এর ১৯৫০-এর দশকে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন গড়ে উঠলে অচিরেই তা তৃতীয় বে বিশ্বের সদ্য স্বাধীন দেশগুলির কাছে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ভারত, য় যুগোশ্লাভিয়া, মিশর, ইন্দোনেশিয়া এবং ঘানা-এই পাঁচটি দেশকে নিয়ে র আন্দোলন শুরু হলেও প্রথম সম্মেলনে ২৫টি দেশ তাতে যোগদান করে। দীর্ঘকাল যাবৎ ঔপনিবেশিক শাসনের কবলে থাকা এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার এই সদ্য স্বাধীন দেশগুলি যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল তা অচিরেই দ্বিমেরুকরণের মহাশক্তিধর দুই জোটের কাছে এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। মূলত যেসব কারণে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন দ্বিমেরুকরণের দুনিয়ায় এক বিকল্প ও প্রতিদ্বন্দ্বী আন্দোলন হিসেবে গড়ে ওঠে, সেগুলি হল-
(1) ভিন্নধর্মী জোট: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে দ্বিমেব্রুকরণ দুই ও মহাশক্তিধর রাষ্ট্রের যে জোট গড়ে তুলেছিল তা ছিল আসলে যুদ্ধকামী ল। সামরিক জোট। একদিকে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাটো জোট, অন্যদিকে এই ছিল সোভিয়েত রাশিয়ার ওয়ারশ জোট। তৃতীয় বিশ্বের জোটনিরপেক্ষ ত আন্দোলন সেদিক থেকে ছিল একেবারে ভিন্নধর্মী জোট। এই জোট যুদ্ধ বাধাতে চায়নি, যুদ্ধ প্রতিহত করতে চেয়েছিল। এই কারণে জোটনিরপেক্ষ উৎপাদনের তীব্র বিরোধিতা করে।
[2] আধিপত্য বিরোধিতা: মার্কিন ও সোভিয়েত এই দুই মহাশক্তিধর রাষ্ট্র কর্তৃক চালিত দ্বিমেরুকরণের প্রধান লক্ষ্য ছিল আধিপত্য বিস্তার। সেখানে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন যে নিজোট নীতি গড়ে তোলে তা ছিল সবরকম আধিপত্যের বিরোধী। তাই জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের যৌথ সংগ্রামের প্রধান কর্মসূচি ছিল সাম্রাজ্যবাদী শাসন থেকে মুক্তি। বর্ণবৈষম্যবাদের নির্মূলকরণ, নয়া ঔপনিবেশিক শোষণ সম্পর্কে সতর্কতা অবলম্বন, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি।
[3] আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার গণতন্ত্রীকরণ: দ্বিমেরুকরণ যখন সারা দুনিয়াকে দুটি মেরুতে বিভক্ত করে সমগ্র আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে দুই মহাশক্তিধর রাষ্ট্রের কুক্ষিগত করতে চেয়েছিল তখন জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন একে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার গণতন্ত্রীকরণকে আহ্বান জানিয়েছিল। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের মূলনীতি ছিল আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা। সেখানে কোনো বৃহৎ শক্তিজোটের ক্ষমতা শেষ কথা হবে না, বৃহৎ ক্ষুদ্র নির্বিশেষে তৃতীয় বিশ্বের সদ্য স্বাধীন ছোটো ছোটো দেশগুলির সম্মিলিত কন্ঠস্বর শেষ কথা বলার অধিকারী হবে। তাই জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক আদর্শ অনুসরণের মঞ্চ হিসেবে গড়ে উঠেছিল।
[4] সামাজিক ন্যায় ও স্বনির্ভর উন্নয়ন: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দুই বৃহৎ শক্তিচালিত দ্বিমেরুকরণ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যে জোটবদ্ধতা গড়ে তোলে তার অন্যতম লক্ষ্য ছিল পরনির্ভরতা। সামরিক বা অর্থনৈতিক যেদিক থেকেই হোক না কেন, জোটবদ্ধ দেশগুলিকে হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয় সোভিয়েত রাশিয়া যে-কোনো এক মহাশক্তিধর রাষ্ট্রের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হত। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এই পরিবেশে দাঁড়িয়ে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন সামাজিক ন্যায় ও স্বনির্ভর উন্নয়নের এক বিকল্পকে তুলে ধরেছিল। এই কারণে জোটনিরপেক্ষ দেশগুলি তাদের জাতীয় স্বার্থে ধনতন্ত্র বা সমাজতন্ত্র কোনোটিকেই পুরোপুরি গ্রহণ না করে মধ্যপন্থা অবলম্বনকে শ্রেয় মনে করেছিল।
[5] অন্য নিরপেক্ষতা: দ্বিমেব্রুকরণে নিরপেক্ষতার কোনো জায়গা নেই। দ্বিমেরুকরণের দেশগুলি প্রকাশ্যে যে-কোনো এক পক্ষের হয়ে কাজ করে। তারা কেউই নিরপেক্ষ নয়। অন্যদিকে, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের মূল কথাই হল নিরপেক্ষতা। এ এক অন্য ধরনের নিরপেক্ষতা। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নির্লিপ্ত হয়ে থাকা নয়, দ্বিমেরুকরণের দুনিয়ায় ঠান্ডা লড়াইয়ের পরিবেশে প্রতিটি সমস্যা ও বিবাদের বিষয়কে পর্যালোচনা করে সেই অনুযায়ী স্বাধীন অবস্থান গ্রহণ করাই ছিল জোটনিরপেক্ষতার লক্ষ্য। জোটনিরপেক্ষ দেশগুলির দৃষ্টিভঙ্গি ছিল স্বতন্ত্র প্রকৃতির। তারা যেমন ঠান্ডা লড়াইয়ে অংশ নিতে চাননি তেমনি ঠান্ডা লড়াইয়ে কোনো পক্ষপাতিত্বও করেনি। জোটনিরপেক্ষতা একদিকে যেমন কোনো বৃহৎ শক্তির দ্বারা প্রভাবিত হতে চায়নি, অন্যদিকে তেমনি সে কোনো বৃহৎ শক্তিকে তুষ্ট করতেও চায়নি।
[6] মতাদর্শ নিরপেক্ষতা: আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দ্বিমেরুকরণের প্রতিষ্ঠাতা দুই মহাশক্তিধর রাষ্ট্র ছিল দুই ভিন্ন মতাদর্শের পৃষ্ঠপোষক। একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাদ, অন্যদিকে সোভিয়েতের সমাজবাদ। অনেকে একে দুই রাজনৈতিক মতাদর্শের মনস্তাত্বিক যুদ্ধ বলেও বর্ণনা করেছেন। এই পটভূমিতে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন কোনো মতাদর্শের অনুসারী না হয়ে রাজনৈতিক মতাদর্শ-নিরপেক্ষ একটি আন্দোলন গড়ে তুলতে চেয়েছে। তাই জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে একই মঞ্চে শামিল হতে দেখা গেছে।
[7] বিরোধ নিষ্পত্তিতে ইতিবাচক ভূমিকা: ঠান্ডা লড়াইয়ের পরিবেশে। আন্তর্জাতিক বিরোধনিষ্পত্তির ক্ষেত্রে দুই বৃহৎ শক্তিচালিত দ্বিমেরুকরণের ভূমিকা ছিল নেতিবাচক। আণবিক অস্ত্র প্রয়োগের চুমকি, দূরপাল্লা ও মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপন, পারমাণবিক যুদ্ধজাহাজ প্রেরণ ইত্যাদি ছিল এর অঙ্গ। এই পটভূমিকায় জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতার লক্ষ্যে ইতিবাচক ভূমিকা পালনের চেষ্টা করেছে। বিরোধের সঙ্গে জড়িত না হয়েও তারা বিরোধ মীমাংসায় সক্রিয় উদ্যোগ নিয়েছে। অতীতে আপস ও মধ্যস্থতার মাধ্যমে জোটনিরপেক্ষ দেশ বন্ধু বিরোধের নিষ্পত্তি করেছে।
জোটনিরপেক্ষতার উৎপত্তি
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে জোটনিরপেক্ষতা একটি তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক আন্দোলন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে যুদ্ধোত্তর বিশ্বে দুই মহাশক্তিধর রাষ্ট্র (Super Power) যথাক্রমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনৈতিক ও সামরিক জোটের বাইরে তৃতীয় বিশ্বের সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের নেতৃত্বে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সূচনা হয়। জোটনিরপেক্ষ দেশগুলি প্রধানত ঠান্ডা যুদ্ধের দুনিয়ায় কোনো জোটে যোগ না দিয়ে সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ বিরোধী জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সপক্ষে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এক প্রগতিশীল স্বাধীন নীতির জন্ম দেয়। জোটনিরপেক্ষতা আন্দোলনের প্রধান প্রবক্তারা হলেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহরু, যুগোশ্লাভিয়ার রাষ্ট্রপতি টিটো, ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতি সুকর্ণ, মিশরের রাষ্ট্রপতি নাসের এবং ঘানার প্রধানমন্ত্রী নকুমা। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে জোটনিরপেক্ষ দেশগুলি আন্দোলনের প্রথম সূচনা হয় বেলগ্রেড শীর্ষ সম্মেলনে। এই সম্মেলনে ২৫টি রাষ্ট্র যোগ দেয়।
জোটনিরপেক্ষতার অর্থ
জোটনিরপেক্ষতা বলতে কোনো নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বা সমস্ত জোট থেকে সমদূরত্ব বজায় রেখে চলার নীতি বোঝায় না। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের লেখক বাটন (Burton) তাঁর International Relations শীর্ষক গ্রন্থে জোটনিরপেক্ষতা নীতির উদ্ভবের পিছনে যে সকল বিষয়ের কথা উল্লেখ করেছেন, তার মধ্যে রয়েছে বিশ্বযুদ্ধোত্তর জাতীয়তাবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদ বিরোধিতা, অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা প্রভৃতি। জোটনিরপেক্ষতার সংজ্ঞা নির্দেশ করতে গিয়ে বাটন বলেছেন, জোটনিরপেক্ষতা বলতে সেই সকল দেশের পররাষ্ট্রনীতিকে বোঝায় যারা কমিউনিস্ট বা পাশ্চাত্যের কোনো জোটে যোগদান করা থেকে বিরত থেকেছে। সাধারণভাবে জোটনিরপেক্ষতা নীতি কোনো বৃহৎ শক্তির উদ্যোগে সংগঠিত সামরিক জোটে যোগদানের বিরোধী। অবশ্য জোটনিরপেক্ষতা বলতে কঠোর নিরপেক্ষতা বোঝায় না। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের লেখকদের মতে জোটনিরপেক্ষতা হল গতিশীল নিরপেক্ষতা।
জোটনিরপেক্ষতার প্রকৃতি
জোটনিরপেক্ষতা বলতে সাধারণ নিরপেক্ষতাকে বোঝায় না। আন্তর্জাতিক আইনে যুদ্ধজনিত পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে যে নিরপেক্ষতার কথা বলা হয় জোটনিরপেক্ষ নীতি তা থেকে স্বতন্ত্র প্রকৃতির। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত হয়ে থাকা নয়, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সমস্যা ও বিবাদ-বিসংবাদের পটভূমিকায় উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে স্বাধীন অবস্থান নেওয়াটাই জোটনিরপেক্ষতার মূল লক্ষ্য। বৃহৎ বা অতিবৃহৎ কোনো শক্তির দ্বারা প্রভাবিত হওয়া অথবা কোনো পক্ষের তুষ্টিবিধানের ব্যবস্থা নেও জোটনিরপেক্ষতার প্রকৃতির মধ্যে পড়ে না। দেশগুলি নিজেদের জাত স্বার্থের চেয়েও জোটের স্বার্থকে এক্ষেত্রে বড়ো করে দেখে।
জোটনিরপেক্ষতার সঙ্গে সামরিক জোটবদ্ধতার আমূল পার্থক রয়েছে। সামরিক জোট (যেমন ন্যাটো) সদস্যরাষ্ট্রগুলিকে কোনো বিদ্যা বিশেষ অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে বাধ্য করে। কি জোটনিরপেক্ষতার ক্ষেত্রে সদস্যরাষ্ট্রগুলির সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতামে সর্বাধিক অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
জোটনিরপেক্ষতার প্রকৃতির মধ্যে সমস্তরকম আধিপত্যের বিরোধিত নিহিত রয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী, উপনিবেশবাদী ও নয়া উপনিবেশবাদী শোফল বর্ণবৈষম্যবাদ, মানবাধিকার হরণ ইত্যাদির নির্মূলকরণে জোটনিরপেক্ষরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় বিশেষত উন্নত উন্নয়নশীল বিশ্বের আর্থিক বৈষম্য দূরীকরণ, নয়া বিশ্বব্যবস্থায় উন্নয়নশী দেশগুলির স্বার্থরক্ষা ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে তাদের দাবিদাওয়ার ন্যাস প্রতিষ্ঠা জোটনিরপেক্ষতার মৌল উদ্দেশ্য বলে বিবেচিত হয়।
জোটনিরপেক্ষতা কোনো বিশেষ মতাদর্শের অনুসারী নয়। বন্ধুর জোটনিরপেক্ষতা হল রাজনৈতিক মতাদর্শ-নিরপেক্ষ এমন একটি আন্দোল যার মধ্যে উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র একইসঙ্গে শামিল হয়েছে।
জোটনিরপেক্ষতার উদ্দেশ্য ও নীতিসমূহ
জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের লক্ষ্য ও মূল নীতিগুলি বান্দুং সম্মেল (১৯৫৫ খ্রি.), বেলগ্রেড সম্মেলন (১৯৬১ খ্রি.) এবং কায়রো সম্মেলে (১৯৬৪ খ্রি.) গৃহীত হয়। এই নীতিগুলি হল-① আন্তর্জাতিক বেত শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, ② বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় শান্তিপূর্ণ সহযোগিত ③ ঔপনিবেশিকতা, নয়া ঔপনিবেশিকতা, বর্ণবৈষম্য ও জাতিবিদ্বেষে বিরোধিতা, নিরস্ত্রীকরণ ও আণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা নিষিদ্ধকর ⑤ সকল জাতির সার্বভৌমত্ব ও ভূখণ্ডগত অখণ্ডতার প্রতি মর্যাদাঞ্জাপ ⑥ ন্যায়নীতি ও আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতার প্রতি মান্যতা প্রদর্শ ⑦ মৌলিক মানবাধিকার ও সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সনদে উল্লিখিত উদ্দেশ ও লক্ষ্যের প্রতি মর্যাদা প্রদর্শন, ৪ অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীপ ক্ষেত্রে হস্তক্ষে ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে আগ্রাসনমূল কার্যকলাপ, বলপ্রয়োগ ইত্যাদি থেকে বিরত থাকা, সকল জাতি আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবিকে স্বীকৃতিদান ইত্যাদি।
জোটনিরপেক্ষ নীতির বর্তমান প্রাসঙ্গিকতা
একবিংশ শতাব্দীর একমেরু বিশ্বে জোটনিরপেক্ষ নীতি ইতিবাচক ভূমিয় পালন করতে পারে বলে অনেকে মনে করেন। বর্তমান দুনিয়ায় একক বৃহ শক্তি হিসেবে মার্কিনি আধিপত্যের সামনে মাঝারি ও ছোটো রাষ্ট্রগুলি সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার দিক থেকে এই আন্দোলন প্রাসঙ্গিক। সাম্প্রতিক কালে আফগানিস্তান ও ইরাকের ওপর মার্কিন আগ্রাসন প্রমাণ করেছে। একক বৃহৎ শক্তিধর রাষ্ট্রের কাছে ছোটো রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব অনায়াসে কি হতে পারে। কোনো ছোটো রাষ্ট্রই এককভাবে নিজের নিরাপত্তাকে সুরক্টি রাখতে পারে না। এ পরিস্থিতিতে জোটনিরপেক্ষ নীতি একক বৃহৎ শক্তি প্রভুত্ববাদের প্রতিরোধে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে
জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর দক্ষিশ গোলার্ধের দেশগুলিকে নিয়ে ‘দক্ষিণ-দক্ষিণ’ সহযোগিতা সম্প্রসারণের জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে শক্তিশালী মঞ্চ হয়ে উঠতে পারে। এর ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে জাতিপুঞ্জের মানবাধিকার সংক্রান্ত ঘোষণা জারি হলেও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তার যথাযথ রূপায়ণ আজও হয়ে ওঠেনি। এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি একুশ শতকেও দারিদ্র্য, লিঙ্গবৈষম্য, অপুষ্টি, ক্ষুধা ও শিশুমৃত্যুর হাত থেকে মুক্ত হতে পারেনি। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ-সহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংগঠন উন্নয়নশীল দেশগুলির দারিদ্র্যদূরীকরণে আজও সেভাবে এগিয়ে আসেনি। এই পরিপ্রেক্ষিতে উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলির প্রতিনিধি হিসেবে এগিয়ে আসতে পারে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশ্বশান্তি ও সহযোগিতার যে মূল্যবোধ নিয়ে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের আবির্ভাব ঘটেছিল তা কিন্তু আজও একেবারে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েনি। পৃথিবী আজও বহন করে চলেছে পরমাণু যুদ্ধের অভিশপ্ত উত্তরাধিকার। এই পারমাণবিক সন্ত্রাসের একচেটিয়া অধিকার থেকে গেছে উন্নত বিশ্বের হাতে। দ্বিমেরুকরণ নেই, পাল্টা কোনো সামরিক জোট নেই তবু এখনও মার্কিন সামরিক জোট ন্যাটো (NATO) রয়ে গেছে। পূর্ব ইউরোপের যে দেশগুলি এককালে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের অন্তর্ভুক্ত ছিল তারা প্রায় সবাই এমনকি রাশিয়াও এখন ন্যাটোর সদস্যপদ নিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির স্বাধীন অস্তিত্বের জন্য এবং সেই সঙ্গে বিশ্বশান্তি ও সহযোগিতার জন্য জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা অন্যভাবে দেখা দিতে পারে বলে অনেকে মনে করেন।