জাদুকর শব্দ ও ধারণার উৎপত্তির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দাও? জাদুঘরের প্রকারভেদ উল্লেখ করো?

জাদুঘর শব্দ ও ধারণার উৎপত্তি

১. প্রাচীন গ্রিসের কিংবদন্তি

প্রাচীন গ্রীক লেখক পসেনিয়াস-এর লেখায় প্রাচীন এথেন্স এর একটি পাহাড়কে প্রথম মিউজিয়াম বা জাদুঘর আখ্যা দেয়া হয়। প্রাচীন গ্রীসের কিংবদন্ত থেকে জানা যায় যে ধ্রুপদি যুগের অ্যাক্রোপলিশ (ধ্রুপদী যুগে গ্রিসের শাসন কেন্দ্র) এর বিপরীত দিকে অবস্থিত একটি ছোট পাহাড়ে বসে মিউজিয়াম নামে একটি ব্যক্তি গান গাইতেন। বৃদ্ধ বয়সে মিউজিয়াম এই পাহাড়েই মারা যান এবং তাকে সেখানে সমাধিস্থ করা হয়। এর সংগীতজ্ঞ মিউজিয়ামের নামানুসারে পাহাড়টি নামকরণ হয় ,”ম‌উসিয়ন” । ঐতিহাসিকদের অনুমান এই ম‌উসিয়ন শব্দ থেকে পরবর্তী সময়ে Museum বা জাদুঘর শব্দের ধারণা আসে।

২. শব্দের ব্যুৎপত্তি

বাংলা জাদুকর সদর ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো মিউজিয়াম। মিউজিয়াম শব্দের মূল উৎস হল প্রাচীন গ্রিক শব্দ Mouseion যার অর্থ হলো গ্রীক পুরাণীর এই ধরনের মন্দির গুলোকে কেন্দ্র করে পাঠাগার ও শিল্প পুরাকৃতি সংগ্রহশালা গড়ে উঠতে দেখা যেত। আলেকজান্দিয়া তে ২৮০ খ্রিস্টাব্দের টলেমি প্রথম সোটার প্রতিষ্ঠিত দর্শন মিউজিয়াম ছিল এই ধরনের একটি জাদুঘর।

জাদুঘরের প্রকারভেদ

জাদুঘরের বিভিন্ন ভাগ গুলি হল-

১. সাধারণ জাদুঘর

(১) বহুমুখী জাদুঘর : যে জাদুঘরে একটি স্থানে নানা ধরনের সংগ্রহ গড়ে তোলা হয়, তাকে বহুমুখী জাদুঘর বলা হয়। অষ্টাদশ শতকে মূলত ব্যক্তিগত উদ্যোগে এই ধরনের জাদুঘর গড়ে তোলা হয়। সৌখিন্ন উদ্যোগী ব্যক্তিরা নানা ধরনের দুষ্প্রাপ্য জিনিসপত্র সংগ্রহে আগ্রহী। সংগ্রহ করা বিভিন্ন শিল্প স্থাপত্য কীর্তি নমুনা, চিত্র, পান্ডুলিপি, অস্ত্রশস্ত্র, বস্ত্র অন্যান্য নির্দেশনা এই জাদুঘরে সাজিয়ে রাখা হয়। উদাহরণ : সআলআরজং জাদুঘর (হায়দ্রাবাদ), ভারতীয় জাদুঘর (কলকাতা)।

(২) শিশু জাদুঘর : ১২ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের জন্য গড়ে তোলা হয় শিশু জাদুঘর। এই ধরনের জাদুঘরের প্রদর্শিত হয় এমন জিনিসপত্র, যেগুলি এই বয়সে শিশুদের জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে সাহায্য করে। এই ধরনের জাদুঘর প্রতিষ্ঠার অন্তরালে যে সমস্ত মহান শিক্ষাবিদ গন্ধের তত্ত্বের অনুপ্রেরণা রয়েছে, তারা হলেন জার্মান শিক্ষাবিদ ফ্রেলবেল এবং ইতালি শিক্ষাবিদ মন্তেশ্বরী। এদের তত্তানুসারে এই ধরনের জাদুঘরে শিশুদের উপযোগী বসে আঁকা নানা মডেল তৈরি, কুইজ প্রতিযোগিতা, লুকোচুরি খেলা, সৃজনশীল রচনা প্রভৃতির ব্যবস্থা করা হয়। উদাহরণ : মাউন্ট রায়ান্ড চিলড্রেন্স মিউজিয়াম, আলজিয়াস; মিউজিয়াম অব চাইল্ডহুড, এডিনবার্গ মিউজিয়াম।

(৩) বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের জাদুঘর : বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের মিউজিয়াম মূলত প্রতিষ্ঠিত হয় উচ্চশিক্ষা সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে। মূলত ছাত্র ছাত্রী, শিক্ষক গবেষণাগণ এ জাদুঘর ব্যবহার করে থাকেন। এই ধরনের জাদুঘর গুলিতে নির্দেশন হিসেবে সংরক্ষিত হয় নানা শিল্প কীর্তি, প্রযুক্তিবিদ্যা, নৃবিদ্যা, স্থাপত্যবিদ্যা, চিকিৎসা বিজ্ঞান প্রভৃতি। এই ধরনের জাদুঘর গুলির উদ্দেশ্য হল স্বদেশীয় শিক্ষামূলক তথ্য বলে সংগ্রহ এবং অন্যান্য দেশের সঙ্গে এর আদান-প্রদান। উদাহরণ : প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর : সুইজারল্যান্ড ব্যাসেলের জাদুঘর (১৬৭১খ্রিস্টাব্দ)। প্রথম কলেজ জাদুঘর : আমেরিকার ইয়েল কলেজের আর্ট গ্যালারি (১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে)

২. কলা জাদুঘর

(১) শিল্প সংরক্ষণ জাদুঘর : শিল্প সংরক্ষণ জাদুঘরে বিভিন্ন মৃৎ শিল্প, ধাতুর ফলকে ক্ষোদিত ভাস্কর্য এবং কারুকার্যময় নানা ধরনের শিল্প কৃতি স্থান পায়। এই সমস্ত শিল্প নমুনা গুলি বিশেষভাবে এক একটি ঘরে সাজানো থাকে। উদাহরণ : ফিলাডেলফিয়া মিউজিয়াম অব আর্ট (আমেরিকা), আশুতোষ মিউজিয়াম অফ ইন্ডিয়ান আর্ট (কলকাতা)।

(২) শিল্পদ্রব্য ও প্রতিকৃতি প্রদর্শন শালা : শিল্প উৎপাদনগত জিনিসপত্র প্রদর্শনের জন্য যে জাদুঘর সাজানো থাকে, তাকে শিল্পপ্রদর্শন শালা বলে। আবার চিত্র ও স্থাপত্য প্রকৃতিগুলি যে মিউজিয়ামের সংগ্রহ করে রাখা হয়, তাকে বলে প্রতিকৃতি প্রদর্শন শালা। উদাহরণ : শিল্প প্রদর্শন শালা : অকল্যান্ড শিল্প প্রদর্শন শালা (নিউজিল্যান্ড)। প্রতিকৃতি প্রদর্শনশালা : জাতীয় প্রতীকৃতি প্রদর্শনশালা (লন্ডন)।

(৩) আধুনিক কলা জাদুঘর : সমসাময়িক শিল্প নমুনা গুলি যে জাদুঘরে পরীক্ষা নিয়ে স্তরের থাকে এবং প্রদর্শিত হয়, তাকে আধুনিক কলা জাদুঘর বলে। এখানে পরিদর্শকরা আধুনিক শিল্পের সঙ্গে প্রাচীন শিল্পকলায় তুলনামূলক বিচার-বিশ্লেষণের সুযোগ পায়। উদাহরণ : হংকং এর কলা জাদুঘর (জাপান), বিলিরোজ কলা উদ্যান (জেরুজালেম)।

(৪) লোক কলা ও কারুশিল্প জাদুঘর : বিভিন্ন দেশের লোক শিল্প ও কারু শিল্পজাত নমুনা গুলি যে জাদুঘরে সাজিয়ে রাখা হয়, তাকে লোক কলা ও কারু শিল্প জাদুঘর বলে। এই জাদুঘরে সংরক্ষিত দ্রব্য গুলি অর্থাৎ লোক ও কারুশিল্পের নির্দেশন গুলি মাটি, কাঠ, বাস বাঁশ, চামড়া, সিং, হাড়, দাঁত প্রভৃতি উপকরণ দিয়ে তৈরি হয়। এই জাদুঘর সংরক্ষিত থাকলে পুতুল, সূচি শিল্প নমুনা, বাসনপত্র, বাদ্যযন্ত্র, অলংকার প্রভৃতি। উদাহরণ : ন্যাশনাল ফগ এন্ড ক্রাফট মিউজিয়াম, নিউ দিল্লি (ভারত)।

৩. ঐতিহাসিক জাদুঘর

(১) পত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর : যে জাদুঘরের প্রাগৈতিহাসিক ও ঐতিহাসিক যুগে নানা নির্দেশন সংরক্ষিত হয়, তাকে প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর বলে। এই সমস্ত নিদর্শন গুলি অতীতের ইতিহাসের দ্বারা অনুধাবনের সাহায্য করে। উদাহরণ ; ন্যাশনাল আরকিওলজিক্যাল মিউজিয়াম, এথেন্স (গ্রীস)

(২) ব্যক্তি বিষয়ক জাদুঘর : বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তির ব্যবহৃত দ্রব্য সামগ্রী স্মৃতি হিসেবে সংরক্ষণ করা যে জাদুঘর তা হল ব্যক্তি বিষয়ক জাদুঘর। এখানে সংরক্ষিত থাকে বিখ্যাত ব্যক্তিদের চিঠিপত্র, দিনলিপি, ছবি, সমসাময়িক নথিপত্র প্রভৃতি। উদাহরণ : জোড়াসংখ্যা ঠাকুর বাড়ি (কলকাতা), গান্ধী সবরমতি আশ্রম (আহমেদাবাদ)।

(৩) স্মৃতি জাদুঘর : মহান ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের ও তাদের সমসাময়িক ঘটনাবলী কে স্মরণ করার জন্য যে জাদুকর প্রতিষ্ঠিত করা হয়, তাকে স্মৃতি জাদুঘর বলে। উদাহরণ : ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল (কলকাতা)।

(৪) রাজপ্রাসাদ জাদুঘর : কোন রাজপ্রাসাদের মূল্যবান ব্যবহার সামগ্রী গুলি নিয়ে যখন একটি সংগ্রহশালা গড়ে তোলা হয়, তখন সেই প্রাসাদকে রাজপ্রাসাদ জাদুঘর বলে। এখানে সংরক্ষিত ও প্রদর্শিত হয় রাজবাড়ী সদস্যদের ব্যবহৃত নানান সামগ্রী। উদাহরণ : প্যালেস মিউজিয়াম (অস্ট্রিয়া); মহীশূর প্যালেস (কর্ণাটক)।

৪. বিজ্ঞান বিষয়ক জাদুঘর

(১) ভূতাত্ত্বিক জাদুঘর : ভূতাত্ত্বিক ধারণাদানের সাহায্য করে এমন কিছু নির্দেশনের দ্বারা এই মিউজিয়াম গড়ে তোলা হয়। খনিজ, পাথরে টুকরো, জীবাশ্ম গুলি ছাড়াও এখানে ভূতাত্ত্বিক নীতি ও পদ্ধতিগুলি প্রদর্শিত হয়। উদাহরণ: শিবপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেন (পশ্চিমবঙ্গ, ভারত)।

(২) প্রাণিবিদ্যা জাদুঘর : বনভূমি থেকে সংগ্রহ করা জীবন্ত প্রাণীদের স্থানীয়ভাবে প্রদর্শিত করা হয় যে সুবিশাল অঞ্চল জুড়ে তা হল প্রাণিবিদ্যা জাদুঘর। বন্য ও গৃহীত পালিত প্রাণীদের শিক্ষামূলক ও বিজ্ঞান ধর্মী অনুসন্ধানের সুযোগ করে দেয় এই ধরনের জাদুঘর। উদাহরণ : দা জুলজিক্যাল গার্ডেন (কলকাতা)।

(৩) প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘর : সমুদ্র, পর্বত, অরণ্য প্রবৃতি থেকে সংগৃহীত নানা ধরনের নির্দেশন যেখানে সাজিয়ে রাখা হয় তা হল প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘর। প্রাগৈতিহাসিক যুগের প্রাণীজগত ছাড়াও জীববিদ্যা, সমুদ্রবিদ্যা, নৃতত্ববিদ্যা প্রভৃতি বিষয় বিভিন্ন নির্দেশনগুলি এখানে প্রদর্শিত হয়। উদাহরণ : পিবডি মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্ট্রি (আমেরিকা)।

(৪) বিজ্ঞান জাদুঘর : যে জাদুঘরে সাধারণ বিজ্ঞান, ভৌত বিজ্ঞান বিবর্তন, বিজ্ঞান ধর্মী ধারণা ও উপকরণ, বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তি বিবর্তন প্রবৃত্তির নিদর্শন সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রদর্শন করে থাকে তা হল বিজ্ঞান জাদুঘর। উদাহরণ : মিউজিয়াম অফ সায়েন্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি (শিকাগো)।

উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস বইয়ের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর

Leave a Comment