সূচনা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও বিতর্কিত বিষয় হল ঠান্ডা লড়াই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েতের ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন রাষ্ট্র জোটের মধ্যে সংঘটিত ঠান্ডা যুদ্ধে চরিত্র বা এই যুদ্ধের দায়বদ্ধতা নিয়ে ইতিহাসমূল ও রাষ্ট্রতত্ত্ববিদদের মধ্যে পরস্পর বিরোধী ধারণা লক্ষ্য করা যায়। এই পরস্পর বিরোধী ধারণা গুলি হল ঠান্ডা যুদ্ধের তাত্ত্বিক ধারণা।
ঠান্ডা যুদ্ধের তাত্ত্বিক ধারণা সমূহ
• ধারণা গুলি শ্রেণীবিভাগ
ঠান্ডা যুদ্ধের তাত্ত্বিক ধারণা মূলত চারটি, যথা -(১) চিরায়ত বা ঐতিহ্যবাহী বা রক্ষণশীল ধারণা, (২) সংশোধনবাদী ধারণা, (৩) বাস্তববাদী ধারণা ও (৪) অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ধারণা।
• ধারণা গুলির পরিচয়
১. চিরায়ত বা ঐতিহ্যবাহী ধারণা
(১) সমর্থকগণ : ঐতিহ্যবাহী ধারণা সমর্থকগণ হলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জর্জ এফ. কেন্নান, হার্বার্ট ফিস, মেক্সিম লিটভিনভ, জন স্পেনিয়ার, উইলিয়াম এইচ. মেকলিন, মার্টিন ম্যাককাউলে, জে. আর. ম্যাককারথি, জন ডব্লিউ. ম্যআসন প্রমুখ।
(২) মূল বক্তব্য : ঐতিহ্যবাহী ধারণার মূল বক্তব্য হলো ঠান্ডা লড়াইয়ের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট অপেক্ষা সোভিয়েত ইউনিয়ন বেশি দায়ী। এই ধারণা অনুযায়ী মার্কসবাদ ও লেনিনবাদের শ্রেণী সংগ্রাম থেকে ঠান্ডা লড়াইয়ের সূচনা ঘটে। এই মতামত অনুসারে রাশিয়া তার কমিউনিস্ট জগতের পরিধি বাড়াতে চেয়েছিল, তা আর করতে গিয়ে রাশিয়ায় অ কমিউনিস্ট দেশগুলির প্রতি মিত্রতামূলক সম্পর্ক নষ্ট করে। রাশিয়ার এই অগ্রগতির প্রতিবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সচেষ্ট হলে বিশ্বে ঠান্ডা লড়াইয়ের সূচনা ঘটে।
(৩) ব্যাখ্যা : এই রক্ষণশীল বা ঐতিহ্যবাহী ধারণার অনুগামীরা কঠোর পন্থি সোভিয়েত কর্তৃত্ববাদী ভূমিকা কে ঠান্ডা লড়াইয়ের জন্য দায়ী করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়কালে পোল্যান্ড, রুমানিয়া, হাঙ্গেরি, চেকোশ্লোভাকিয়া, অস্ট্রেলিয়া সহপূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে বল প্রয়োগ করে রাশিয়া নিজের কর্তৃত্ব কায়েম করে। রাশিয়া নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন এই ধরনের কর্তৃতবাদী ভূমিকা ছিল পশ্চিমে মিত্র শক্তি গুলির সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তির বিরোধী।
বিশ্বযুদ্ধের শেষ হওয়ার পরে সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান স্টাইলিং যুদ্ধকালীন মৈত্র সহযোগিতা র পরিবেশকে আগ্রহ করেন। পূর্ব ইউরোপের রুশো সম্প্রসারণ বাদের ব্যাপারে স্ট্যালিন পাশ্চাত্য শক্তি বর্গের সঙ্গে কোনো রকম আপোষ মীমাংসায় রাজি হয়নি। স্টালিনের এই এক রেখা মনোভাবের কারণে ইয়াল্টা, পটসডাম প্রভৃতি সম্মেলনের পূর্ব ইউরোপীয় সমস্যা সমাধান হয়নি। সোভিয়েতের পূর্ব ইউরোপীয় নীতির তরুণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিম শক্তিগুলির মধ্যে সোভিয়েতের প্রতি সন্দেহ ও সংশয় বাড়তে থাকে।
এই মতবাদের সমর্থকগণ মনে করে স্টালিন কমিনফর্ম গঠনের মাধ্যমে, চেকোশ্লোভাকিয়া ইত্যাদি ইত্যাদি রাষ্ট্রে কমিউনিস্ট দলকে জঙ্গি পাথরে দিশা দেখিয়ে পশ্চিমে দুনিয়ায় আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করেন। এভাবে রাশিয়া ঠান্ডা লড়াইয়ের প্রেক্ষাপট রচনা করে। ঠান্ডা লড়াইয়ের উদ্ভব প্রসঙ্গে শুভিয়েত ইউনিয়নকে দায়ী করেন মার্টিন ম্যাককাউলে লিখেছেন -“The division of Europe into blocks became inevitable when the Soviet Union refused all those offers of co-operation”।
২. সংশোধনবাদী ধারণা
(১) সমর্থকগণ : ঠান্ডা যুদ্ধের সংশোধনবাদী তাত্ত্বিক ধারণার পথ প্রদর্শক ছিলেন অল্টার লিপম্যান। এই ধরনের অন্যান্য কয়েকজন সমর্থন ছিলেন বই. এফ. ফ্লেমিং, গ্যাব্রিয়েল করো, গার অ্যালপারোভিজ, হেনরি এ. উইলিয়ামস, ওয়াল্টার লেফেভর, নরম্যান গ্রেবনের ডেভিড হরোউইজ, লয়েড গার্ডনার প্রমুখ।
(২) মূল বক্তব্য : সংশোধনবাদী তাত্ত্বিক ধারণার সমর্থকগণের মূল বক্তব্য হল সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্প্রসারণশীল নীতি নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসের নীতি ঠান্ডা যুদ্ধের সূচনা ঘটিয়েছিল। এই ধারণা অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রীয় ইউনিয়নকে প্রতিহত করতে না পেরে নিজস্ব প্রভাবাধীন অঞ্চলের সম্প্রসারণ ঘটাতে শুরু করে ও ঠান্ডা যুদ্ধের সূচনা কে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে।
(৩) ব্যাখ্যা : ঐতিহ্যবাহী ধারণার বিরোধিতা করে সংশোধনবাদী ধারণা সমর্থকগণ ঠান্ডা যুদ্ধের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের পরিবর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেছেন। সংশোধনবাদী ধারণা অনুযায়ী বেশ কিছু মার্কিন পদক্ষেপ নিয়ন্ত্রণ কে বিচলিত ও শঙ্কিত করে তুলেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ লগ্নে আমেরিকা অনাবিক বোমা তৈরি লক্ষে ‘ম্যানহাটন প্রকল্প’ ফোন করলেও রাশিয়াকে তার কোন আগাম ইঙ্গিত দেয়নি। এছাড়াও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ হওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার পশ্চিমে মৃত্যুর রাষ্ট্রগুলির ক্ষতিপূরণ আদায়ের ব্যাপারে সমিতির দাবীকে অমান্য করে।
পাশাপাশি তারা বিশ্বের বিভিন্ন স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সমরবাদী সরকারকে স্পেনের জেনারেল ফ্রাঙ্ক, কম্বোডিয়ায় জেনারেল লন নোল সমর্থন জানালে সোভিয়েত রাশিয়া রুষ্ট হয়। সর্বোপরি পুঁজিবাদী অর্থনীতি দ্বারা বিশ্ব অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার মার্কিন প্রচেষ্টায় সোভিয়েতের ইউনিয়ন বিচলিত হয়ে ওঠে। অল্টার লিপম্যান ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তার ‘The cold War’ গ্রন্থে জর্জ এফ. কেন্নান এর সোভিয়েত বিরোধী বেষ্টনী তত্ত্বকে আগ্রহ করেন। লিভ মেন বলেন পূর্ব ইউরোপের সোভিয়েত সম্প্রসারণের বাধা দান করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঠান্ডা লড়াই দেখে আনে।
ডি. এফ. ফ্লেমিং তার ‘the cold are and its origins 1917-1960 গ্রন্থে বলেছেন যে, মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রুম্যান তার পূর্ব শরীফ রুজভেল্ট অনুষ্ঠিত বিদেশী নীতি থেকে সরে এসে রুশো বিরোধী নীতি গ্রহণ করেন এবং ঠান্ডা যুদ্ধ সূচনা ঘটায়। গার অ্যালপরোভিজ দেখিয়েছেন যে, বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্বে আণবিক বোমা তৈরিতে সাফল্য পেয়ে আমেরিকা তার পূর্বেকার সহাবস্থানে নীতি থেকে সরে এসে ঔদ্ধত্যপঊর্ন মানসিকতা নীতি গ্রহণ করে। অবশ্য তিনি এই সঙ্গে রাশিয়ার অমনীয়তা উল্লেখ করেন।
৩. বাস্তববাদী ধারণা
(১) সমর্থকগণ : ঐতিহ্যবাহী এবং সংশোধনবাদী উভয় ধারণার মধ্যবর্তী অবস্থান গ্রহণ করে একদল গবেষক ঐতিহাসিক ঠান্ডা যুদ্ধের যে তথ্য পেশ করেছেন তা বাস্তববাদী তথ্য নামে পরিচিত। যেই দত্তের কয়েকজন সমর্থন হলেন হ্যানস জে. মর্গ্যানথাউ, লুই জে. হ্যালে, রিচার্ড ক্রকেট, জন লুইস গ্যআডইস প্রমুখ।
(২) মূল বক্তব্য : বাস্তববাদীর ধারণা সমর্থকেরা ঠান্ডা যুদ্ধের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোন একটি পক্ষকে চূড়ান্তভাবে দায়ী করার বিশ্বাসী নন। এদের ধারণায় ঠান্ডা লড়াই সূচনার জন্য সোভিয়েত বা মার্কিন উভয় পক্ষই দায়ী ছিল অথবা কোন পক্ষই দায় ছিল না।
(৩) ব্যাখ্যা : এই ধারনায় বলা হয় ঠান্ডা লড়াইয়ের জন্য দুই বৃহৎ রাষ্ট্র শক্তির পরস্পর বিরোধী মনোভাব বা স্বার্থদ্বন্দ যতটা না দায়ী ছিল, তার চেয়ে বেশি নারী ছিল পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝি। বাস্তববাদী ধারণার দুই প্রধান সমর্থক হ্যানস জে. মর্গ্যানথাউ এবং লুই জে. হ্যালে তাদের গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সৌভিক সম্প্রসারণ নীতিকে সাম্যবাদী মতাদর্শের প্রসার ভেবে অদূরদর্শিতার পরিচয় দেয়।
অপরদিকে সরিয়ে ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পুঁজিবাদী বিশ্বের কর্ণধারয় হিসেবে চিহ্নিত করে একই ভুল করে। অধ্যাপক রিচার্ড ক্রকেট এর ধারণাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে যে রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হয় তা পূরণ করার লক্ষ্যে শোভিয়েত ও মার্কিন শক্তি এগিয়ে এলে ঠান্ডা লড়াইয়ের বাস্তব প্রেক্ষাপট রচিত হয়। মার্কিন লেখক জন গ্যাডিস, তার গ্রন্থে বলেছেন ঠান্ডা লড়াই কোন বিশেষ ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের আগ্রাসীন কার্যকলাপের ফল শ্রুতি ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর্যায় আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির এর জন্য দায়ী ছিল।
৪. অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ব্যাখ্যা
কেউ কেউ মনে করেন যে ঠান্ডা লড়াই ছিল প্রকৃতপক্ষে আমেরিকার অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ এর অন্যতম দিক। গ্যাব্রিয়েল কলকো দেখিয়েছেন যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আমেরিকা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়। আমেরিকা তার এই আর্থিক শক্তিকে ব্যবহার করে বিশ্ব অর্থনীতির প্রধান চালকের আসন লাভের চেষ্টা করেছিল। এই লক্ষী আমেরিকা তার বিদেশ নীতিতে পরিবর্তন ঘটায়। মার্শাল পরিকল্পনার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশকে বিপুল পরিমাণ অর্থ সাহায্য দিয়ে আমেরিকার যুদ্ধ বিধ্বস্ত ইউরোপে নিজেকে পরিত্রাতা হিসেবে তুলে ধরার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু বৈদেশিক ক্ষেত্রে আমেরিকার অর্থনৈতিক নীতি বাস্তবায়নের প্রধান ছিল সোভিয়েত রাশিয়া। এই জন্য রাশিয়া ও তার অনুগত রাষ্ট্রগুলির বিরুদ্ধে আমেরিকা একপ্রকার ক্রুসেড ঘোষণা করে। এর ফলে ঠান্ডা লড়াইয়ের সূত্রপাত ঘটে।
• ঠান্ডা লড়াই : সাম্প্রতিক অভিমত :
ঠান্ডা যুদ্ধের তাত্ত্বিক ধারণা গুলি সম্প্রতি বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার বিশ্লেষণ করা শুরু হয়েছে। এই ধারণায় অনেকটাই বাস্তববাদী ধারণা প্রতিফলন মেলে। থামস জি. পিটারসন রচিত ‘Soviet American Confrontation’ না আমি গ্রন্থে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়কালের সোভিয়েত কর্তৃত্ববাদী মনোভাব এবং মার্কিন ক্ষমতা লাভের প্রবণতা ঠান্ডা লড়াইয়ে জন্ম দিয়েছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আরনেস্ট মে তার লেখা প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন যে, ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে সোভিয়েত ও মার্কিন উভয়ের মধ্যে তিক্ততা বাড়তে থাকে। এই বিচারের ঠান্ডা লড়াই সূচনার জন্য উভয়ই দায়ী ছিল বলা হয়। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক Geoffrey Berraclough এর ধারণাই ঠান্ডা লড়াই এর উদ্ভব দুটি বিষয় সাহায্য করে, যথা -(১) আন্তর্জাতিক সংকট, (২) আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রধান্য প্রতিষ্টা