঘটেছিল তা দ্বিমেরুকরণ নামে পরিচিত। এ সময় সারা পৃথিবীর দেশগুলি দুটি মেরুতে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন। দ্বিমেরুকরণের এই মডেল কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। নিজেদের জাতীয় স্বার্থে ব্রিটেন ও ফ্রান্স মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আশ্বাসে আস্থা রাখতে না পেরে পারমাণবিক অস্ত্র উৎপাদনের উদ্যোগ শুরু করে দেওয়ায় পশ্চিমি পুঁজিবাদী জোটে মতবিরোধের সূচনা হয়। অনুরূপভাবে সমাজতান্ত্রিক জোটভুক্ত পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিও নিজেদের জাতীয়তাবাদের দিকে তাকিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের চাপিয়ে দেওয়া নীতি পুরোপুরি মেনে চলতে অস্বীকার করে। এর ফলে দ্বিমেরুকরণের পরিস্থিতি ক্রমশ বহুমেরুকরণের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এভাবে মার্কিন ও সোভিয়েত শিবিরের অনৈক্য ঠান্ডা লড়াইয়ের তীব্রতা হ্রাসের একটি বড়ো কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

[2] চিন-সোভিয়েত মতবিরোধ: ১৯৬০-এর দশকে চিন-সোভিয়েত মতবিরোধ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সমাজতান্ত্রিক শিবিরের এই দুই দেশের মতবিরোধের ফলে দ্বিমেরুকরণের অবস্থানের বদলে বহুমেব্রুকরণের সূচনা ঘটে। সোভিয়েত নেতৃত্বের ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি’র কষ্টর সমালোচনা করে চিন একে ‘সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে আপসের নীতি’ বলে অভিহিত করে। চিন ও সোভিয়েতের এই মতাদর্শগত বিরোধ ঠান্ডা লড়াইয়ের তীব্রতা হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে।

[3] কিউবা সংকট ও দেতাঁতপর্ব: ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে কিউবা সংকটকে কেন্দ্র করে ঠান্ডা লড়াই তীব্র আকার ধারণ করে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের লেখকদের মতে, ১৯৬০-এর দশকের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল কিউবা সংকট। সম্ভাব্য মার্কিন আক্রমণের হাত থেকে বাঁচতে কিউবা সরকার সেসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। চুক্তি অনুসারে সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবার সাহায্যের জন্য ক্ষেপণাস্ত্র সমেত একটি সামরিক যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়ে দেয়। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে মার্কিন রাষ্ট্রপতি কেনেছি তরফ থেকে সোভিয়েতের ওই সামরিক যুদ্ধজাহাজকে অবরোধের নিয়ে দেওয়া হয়। সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী ক্রুশ্চেভ শেষমেশ বিশ্বশান্তি ও আপনি যুদ্ধের সম্ভাবনা থেকে বিশ্বকে রক্ষা করার জন্য ক্যারিবিয়ান উপকূল থেকে সোভিয়েত যুদ্ধ জাহাজ ফিরিয়ে নেন। শুরু হয় দুই অতিবৃহৎ শক্তির হস উত্তেজনা প্রশমনের নতুন যুগ। এই যুগকে বলা হয় ‘দেতাঁত’। ফরাসি শ ‘দেতাঁত’-এর অর্থ হল ‘উত্তেজনা প্রশমন’ বা ‘বন্ধুত্বের পুনরুদ্ধার’। কিছু সংকটের পরে ঠান্ডা লড়াইয়ের তীব্রতা হ্রাসে ‘দেতাঁত’ পর্বের অবদান ছিয় অসামান্য। এই পর্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের অবসায় কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।

[4] পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার অচলাবস্থা: আন্তর্জাতির সম্পর্কের লেখকদের মতে, দুই অতিবৃহৎ শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়ে ইউনিয়নের কৌশলগত নীতি পরিবর্তনের ফলে ঠান্ডা লড়াইয়ের অবস্থ ঘটার পথ প্রশস্ত হয়। দুই অতিবৃহৎ শক্তি ঠান্ডা লড়াই শুরু হওয়ার কিছুকা পরে এটা উপলব্ধি করে যে, পরমাণু অস্ত্র তৈরি করা যায় কিন্তু ব্যবহার কর চলে না। পরমাণু যুদ্ধ হলে দুপক্ষেরই ধ্বংস অনিবার্য, রেহাই পাবে না কো প্রভাবে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার অচলাবস্থা ঠান্ডা যুদ্ধে অবসানকে আরও ত্বরান্বিত করে।

[5] জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের ভূমিকা: ঠান্ডা লড়াইয়ের তীব্রতা হ্রায়  জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের ভূমিকা ছিল প্রধান। ঠান্ডা লড়াইয়ের যু তৃতীয় বিশ্বের সদ্য স্বাধীন দেশগুলি জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের নীি অনুসরণ করে মার্কিন বা সোভিয়েত কেনো শক্তি জোটে যোগ না দিয়ে প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করেছিল। দুই অতিবৃহৎ শক্তির প্রতি তৃতীয় বিশ্বে এই মনোভাব ঠান্ডা লড়াইকে স্তিমিত হতে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিল বা অনেকে মনে করেন।

[6] সোভিয়েতের পরিবর্তিত নীতি: ১৯৬০-এর দশকে সোভিয়ে প্রধানমন্ত্রী ক্রুশ্চেভ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের’ (Peacef coexistence) যে নীতি ঘোষণা করেন তা ঠান্ডা লড়াই-এর তীব্রতা হ্রা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। পরবর্তীকালে ১৯৮০-এর দশকে শেষদিকে সোভিয়েত রাষ্ট্রপতি মিখাইল গোর্বাচেভ ‘গ্লাসনোভ’ (খোলা হাওয় এবং ‘পেরেস্ত্রোইকা’ (পুনর্গঠন) নামে যে দুই নীতি ঘোষণা করেন, ঠা যুদ্ধের অবসানে তার ফলাফল ছিল সুদৃঢ়প্রসারী। গোর্বাচেভ মনে করতে পৃথিবীতে অশান্তি ও উত্তেজনার মূলে রয়েছে দুই অতিবৃহৎ শক্তি বেপরোয়া অস্ত্র উৎপাদনের মানসিকতা। এই কারণে তিনি একতরফাভা সোভিয়েত ইউনিয়নকে অস্ত্র উৎপাদনের প্রতিযোগিতা থেকে সরিয়ে নিয় আসার কথা ঘোষণা করেন। গোর্বাচেভের এসমস্ত নীতি ঠান্ডা লড়াইয়ে অবসানকে আরো দ্রুততর করে তোলে।

[7] দুই অতিবৃহৎ শক্তির অর্থনৈতিক পরিস্থিতি: আন্তর্জাতি সম্পর্কের আধুনিক লেখকদের মতে ঠান্ডা লড়াই থেমে যাওয়ার প্রথা কারণ হল বিবদমান দুই অতিবৃহৎ শক্তির অর্থনৈতিক অবস্থা। দীর্ঘকা যাবৎ নতুন নতুন সামরিক অস্ত্রের উৎপাদন, দুনিয়া জুড়ে সামরি ঘাঁটিস্থাপন, বিভিন্ন ধরনের পারমাণবিক পরীক্ষানিরীক্ষা ইত্যাদির ফলে অতিবৃহৎ শক্তির অর্থনীতি এক প্রবল চাপের সম্মুখীন হয়। মার্কিন সোভিয়েত দুই অতিবৃহৎ শক্তি এর থেকে অব্যাহতি পাওয়ার রাস্তা খুঁজছি ১৯৮০-এর দশকে এই সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করে। কার অর্থনৈতিক স্বার্থে উভয়েরই লক্ষ্য ছিল ব্যয় সংকোচন। এই পরিস্থিতি ঠান্ডা লড়াইয়ের অবসান ক্রমশ অনিবার্য হয়ে উঠেছিল।

আফগানিস্তান সংকটে সোভিয়েত নীতির ব্যর্থতা: ঠান্ডা লড়াইয়ের অবসানের সর্বশেষ কারণ হল আফগানিস্তান। সংকট মোকাবিলায় সোভিয়েত নীতির ব্যর্থতা। ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে আফগান সংকট দূর করার উদ্দেশ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন সামরিক বাহিনী প্রেরণের সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্ত আফগানিস্তানকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সহ বহু দেশ একে সোভিয়েত সামরিক আগ্রাসনের নবতম দৃষ্টান্ত বলে ঘোষণা করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রদত্ত হিসাবে অনুসারে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে ৯০ হাজার সেনা পাঠায়। আফগানিস্তানে সোভিয়েত সামরিক হস্তক্ষেপের পরিণতি শেষ অবধি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ১৯৮৮  খ্রিস্টাব্দে সোভিয়েত নেতৃত্ব জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে প্রবল চাপের মধ্যে পড়ে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। এভাবে আফগানিস্তান সংকটে ভ্রান্ত সোভিয়েত নীতি ঠান্ডা লড়াইয়ের অবসানকে বাস্তবায়িত করতে অন্তিম ভূমিকা গ্রহণ করে।

[9] বুশ-গোর্বাচেন্ড ঘোষণা-২ জুন ১৯৯০: ঠান্ডা লড়াইয়ের অবসান আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত হয় মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ বুশ ও সোভিয়েত রাষ্ট্রপতি গোর্বাচেভের শীর্ষ বৈঠকে। ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দের ২ জুন ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে দুই শীর্ষ নেতা এবং যৌথ বিবৃতিতে ঠান্ডা লড়াইয়ের অবসান ঘোষণা করেন। এভাবে পরিসমাপ্তি ঘটে ‘না যুদ্ধ না শান্তি’র এক সে ঠান্ডা লড়াইয়ের, যা প্রকৃত অর্থে কোনো ঘোষিত যুদ্ধ ছিল না।

Leave a Comment